cow

নটেগাছটি

ফসল বাঁচাইতে রাতভর পালা করিয়া প্রহরা চাষির কাছে নূতন নহে, সাম্প্রতিক এই উপদ্রবের লাগামছাড়া মাত্রাটি নূতন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:২৫

বন্য জন্তু— হাতি, বাঘ বা বরাহ নহে, গৃহপালিত পশুও তবে মাথাব্যথার কারণ হইয়া দাঁড়ায়। যেমন হইয়াছে উত্তরপ্রদেশে। বেওয়ারিশ গবাদি পশু, গরু-মহিষের সংখ্যা সেখানে এমন মাত্রা ছাড়াইয়াছে যে কৃষকদের রাত কাটিতেছে ফসলের প্রহরায়, গম আলু বা সরিষার খেতে। শ্রমক্লান্ত দিনশেষে কৃষকের দীর্ঘ রাত্রির বিশ্রাম মিলিতেছে না, রাতের শস্যক্ষেত্র হইতে নিরীহ গবাদি পশু তাড়াইতে গিয়া ঘটিতেছে দুর্ঘটনাও। অভিযোগ ও ক্ষয়ক্ষতির পাল্লা ভারী হইতেছে, কারণ বন্য পশুর হানায় ফসল নষ্ট হইলে তবু ক্ষতিপূরণ মিলিতে পারে, ছাড়িয়া রাখা গবাদি পশুর পেটে খেতের ফসল গেলে সেই ক্ষতিপূরণের সুযোগ নাই। অথচ ইহা এক রোজকার সমস্যা, বিশেষত রবিশস্যের মরসুমে।

ফসল বাঁচাইতে রাতভর পালা করিয়া প্রহরা চাষির কাছে নূতন নহে, সাম্প্রতিক এই উপদ্রবের লাগামছাড়া মাত্রাটি নূতন। সমস্যার সমাধান রাজ্যের সরকারের করিবার কথা, কিন্তু উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের দুর্ভাগ্য, তাঁহাদের এই সমস্যার সৃষ্টি হইয়াছে খোদ যোগী আদিত্যনাথের সরকারি অধ্যাদেশের জেরেই। গো-সম্পদের রক্ষা তথা গো-হত্যার সহিত যুক্ত অপরাধের প্রতিরোধে কয়েক বৎসর ধরিয়া চলিতেছে রাজ্য সরকারের কার্যক্রম: বেআইনি কসাইখানা বন্ধ করা, গো-রক্ষায় আশ্রয়কেন্দ্র ও গোশালা নির্মাণ, নজরদারি ইত্যাদি। ব্যবহারিক গুরুত্বে এই সবই গো-হত্যায় নিষেধাজ্ঞা জারিরই নামান্তর। তাহা আরও কঠোর হইয়াছে গো-রক্ষক বাহিনীর প্রবল প্রতাপে, সাম্প্রতিক কালে উত্তরপ্রদেশে গোমাংসকে কেন্দ্র করিয়া ঘটিয়া যাওয়া হেনস্থা, হিংসা এমনকি মৃত্যুর ঘটনাগুলিই প্রমাণ। এক দিকে গরুর কোনও রকম শারীরিক ক্ষতি ঘটাইলে সাত বৎসর পর্যন্ত কারাবাস বা বিরাট অঙ্কের জরিমানার সরকারি নিদান, অন্য দিকে গো-রক্ষকদের জুলুম মিলিয়া এই ব্যবহারিক সত্যকেই ভুলাইতে বসাইয়াছে: গ্রাম ও শহরে অশক্ত অক্ষম গবাদি পশুকে কসাইখানায় দিয়া আসাই রীতি, ভারতের কৃষক ও গো-পালক সমাজে তাহা বহুল-আচরিত। ইহার সহিত ধর্ম বা নীতিবিদ্যার যোগ নাই, জোর করিয়া যোগের প্রয়োজনও নাই, এক রাজনীতির স্বার্থ না থাকিলে। অথচ তাহাই হইতেছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষণাতেই হইতেছে— ধর্মীয় মতাদর্শের দোহাই দিয়া।

Advertisement

কিন্তু রাজনীতি বা ধর্মের চাষে তো কৃষিক্ষেত্রে ফসল ফলে না। তাহা ব্যবহারিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্র, যে বিজ্ঞান আবহমান কাল ধরিয়া ভারতের কৃষকের জানা, গবাদি পশুর সময়োপযোগী রক্ষণ এমনকি বর্জনও যাহার অঙ্গ। কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক জানাইয়াছে, সারা দেশে বেওয়ারিশ গবাদি পশুর সংখ্যা সাম্প্রতিক কালে কমিলেও যথেষ্ট বাড়িয়াছে উত্তরপ্রদেশে। বাড়িবারই কথা। রাজ্যের সমস্ত গবাদি পশুর জন্য আশ্রয়কেন্দ্র গড়িতে বিপুল অর্থ ও পরিকাঠামো প্রয়োজন, তাহা কোথা হইতে আসিবে? পরিবেশবিজ্ঞানীরা মনে করাইয়া দিতেছেন এত গবাদি পশুর নিশ্বাস ও বর্জ্য হইতে নির্গত বিপুল কার্বন-ভারের কথা, প্রশাসন যাহা ফিরিয়াও দেখে না। বিধানসভা বা রাজনীতির অঙ্গন এই ভাবে বিতর্কতপ্ত হইবে, ইত্যবসরে স্কুলের মাঠ, ফ্লাইওভারের তলা বা রাজপথ হইয়া উঠিবে গবাদি পশুর অবাধ বিচরণক্ষেত্র। উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা শীতার্ত রাতে অনিদ্র প্রহরায় জাগিয়া থাকিবেন। সরকার কাণ্ডজ্ঞানের নটেগাছটি মুড়াক, গরু তাহাদের ফসল মুড়াইলে সর্বনাশ।

আরও পড়ুন
Advertisement