Artificial Intelligence

কী আছে শেষে...

পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটির কাজ উত্তরোত্তর আয়ত্ত করে ফেলছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’, তাকে যন্ত্রমেধা বা কৃত্রিম বুদ্ধি যে নামেই ডাকা হোক না কেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:০০

একে একে নিবিছে দেউটি। প্রযুক্তির ক্ষমতা মানুষের নিজস্ব সামর্থ্যের পরিসরগুলিকে ক্রমশই গ্রাস করে নিচ্ছে। শারীরিক ক্ষমতায় যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতার গল্প তো বহু কাল আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। মেশিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চেয়ে জন হেনরির পরিণতিতে যে বেদনার্ত মহিমা, তার কোনও অবকাশই আজ আর অবশিষ্ট নেই। মস্তিষ্ক তথা বুদ্ধির দৌড়েও যন্ত্র এবং প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নতির সামনে মানুষী শক্তির সীমান্তগুলি নিরন্তর বিলীয়মান। অঙ্ক কষা থেকে দাবা খেলা, সর্বত্র রচিত হচ্ছে যন্ত্রমেধার নতুন নতুন দিগ্বিজয়ের কাহিনি। চ্যাটজিপিটি ও তার সমগোত্রীয় প্রকরণগুলি সেই কাহিনিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যার ফলে দৈনন্দিন জীবনের বহু ‘মাথার কাজ’-এও মানুষের প্রয়োজন দ্রুত, অতি দ্রুত কমে আসছে। গত এক বছরে তেমন নানা ‘আবিষ্কার’ দুনিয়ার মানুষকে বারংবার যুগপৎ চমৎকৃত এবং আতঙ্কিত করেছে। বহু ধরনের কাজে আর কোনও কর্মীর প্রয়োজন থাকবে কি না, থাকলেও সেই প্রয়োজন মুষ্টিমেয় মানুষ দিয়েই মিটিয়ে ফেলা যাবে কি না, এই প্রশ্ন এখন আর ভবিষ্যৎচিন্তার অঙ্গ নয়, ঘটমান বর্তমানের পদে পদে তা অনিবার্য হয়ে উঠছে। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটির কাজ উত্তরোত্তর আয়ত্ত করে ফেলছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’, তাকে যন্ত্রমেধা বা কৃত্রিম বুদ্ধি যে নামেই ডাকা হোক না কেন।

Advertisement

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ও কি বাকি থাকবে না? বছরের শেষ লগ্নে প্রকাশিত একটি সংবাদ তেমন সংশয় জাগিয়ে তুলেছে। জার্মানিতে এক গবেষক দল রসায়নশাস্ত্র এবং কৃত্রিম বুদ্ধির সমাহারে একটি পরীক্ষা চালিয়েছেন। হুইস্কির স্বাদগন্ধের পরীক্ষা। রসিকজনে বিলক্ষণ জানেন, সেই পরীক্ষা কত কঠিন। বিজ্ঞানের কাছে তার সূত্র আছে— চল্লিশটির বেশি ‘কম্পাউন্ড’ বা যৌগের মিশেলে তৈরি পানীয়ের মধ্যে সেই উপকরণগুলির অন্তর্নিহিত অণু-বিন্যাসের উপর নির্ভর করে তার নিজস্ব চরিত্র। কিন্তু ঘ্রাণ এবং আস্বাদনের ভিত্তিতে সেই চরিত্র অনুধাবন করা এবং বিভিন্ন গোত্রের পানীয়কে চিনে নেওয়ার বিদ্যাটি বিশ্ব জুড়ে এক উচ্চাঙ্গের শিল্প হিসাবেই সম্মানিত হয়ে থাকে। সেই শিল্পে পারঙ্গমতা অর্জনের জন্য কেবল কঠোর প্রশিক্ষণই জরুরি নয়, সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয়গুলিকে সযত্নে সুস্থ ও সতেজ রাখাও অত্যাবশ্যক— তার জন্য যথেষ্ট কৃচ্ছ্রসাধনও করতে হয়। বস্তুত, অন্য সমস্ত শিল্পচর্চার মতোই এই রসাস্বাদনের ক্ষেত্রেও যাঁরা যথার্থ কৃতী বলে গণ্য হন, তাঁদের দক্ষতাকে পুরোপুরি অনুশীলনের মাত্রা দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। ধরেই নেওয়া হয় যে প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কোনও বিশেষ নিজস্ব বোধ বা অনুভূতি এ ক্ষেত্রে কাজ করে এবং এই ‘ব্যাখ্যাতীত’ সামর্থ্যের উৎসকেই বলা হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। এই কারণেই চা হোক বা সুরা হোক, বিভিন্ন পানীয়ের চরিত্র ও উৎকর্ষ বিচারের কাজটিতে যাঁরা পারদর্শী, তাঁদের সংখ্যা সচরাচর সীমিত এবং তাঁদের কদরও সেই অনুপাতেই বেশি।

এখানেই জার্মানিতে আয়োজিত পরীক্ষাটির তাৎপর্য। এই পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যন্ত্রমেধার ভিত্তিতে তৈরি অ্যালগরিদম বা গণনাসূত্র কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের হুইস্কির চরিত্র বিচারের কাজটি চমৎকার সম্পন্ন করা গিয়েছে, এবং কোনও কোনও বিষয়ে, বিশেষত গন্ধ বিচারের ক্ষেত্রে, সেই প্রযুক্তি মানুষের থেকেও বেশি পারঙ্গম। কৃত্রিম বুদ্ধির দৌড় যে ভাবে ক্রমশই দ্রুততর হয়ে চলেছে, তাতে অনুমান করা যেতে পারে যে অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য দিক থেকেও পানীয়ের সূক্ষ্মবিচারে মানুষ উত্তরোত্তর পিছিয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তার পরেও এই কাজে মানুষের প্রয়োজন ফুরোবে না, কারণ মানব ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিগুলিকে পর্যালোচনা করেই যন্ত্রমেধা তার কাজ করতে পারে, তাই মানুষ ছাড়া সে মানুষী অনুভূতি শিখতে পারবে না। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। প্রযুক্তি যদি এমন একটি স্তরে পৌঁছয়, যার পরে মানব-অনুভূতির মতোই ‘যন্ত্র-অনুভূতি’র নিজস্ব পরিসর তৈরি হয়ে যাবে? এবং— ভাবতেও ভয় হতে পারে— সেই যান্ত্রিক অনুভূতিই মানুষকে আদ্যোপান্ত চালনা করবে? তখন, সেই কৃত্রিম বুদ্ধি শাসিত দুষ্কল্পলোকে, মানবিক ইন্দ্রিয়গুলির প্রয়োজনই হয়তো বা ফুরিয়ে যাবে। অসম্ভব? অবিশ্বাস্য? এই দুর্ভাবনা এক বছর আগে যতটা অসম্ভব এবং অবিশ্বাস্য ছিল, আজও কি ততটাই আছে? কে বলতে পারে, সমাসন্ন নতুন বছরে দুনিয়ার নানা প্রান্তে যন্ত্রমেধার নতুন নতুন দিগ্বিজয়ের মধ্য দিয়ে এমন সব পরিণতিই দেখতে দেখতে সম্ভব, বিশ্বাস্য এবং বাস্তব হয়ে উঠবে না? প্রযুক্তি কেন বাধ্যতে।

Advertisement
আরও পড়ুন