—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পর, এ বার বাসস্থান। পশ্চিমবঙ্গে আবাস যোজনার দুর্নীতি নিয়ে আলোড়ন ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র। অন্য দু’টি ক্ষেত্রের মতোই এই বিষয়টিও রাজ্য রাজনীতির মঞ্চ অধিকার করেছে বহু-বিলম্বিত লয়ে। এই মুহূর্তে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক গ্রাম পঞ্চায়েত বাংলার আবাস যোজনার পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির তথ্য সামনে আনছে। কেবল তা-ই নয়, সংঘর্ষ, হুমকি, দমন, নির্যাতন সবই অতিপরিচিত চিত্রনাট্যের মতো ঘটে চলেছে গোটা রাজ্য জুড়ে। বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়— পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুরের সঙ্গে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মতো তৃণমূল কংগ্রেস অধ্যুষিত জেলাও কিন্তু একই ভাবে বিক্ষোভে অগ্নিগর্ভ। আপাতভাবে শাসক দলের অন্দরের লোকও ক্রোধে ফেটে পড়ছেন, আবাস যোজনার তালিকা থেকে অন্যায় ভাবে বাদ পড়েছেন যাঁদের নিয়মমতে প্রাপক হওয়ার কথা, এবং তালিকায় প্রবিষ্ট হয়েছে অসংখ্য ভুয়ো নাম, এমনকি একাধিক বার একই নামে টাকা দেওয়ার তথ্যও মিলেছে। ঠিক লোকের বদলে ভুল লোককে তালিকাভুক্ত করা, ঠিক লোকদের ঘর দেওয়ার নাম করে প্রাপকপিছু বড় অঙ্কের ‘কাটমানি’ নিশ্চিত করা, বিভিন্ন খাতে দরিদ্র মানুষকে অতিরিক্ত টাকা দিতে বাধ্য করা, অসচেতন কিংবা অসাক্ষর প্রাপকের নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বদলে অন্য কোনও অ্যাকাউন্টে টাকা আনিয়ে নেওয়া— আবাস যোজনার নামে বিপুল আর্থিক নয়ছয়ের বিষয়টি এমন উচ্চতায় উঠেছে যে হাই কোর্টে রাজ্য সরকারও বিষয়টি মেনে নিয়েছে। রাজ্যের নিজস্ব রিপোর্ট দেখেই বিচারপতি রবি কৃষণ কপূর সংশ্লিষ্ট বিডিও ও পঞ্চায়েত প্রধানদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করেছেন। পরিস্থিতি এমনই অভাবনীয় যে, শাসক দলের নেতা-কর্তা-প্রতিনিধিদের আবাস যোজনার নামে টাকা নয়ছয়ের ঢালাও বন্দোবস্তের কথা সামনে আসতেই কেবল বঞ্চিত গ্রামবাসীরাই ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন না, খড়্গহস্ত হয়েছেন তাঁরাও, যাঁরা আর্থিক দুর্নীতির খেলায় দলীয় কোন্দল কিংবা গোষ্ঠীবাজিতে কোনও না কোনও কারণে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন।
লক্ষণীয়, গত বছর যখন রাজ্যে দুর্নীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা বা পিএমএওয়াই-এর খাতে অর্থাগম বন্ধ হয়েছিল, তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই সব অভিযোগ তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, আসন্ন নির্বাচনের আগে এই সব কেবল রাজনীতির বাজার গরম করার চেষ্টা। বিজেপি-সহ বাকি বিরোধীরা একই বাজার গরমের অভিযোগ এনেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, যখন কেন্দ্রীয় যোজনার বদলে রাজ্যের নিজস্ব আবাস যোজনায় প্রতি প্রাপককে এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা তিন লপ্তে দেওয়ার কথা ঘোষিত হল— ইংরেজি-মতে যার নাম বিএওয়াই। এক বছরের মধ্যে দুর্নীতি যে ভাবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজ্যের নতুন যোজনাটিকেও গ্রাস করে ফেলেছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রী কী ভাবছেন জানতে ইচ্ছা করে। তাঁর উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, প্রাপকদের নাম তালিকাভুক্ত করার সময়ে ‘মানবিক’ হওয়া জরুরি ইত্যাদি। কিন্তু যেখানে সরাসরি বিডিও-রা প্রত্যক্ষ ভাবে আর্থিক তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত, কেবল তালিকা সংশোধনে কি নেত্রী ও আধিকারিকরা সমস্যার সমাধান আশা করেন? হয় এখনও তাঁরা ভাবের ঘরে চুরি করছেন, কিংবা রাজ্যবাসীকে বোকা বানানোর প্রয়াস করছেন।
একের পর এক বিপুল ও ব্যাপক দুর্নীতির তথ্য প্রকাশে যেখানে রাজ্য সরকারের এই মুহূর্তে সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতা অস্তমিত, সেই সময়ে আবাস যোজনা কেলেঙ্কারি আর এক বার বুঝিয়ে দিল কী ভাবে এ রাজ্যে ‘কাটমানি কালচার’ এখন সব রকমের সামাজিক ন্যায়-মুখী প্রকল্পের গোড়ায় বিষ ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। সঙ্কীর্ণতম রাজনৈতিক স্বার্থ ও ঘৃণ্যতম অর্থলিপ্সার শিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে গোটা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ সমাজ। এত বড় দুর্ভাগ্য রাজ্যবাসীর প্রাপ্য ছিল না।