Bangladesh Unrest

স্মৃতির সংগ্রাম

স্রেফ মূর্তি ভেঙে, ছবি সরিয়ে, এমনকি পাঠ্যপুস্তকে বদল এনেও যে জনস্মৃতি থেকে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়া যায় না, স্বাধীনতার কান্ডারি ও কারিগরদের মুছে ফেলা যায় না, সেও ইতিহাসেরই শিক্ষা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:১৮
অশান্ত বাংলাদেশ।

অশান্ত বাংলাদেশ। —ফাইল চিত্র।

মূর্তি উৎপাটন, মুরাল ধ্বংস দিয়ে শুরু, অতঃপর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক বাসগৃহ তথা সংগ্রহশালায় আগুন। যা ছিল উগ্র ক্রুদ্ধ জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে তা সরকারি ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘স্মৃতি নির্মূল প্রকল্প’ হয়ে উঠেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর ও তাঁর পরিবারের অনুষঙ্গ জড়িত কয়েকটি জাতীয় দিবস বাতিল ঘোষণার পর সম্প্রতি সেখানকার রাষ্ট্রপতির বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বই থেকে বাদ পড়ছে বঙ্গবন্ধুর লেখা। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা তার এক প্রকার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সমাজমাধ্যমে, বঙ্গবন্ধু সেখানে শুধুই ‘১৯৭১-পরবর্তী ফ্যাসিবাদী নেতা’।

Advertisement

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আবহে প্রকৃত ইতিহাস ও ইতিহাস-নির্মাতাদের মুছে দেওয়ার চেষ্টা নতুন নয়। শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, বিশ্ব জুড়েই নানা দেশে নানা কালে এই চেষ্টা হয়েছে, তাতে কাজের কাজটি হয়নি। স্রেফ মূর্তি ভেঙে, ছবি সরিয়ে, এমনকি পাঠ্যপুস্তকে বদল এনেও যে জনস্মৃতি থেকে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়া যায় না, স্বাধীনতার কান্ডারি ও কারিগরদের মুছে ফেলা যায় না, সেও ইতিহাসেরই শিক্ষা। মিলান কুন্দেরার বহুশ্রুত বাক্যটি আবারও স্মরণ করতে হয়: ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। মূর্তি, সড়ক, প্রতিষ্ঠান, ছবি, বই, অতীত ইতিহাসের স্মারক যা কিছু জনপরিসরে দৃশ্যমান, নতুন জমানার ক্ষমতা তা ভুলিয়ে দিতে চাইবে, চেষ্টা করবে অতীতের প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনার বিপরীতে সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পরিবর্ত হিসাবে ২০২৪-এর জুলাই-অগস্টকে তুলে ধরা তারই উদাহরণ, আগের সরকারের সংবিধান সংশোধনীকে কাঠগড়ায় তুলে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি ও তার ধারণাকেও মুছে ফেলার প্রস্তাব তারই পরের ধাপ। জাতি ধর্ম-নির্বিশেষে বাঙালিকে মুক্তির পথে একত্র ও স্থিরলক্ষ্য করলেন যিনি, তাঁর বিচার করতে হচ্ছে উত্তরসূরির একতন্ত্রের অপরাধে, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান সম্পর্কে কুলুপ এঁটে, এ-ই কি সবচেয়ে বড় প্রমাণ নয়— ইতিহাসে তাঁর ভূমিকাটি নির্বিকল্প, অপরিবর্তনীয়?

শাসনতন্ত্র যখন ক্ষমতাতন্ত্র হয়ে ওঠে তখনই এই নতুন ইতিহাস লেখার, পুরনো ইতিহাসকে বর্জনের প্রবণতা বাড়ে। রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে উত্তেজিত, বিভ্রান্ত, ক্লান্ত নাগরিকদের ঢাল করে আখের গোছাতে চায় ক্ষমতালিপ্সু অপশক্তি। এই রকম অস্থির সময়ই সচেতন ও সুচেতন নাগরিকদের পরীক্ষা— অর্জিত ইতিহাসের মাটিতে নিজেদের শিকড় এখনও দৃঢ় প্রোথিত আছে কি না তা দেখে নেওয়ার, কিছুমাত্র ধস দেখলে অবিলম্বে তা সংস্কারের। এই সংস্কারকাজটি দ্বিমুখী। রাজনৈতিক অপশক্তি যখনই স্বার্থসিদ্ধির মতলবে স্বদেশের প্রকৃত ইতিহাস ও স্বাধীনতার রূপকারদের মর্যাদাহানি করবে, সর্বাবস্থায় সর্বশক্তিতে তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হবে বহিরঙ্গে, এবং স্বদেশের ইতিহাস ও ইতিহাস-রচয়িতাদের জাগরূক রাখতে হবে অন্তর্জীবনে— স্মৃতিতে ও যাপনে। সেই সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে আসল ইতিহাস, যাতে তারা রাজনীতি ও ক্ষমতাতন্ত্রের ক্রীড়নক হয়ে না ওঠে। জনস্মৃতির মহামূল্য মহাফেজখানাতেই ইতিহাসের আশ্রয়, তাকে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না কোনও মূল্যেই।

আরও পড়ুন
Advertisement