ছবি পিটিআই।
অনেক কিছুই নির্ভর করিতেছে নির্বাচনের ফলাফলের উপর। উত্তরপ্রদেশের ফল বলিয়া দিবে জনমানসে বিজেপির মুষ্টি শিথিল হইতেছে কি না। পঞ্জাবের ফল জানাইবে, কৃষক আন্দোলন গুটাইয়া লইবার পরও রাজনীতিতে তাহার রেশ কতখানি থাকিয়া গেল। গোয়ায় যখন তৃণমূল কংগ্রেস মাপিয়া লইবে যে, বাংলার বাহিরে দলটি কতখানি জলে দাঁড়াইয়া আছে, পশ্চিমবঙ্গের পুরসভাগুলি তখন জবাব দিবে, রাজ্যের উপর তৃণমূলের রায় নিরঙ্কুশই থাকিল কি না, সেই প্রশ্নের। নির্বাচন মাত্রেই অনিশ্চয়তা। কিন্তু, একটি ফলাফল ভোটের পূর্বেই কার্যত নিশ্চিত হইয়া গিয়াছে— এই নির্বাচনপ্রক্রিয়া কোভিডের তৃতীয় প্রবাহকে শক্তিশালী করিবে। গত বৎসর এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের পরবর্তী পর্বে অতিমারি যে রূপ ধারণ করিয়াছিল, তাহার ক্ষত এখনও অনেকেই স্মৃতিতে বহন করিতেছেন; হয়তো আজীবন করিবেন। তৃতীয় প্রবাহে ভাইরাসের কামড় লঘুতর, অতএব নির্বাচনের ফলে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়িলেও শেষ অবধি তাহা দ্বিতীয় প্রবাহের ন্যায় মারাত্মক হইবে না— নির্বাচন কমিশন যদি এমন কোনও ভরসার দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে তাহা অতি দুর্ভাগ্যজনক হইবে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ওমিক্রন শেষ অবধি ডেল্টা ভ্যারিয়্যান্টের অধিক ক্ষতি করিতে পারে, শুধুমাত্র তাহার অতি সংক্রামক চরিত্রের কারণেই। সামান্য পাটিগণিতেই কথাটি বোঝা সম্ভব। ভাইরাসের যে স্ট্রেনে আক্রান্ত প্রতি ব্যক্তি আরও দুই জনকে সংক্রমিত করিতে পারেন, এবং যাহাতে আক্রান্তের এক শতাংশের মৃত্যু ঘটে, তবে দশ দফা সংক্রমণের পর মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াইবে ১০২৪ জন, মৃতের সংখ্যা ১০ জন। যে স্ট্রেনে আক্রান্ত ব্যক্তি চার জনকে সংক্রমিত করিতে পারেন (ওমিক্রনে যে হারে সংক্রমণ হইতেছে), এবং যদি ০.১ শতাংশেরও মৃত্যু ঘটে, তবে দশ দফা সংক্রমণের পর আক্রান্তের সংখ্যা হইবে ১০,৪৮,৫৭৬ জন; মৃতের সংখ্যা ১০৪৮ জন। এই হিসাবের পরও বিপদের গুরুত্ব বুঝিতে বাকি থাকে কি?
নির্বাচন হইলে এই বিপদ মাথায় লইয়াই হইবে। নির্বাচন কমিশন জানাইয়াছে, কোভিড বিধি কঠোর ভাবে মান্য করিয়াই নির্বাচন প্রক্রিয়া চালাইতে হইবে। কথাটির অর্থ কী, দেশ বিলক্ষণ জানে। গত বৎসর পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনও কোভিড বিধি ‘মান্য’ করিয়া হইয়াছিল; এখন গঙ্গাসাগরের মেলা সেই বিধি ‘কঠোর ভাবে মান্য’ করিয়া হইতেছে। অন্য রাজ্যের কথা থাকুক, শুধু উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়াইয়া পড়িবেন, তাঁহাদের প্রত্যেককে কোভিড বিধি মানাইবে কে? নির্বাচন যত অগ্রসর হইবে, প্রচারের বহর যত বাড়িবে, আশঙ্কা হয় ততই বেশি মানুষ প্রত্যহ সংক্রমণের সম্মুখীন হইবেন। কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন যে, মানুষ নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবিবে না কেন? ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করিয়া তবেই কেন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করিবে না? এই প্রশ্নের বহুবিধ উত্তর সম্ভব। তাহার অন্যতম হইল, সাধারণ মানুষ বিবিধ পন্থায় বিপদের গুরুত্ব মাপিবার চেষ্টা করেন। সমাজে কী চলিতেছে, তাহা হইতে বিপদের মাপ বুঝিবার অভ্যাস তাহার একটি। মানুষ যদি দেখেন যে, নির্বাচন হইতেছে, বিস্তর মানুষ পথে নামিয়াছেন— স্বভাবতই অন্যদেরও বোধ হইবে যে, বিপদ ততখানি গুরুতর নহে। এই ‘বুঝিয়া লওয়া’য় ওমিক্রনের সংক্রমণের হারের হিসাব থাকিবে না, মৃত্যুর সম্ভাবনার তুল্যমূল্য বিশ্লেষণ থাকিবে না— থাকা সম্ভবও নহে; থাকিবে শুধু এক মিথ্যা আশ্বাস— সরকার বাহাদুর যখন অভয় দিতেছে, তখন সত্যই ভয় নাই। সিদ্ধান্তটি সরকারের, না কি নির্বাচন কমিশনের, সেই বিচারের ক্ষমতা অধিকাংশ মানুষের নাই। মানুষ রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করে, এবং এই নির্বাচনের মূল বিপদ সেই বিশ্বাসেই নিহিত। মানুষের মনের বিচার না করিয়াই গণতন্ত্রের মহাযজ্ঞে নামিয়া পড়িবার সিদ্ধান্তটি বিলক্ষণ ভুল হইল।