Child and Childhood

শিশুর সম্মান

জ্ঞানগর্ভ ভারী ভারী কথা নয়, একেবারে কথা বলার ছলে, সংক্ষেপে তিনি নিজের বক্তব্যটুকু জানিয়ে দেন, বাকি যা কিছু বলার সবই বলে ওই চলমান ছবিরা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:০২
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

এগারো মাসের মেয়েটি বসে আছে, বিকেলবেলার রোদ্দুর তার ছায়া ফেলেছে ঘরের মেঝেতে, সে নিবিষ্ট হয়ে ওই ছায়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সমাজমাধ্যমে নিজের ‘পাতা’য় ভিডিয়ো-চিত্রটি রেখে ড্যান উয়োরি মন্তব্য করেছেন: নজর রাখুন এই ছোট্ট বিজ্ঞানীর দিকে। তিন বছরের ছেলেকে তার মা রেস্তরাঁর টেবিলে বসে নিজের খাবার বেছে নিতে উৎসাহ দিচ্ছেন, এই ‘ক্লিপ’টি দেখিয়ে ড্যান ওই জননীকে অভিবাদন জানাতে লিখে দিয়েছেন: এ-প্লাস!— আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনার বাসিন্দা ড্যান সমাজমাধ্যমে দুনিয়ার শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের ভিডিয়ো-চিত্র খুঁজে বেড়ান। শুনে মনে হতে পারে, সে আর বলার কী আছে? এমন অগণন চিত্র তো ডিজিটাল পরিসরে অহোরাত্র ভেসে বেড়াচ্ছে, মানুষ অহরহ সেই সব ছবি তুলছেন, সরবরাহ করছেন, দেখছেন, অন্যদের পাঠিয়ে দিচ্ছেন। অনেক সময় চিত্তাকর্ষক ছবি তুলে দুনিয়ার চোখের সামনে মেলে ধরার তাড়নায় বড়রা শিশুদের ব্যতিব্যস্ত বা বিরক্ত করতেও কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। কিন্তু বাহান্ন বছর বয়সি ড্যান শুধু অকারণ পুলকে এই চলৎ-চিত্রাবলি খোঁজেন না, তাঁর সন্ধান ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। তিনি শিশু-মনস্তত্ত্বের বিশেষজ্ঞ। খুব ছোট শিশুরা আপনমনে কোন খেলা খেলে, কী দেখে, কী শোনে, তাদের সঙ্গে বাবা-মা তথা বড়রা কী কথা বলেন, কী ভাবে বলেন, কেমন আচরণ করেন, এই সব প্রশ্ন তাঁর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিডিয়ো-চিত্রগুলি দেখে দেখে তিনি এমন কিছু ছবি বেছে নেন, যেখানে সুস্থ স্বাভাবিকতা আছে, স্বতঃস্ফূর্ত বিনিময় আছে, আনন্দ আছে, সর্বোপরি শিশুকে এক স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসাবে স্বীকৃতি এবং সম্মান দেওয়ার আগ্রহ আছে, তার নিজের মতো আচরণের স্বাধীনতা আছে। তার পরে এই বেছে-নেওয়া ক্লিপগুলি তিনি নিজের পরিসরে ‘পোস্ট’ করেন, সঙ্গে থাকে নানান মন্তব্য, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, পরামর্শ। জ্ঞানগর্ভ ভারী ভারী কথা নয়, একেবারে কথা বলার ছলে, সংক্ষেপে তিনি নিজের বক্তব্যটুকু জানিয়ে দেন, বাকি যা কিছু বলার সবই বলে ওই চলমান ছবিরা।

Advertisement

সমাজমাধ্যমে ড্যান উয়োরির ‘ফলোয়ার’ বা অনুগামীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সেটা ভরসার কথা। নেতিবাচক, কুরুচিপূর্ণ এবং বিষাক্ত শব্দ ও ছবির উপদ্রবে সমাজমাধ্যম যখন উত্তরোত্তর পর্যুদস্ত, তখন এমন স্বাস্থ্যকর এবং সদর্থক উদ্যোগ বহুজনের স্বীকৃতি পাচ্ছে, সুসংবাদ বইকি। কিন্তু তাঁর উদ্যোগটির প্রকৃত গুরুত্ব নিছক অনুগামীর সংখ্যা দিয়ে ধরা যাবে না। শিশু এবং শৈশবকে যে সম্মান দেওয়ার কাজটি তিনি এই ভাবে সম্পাদন করে চলেছেন, তার মূল্য এবং সম্ভাবনা অপরিসীম। শিশুদের নিয়ে বড়দের আচরণের নানা মাত্রা অহরহ প্রকট হয়: সরাসরি দমন, পীড়ন, আধিপত্য জারি থেকে শুরু করে এক দিকে নির্মম ঔদাসীন্য ও উপেক্ষা এবং অন্য দিকে অতিরিক্ত আদর, পরিচর্যা, প্রশ্রয় অবধি অনেক ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বহু শিশুকে বড় হতে হয়। এই বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতার চালচিত্রে যে বস্তুটির অভাব কার্যত সর্বজনীন ও সর্বময়, তার নাম সম্মান। এটা ঠিকই যে, গত শতকের মধ্যপর্ব থেকে ‘শিশুর অধিকার’-এর ধারণাটি ক্রমশ দুনিয়া জুড়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অনেক দেশে তার কার্যকর প্রয়োগও দেখা গিয়েছে, কোনও কোনও সমাজে শিশুর ব্যক্তিস্বাধীনতা আইনি অধিকারের সীমা অতিক্রম করে অন্তত কিছু পরিমাণে সামাজিক চেতনার অঙ্গীভূত হয়েছে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই, বিশেষত আমাদের মতো দেশে, শিশুকে সম্মান করার স্বাভাবিক অভ্যাস আজও নিতান্ত বিরল।

স্পষ্টতই, এই সত্যের গভীরে নিহিত আছে ক্ষমতার নিজস্ব অঙ্ক। সামাজিক জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে ও সমস্ত স্তরে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার কাঠামো প্রতিনিয়ত নিজেকে জারি রাখার চেষ্টা করে চলে। মর্যাদা বা সম্মানের প্রচলিত ও স্বীকৃত ধারণা সেই কাঠামোর অনুগত। শিশু সেখানে ‘ভাবী নাগরিক’, অর্থাৎ পূর্ণ মর্যাদার দাবিদার হওয়ার জন্য তাকে বড় হওয়া অবধি অপেক্ষা করতেই হবে। বস্তুত, বড় হওয়া বা ‘মানুষ হওয়া’র প্রক্রিয়াটি নিজেই সেই ক্ষমতার কাঠামোকে ধরে রাখার এবং আরও শক্তপোক্ত করে তোলার কাজে নিয়োজিত। প্রক্রিয়াটিকে তুচ্ছ করার উপায় নেই, শিশুর হাত ধরে তাকে পরামর্শ দেওয়া, সাহায্য করা এবং প্রয়োজনে সুশাসন করা অবশ্যই অভিভাবকের কাজ, বড়দের কাজ। কিন্তু তাকে ব্যক্তির মর্যাদা দিলে, তার কথা মন দিয়ে শুনলে, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সম্মান করলে তবেই অভিভাবক শব্দটি সার্থক হয়ে উঠতে পারে। ড্যান উয়োরি সেই প্রয়োজনীয় কাজটি সম্পাদনের পথ দেখাচ্ছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement