Indian Government

অসার

বিচার-বিতর্ক সংসদের দুই কক্ষ থেকে কার্যত উধাও হয়ে গিয়েছে, সংসদ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বিরোধিতার মঞ্চ। কাজের দিনকে ছাড়িয়ে যেতে চায় বয়কটের দিন, আলোচনার জায়গা নিয়েছে চিৎকৃত স্লোগান, বিশৃঙ্খলা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২২ ০৬:৩৮
ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

ভারতে গণতন্ত্র কি তবে পোকায়-খাওয়া কয়েতবেল হয়ে উঠছে? সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ বণ্টনে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলি যেন তেমন অসারতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্র, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির শীর্ষ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল বিরোধীদের, রাখা হল কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি ও এনডিএ শরিকদেরই। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির শীর্ষ পদ থেকে কংগ্রেসের সাংসদের অপসারণ, এবং সেই স্থানে কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপির সাংসদকে বসানো এক দীর্ঘ ঐতিহ্যের অবসান ঘটাল। তেমনই, দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও তৃণমূলের কোনও সাংসদকে একটিও কমিটি-প্রধানের পদে না রাখা বিস্ময়কর। কেন্দ্র জানিয়েছে, যে-হেতু সংসদে কংগ্রেসের সাংসদের সংখ্যা যথেষ্ট নয়, তাই দলের প্রাপ্য কমিটি-প্রধানের পদের সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। কংগ্রেসের উত্তর, সংখ্যার হিসাবই একমাত্র বিবেচ্য নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের দীর্ঘ দিনের ধারাকেও মানা দরকার। এই যুক্তি যথার্থ, তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি রয়েছে। গণতন্ত্রে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে, বিশেষত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে, বিরোধীর ভূমিকা অপরিহার্য। শাসকের এক তরফা ইচ্ছায় আইন প্রণয়ন হলে সে দেশ কার্যত একাধিপত্যকামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিরোধীদের নজরদারি ও পরামর্শ, শাসক-বিরোধী বিতর্কের মাধ্যমে উপনীত সিদ্ধান্তকে কার্যকর করাই গণতন্ত্রের পথ।

সেই বিচার-বিতর্ক সংসদের দুই কক্ষ থেকে কার্যত উধাও হয়ে গিয়েছে, সংসদ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বিরোধিতার মঞ্চ। কাজের দিনকে ছাড়িয়ে যেতে চায় বয়কটের দিন, আলোচনার জায়গা নিয়েছে চিৎকৃত স্লোগান, বিশৃঙ্খলা। এমনকি প্রবীণ নেতা-মন্ত্রীদের বক্তব্যেও বিদ্রুপ, কটাক্ষ, কটূক্তির ঝাঁঝ বাড়ছে, কমছে সৌজন্যপূর্ণ বাদানুবাদ। এর একটি ফল— কোনও আলোচনা ছাড়াই একের পর এক বিল পাশ হয়ে যাচ্ছে, আইন প্রণয়নের সময়ে বিরোধীদের বক্তব্য শোনার, এবং তার যথাযথ উত্তর দেওয়ার অবকাশ থাকছে না। এর ফলে বিরোধিতায় নামতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। নাগরিকত্ব আইন এবং তিনটি কৃষক আইনের প্রতিবাদে যে দীর্ঘ ও প্রাণক্ষয়ী আন্দোলন দেখল দেশ, তার অনেকটাই এই কারণে যে, তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের আপত্তি সংসদে তুলে ধরার যথেষ্ট সুযোগ পাননি। আক্ষেপ এই যে, আলোচনাহীনতার এই ধারা কেবল সংসদেই আটকে নেই, তা ছড়িয়ে পড়ছে বিধানসভাগুলিতেও। গত বছর পশ্চিমবঙ্গ-সহ দশটি রাজ্যে যতগুলি বিল পাশ হয়েছে, তার সবই হয়েছে এক দিনের মধ্যে। অর্থাৎ, বিরোধীদের মত প্রকাশের, আপত্তি জানানোর কোনও অবকাশই দেয়নি শাসক। গণতন্ত্রের ক্ষয় হচ্ছে তার প্রাণকেন্দ্রে— আইনসভায়।

Advertisement

আক্ষেপ, দলীয় সংঘাত ছড়িয়েছে স্থায়ী কমিটিগুলিতেও। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্সটস কমিটিতে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির কোনও সদস্যকে স্থান দেয়নি। যা নিঃসন্দেহে ঐতিহ্য বিরোধী এবং অগণতান্ত্রিক। এ বার তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়কে খাদ্য ও উপভোক্তা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির প্রধান পদ দেওয়ার মধ্যে তারই ‘প্রতিশোধ’ দেখছে রাজনৈতিক মহল। দলীয় বিদ্বেষের পঙ্কিলতা এ ভাবে ছড়াচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলিকে। এক দিকে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাতন্ত্র্য ব্যাহত হচ্ছে, অথবা প্রধান কার্যকর্তার অভাবে সেগুলি নামমাত্রসার। অপর দিকে, বিরোধীদের ক্রমাগত সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান থেকে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হচ্ছে শাসক দলে। ক্ষমতার এই ভারসাম্যহীনতা গণতন্ত্রকে আরও বিপন্ন করে তুলছে।

আরও পড়ুন
Advertisement