গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
পুনিয়াটা নামা! নামা! শিগগির নামা! নীরজ সোনা পেয়ে গিয়েছে। ওর কপিটা তোল! দ্রুত তোল!
অগস্টের ৭ তারিখ বিকেল থেকে ধীরে ধীরে গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার মোহনায়। আনন্দবাজার অনলাইনের সম্পাদকীয় দফতরে তুমুল কোলাহল। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতের একমাত্র সোনা পাওয়ার খবরটা দ্রুততম বেগে ধরাতে হবে। সকলের আগে। সবচেয়ে আগে!
তেইশ বছরের নীরজ চোপড়ার সাফল্যের দ্যুতিতে ঝলসে যাচ্ছে জোড়া জোড়া চোখ। খলবল করছে অভিনন্দনের ঢেউ। বাইরে অন্ধকার নামছে। অলিম্পিক্সের স্বর্ণপদকের ঝলসানিতে আরও গাঢ় হচ্ছে সেই আঁধার। সেই অন্ধকারেই ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছিলেন আরও এক অলিম্পিক্স পদকজয়ী বীর। সাতাশ বছরের বজরং পুনিয়া। কয়েক ঘণ্টা আগে যিনি ভারতের হয়ে অলিম্পিক্স কুস্তিতে ব্রোঞ্জ জিতলেন। ততক্ষণ পর্যন্ত যাঁর গরিমায় আলোকিত হচ্ছিল গোটা একটা দেশ, যাঁকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে একটা গোটা জাতি লিখছিল অলিম্পিক্স সাফল্যের নতুন এক জয়গাথা, কয়েক ঘণ্টা পরে তিনিই চলে গেলেন পিছনের সারিতে। প্রায় বিস্মৃতিতে। নতুন বীর এসে গিয়েছে। নতুন বীরগাথা রচনায় ব্যস্ত পুরনো ভক্তকুল।
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! শুধুই বীরভোগ্যা। যে বীরত্ব নিরূপণ করে সাফল্যের দাঁড়িপাল্লা। শুধুই তুঙ্গ সাফল্য।
চারদিকের কোলাহল ছাপিয়ে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল যেন কোথাও। চারপাশে সহকর্মীদের ব্যস্ততা দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল ১৩ বছর আগের এক ভিনদেশি সকাল। সে-ও এক অগস্ট মাস। সে-ও এক অলিম্পিক্সের আসর। সে-ও এক সোনাজয়ীর আখ্যান। সে-ও এক চ্যাম্পিয়নের যাত্রা আপাত-অন্ধকারের দিকে।
চ্যাম্পিয়নের নাম কর্নেল রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠৌর। ডাবল ট্র্যাপ রাইফেল শ্যুটিংয়ে ২০০৪ সালের আথেন্স অলিম্পিক্সে রুপোজয়ী। স্বাধীন ভারতে তখনও পর্যন্ত সেটিই অলিম্পিক্সে ব্যক্তিগত ইভেন্টে ভারতের একমাত্র রৌপ্যপদক। ফলে ২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিক্সে তাঁর উপর বাজি ধরে বসে আছে গোটা দেশ। গোটা ভারত চায়, পদকের রং বদলাক। ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির প্রাক্তনী। স্মার্ট ফৌজি। ছমছমে চেহারা। যত্নে সাজানো সরু গোঁফ। ধারালো চোয়ালকে আরও ক্ষুরধার করেছে ক্লিন শেভন গাল। ব্যাপক স্মার্ট। আথেন্স এবং বেজিং মধ্যবর্তী চার বছরে পেজ থ্রি-তে নিয়মিত। রুপো থেকে তাঁর সোনায় উত্তরণ হবে কিনা, তা জানতে দম ধরে বসে আছে গোটা দেশ।
হল না। বেজিংয়ের আউটডোর শ্যুটিং রেঞ্জের গ্যালারি থেকে স্পষ্ট দেখা গেল, উড়ন্ত লক্ষ্যবস্তু ছুঁতে পারছে না কর্নেলের একের পর এক বুলেট। পদকের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাওয়ার পর রাইফেলটাকে দোভাঁজ করে কাঁধে নিয়ে যখন বেরোচ্ছেন, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ঘিরে ধরল হতাশ রাঠৌরকে— কেসটা কী হল? কেন পারলেন না? গোলমালটা কোথায় হল? শ্যুটিং রেঞ্জ থেকে বেরিয়েই গাছগাছালি ঘেরা একটা চমৎকার পথ। দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে সবে বলতে শুরু করেছিলেন রাঠৌর। নিঃশব্দে পিচঢালা রাস্তায় গড়িয়ে এল ঝকঝকে কালো সেডানটা। থামল কয়েক পা দূরে। তখনও মাথা গুঁজে রাঠৌরের কথার নোট নিচ্ছে ভারতীয় সাংবাদিককুল। হাঙরমুখো সেডানের পিছনের দরজা খুলে গেল। আরোহীর আসন থেকে নেমে এল একটা ছোটখাট চেহারা। হাঁটুঝুল কেপ্রি আর ইন্ডিয়ার জ্যাকেট। সাদা স্নিকার্স। গুটি গুটি পায়ে শ্যুটিং রেঞ্জের দিকে এগোচ্ছিল চেহারাটা। রাঠৌরকে ঘিরে-থাকা ভিড়টার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় কে একটা খেয়াল করল— আরে!
সেকেন্ডের ভগ্নাংশে একটা হিল্লোল উঠল। তার পর পড়িমড়ি করে জটলাটা দৌড় লাগাল ফুটফুটে চেহারার যুবকের দিকে। দ্রুত অপসৃয়মান ভিড়ের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন রাঠৌর। তার পর তদবধি অপরিচিত এবং হতবাক সাংবাদিককে দাঁড় করিয়ে রেখে ফিরতে শুরু করলেন। মাথা নীচু। কাঁধে তখনও ঝুলছে ডাবল ট্র্যাপ রাইফেল। শ্যুটিং রেঞ্জের গ্যালারির তলায় চেঞ্জিং রুমের অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাচ্ছিলেন ভারতীয় সেনার কর্নেল। ঢুকে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সম্ভবত অনবধানেই একবার থমকালেন তিনি। শরীরের সমকোণে দুটো হাত তুলে মাথার পিছনে রাখলেন। আঙুলে আঙুল জড়ানো। কয়েক লহমার বিরতি। বিধ্বস্ত চেহারাটা আবার চলতে শুরু করল অন্ধকারের দিকে। থমকে-যাওয়া বন্দুকবাজকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এ ভাবেই তো মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত যুদ্ধবন্দিরা দাঁড়ায় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। মনে হচ্ছিল, নিজের মস্তিষ্কে ব্যর্থতার অভিঘাত এতটাই প্রবল, যে মনে মনে এখানেই জীবন শেষ ভেবে উদ্যত বন্দুকের নলের সামনেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন!
কয়েক পা দূরে তখন অভিনব বিন্দ্রাকে ঘিরে থিকথিকে ভিড়। সেই ভিড় থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে দেশের ইতিহাসে অলিম্পিক্সে ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনা জেতার প্রথম আলো। সেই আলো গায়ে-মুখে-মাথায় মেখে নিতে ব্যস্ত ভারতীয় সাংবাদিকরা। তাঁরা ব্যস্ত সাফল্যের আগুনে পেশাগত জীবনকে গ্লোরিফাই করার রুটিটুকু সেঁকে নিতে। অটোগ্রাফের আব্দার, পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার আকুতি, সাক্ষাৎকারের দাবি। মূর্তিমান সাফল্য আর ধ্বস্ত ব্যর্থতার মধ্যবর্তী সাঁকোয় দাঁড়িয়ে পেশাদার সাংবাদিকের মনে হল, নতুন চ্যাম্পিয়ন এসে গিয়েছেন। ইলেকট্রিক চুল্লিতে উঠে গিয়েছে পুরোন সাফল্য। বেরিয়ে আসছে প্রাক্তনের ছাই।
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! শুধুই বীরভোগ্যা। যে বীরত্ব নিরূপণ করে সাফল্যের দাঁড়িপাল্লা। শুধুই তুঙ্গ সাফল্য।
১৩ বছর পরের এক অগস্ট মাস আরও একবার কান ধরে সেই শিক্ষা দিয়ে গেল। শিক্ষা দিয়ে গেলেন বজরং পুনিয়া। রাজ্যবর্ধন রাঠৌরের মতো ব্যর্থ হননি। অলিম্পিক্সে পদক জিতেছেন। পদক জয়ের লড়াইয়ে কাজাকিস্তানের প্রতিপক্ষকে, যাকে বলে, পুঁতে দিয়েছেন। কিন্তু সোনা পাননি। ফলে ঢাকা পড়ে গিয়েছেন নীরজের সাফল্যের আলোয়। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে পদক জিতেও বজরং পুনিয়া ‘অলসো র্যান’-এর দলে। নির্মম এবং নিষ্করুণ সাফল্যের দুনিয়া বজরং পুনিয়াদের ভুলে যেতে বেশি সময় নেয়নি। নেয় না। কারণ, তিনি জিতেছেন ব্রোঞ্জ। কাংস্যপদক। কাঁসা।
রোজ সকালে অফিসে আসার পথে উড়ালপুলের পাশে নজরে পড়ে পেল্লাই বিলবোর্ড। সেখান থেকে মুখ বাড়িয়েছেন এক যুবক। একমাত্র তিনিই। তাঁর পরনে ইন্ডিয়া জার্সি। ডান হাতে ঝকমক করছে সোনার পদক। তাঁর পাশে লেখা একটা সংখ্যা— ৮৭.৫৮। সাড়ে ৮৭ মিটারের কিছু বেশি। ততদূরেই জ্যাভলিন ছুড়েছিলেন নীরজ চোপড়া। ওই সংখ্যাটা দেশকে অলিম্পিক্সের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের ইতিহাসে প্রথম সোনা দিয়েছে। ওই সংখ্যাটাকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায়, আদর করতে চায় গোটা দেশ। ওই সংখ্যার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় এক কুস্তিগিরের সাফল্য। ঢাকা পড়ে যায় এই তথ্য যে, অলিম্পিক্সের এক মাস আগে ডান হাঁটুতে চোট পেয়েছিলেন তিনি। দেশ ভুলে যায়, অলিম্পিক্সের প্রথম লড়াইটা ডান হাঁটুতে স্ট্র্যাপ বেঁধে নেমেছিলেন তিনি। কিন্তু পদক জয়ের লড়াইয়ে আর পরেননি। কারণ, স্ট্র্যাপবদ্ধ হাঁটু তাঁর স্বাভাবিক নড়াচড়া এবং ক্ষিপ্রতা থেকে তাঁর দূরত্ব তৈরি করছিল। পা ভেঙে যেতে পারত। ঠিকই। কিন্তু কে পরোয়া করে! দেশে ফেরার পর বজরং পুনিয়া বলেছেন, ‘‘ফিজিয়ো বলেছিলেন স্ট্র্যাপ পরে নামতে। আমি শুনিনি। জানতাম, পা ভেঙে যেতে পারত। কিন্তু তার চেয়ে অলিম্পিক্সের মেডেল জেতাটা অনেক জরুরি ছিল। পা ভেঙে গেলে না হয় একটা অপারেশন করাতে হত। তার যন্ত্রণা অলিম্পিক্স পদক হারানোর চেয়ে কম!’’
কত অনায়াসে আড়ালে চলে গেল সেই বীরগাথা! অতিকায় বিলবোর্ডে ঠাঁই হল না বজরং পুনিয়ার। তিনি যে সোনার সওদাগর নন। ছুটকো কাঁসার ব্যাপারী।
প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় কোচ জন বুকানন বলতেন, ‘‘ওয়ান ক্যান নট উইন আ সিলভার। ওয়ান ক্যান ওনলি লুজ আ গোল্ড।’’ কেউ রুপো জেতে না। সোনা হারে। কথাটা পুরোন। বহুশ্রুত। বহুকথিতও বটে। কিন্তু এত সশব্দে কখনও কানে বাজেনি। যে ভাবে বাজল টোকিয়ো অলিম্পিক্সে বজরং পুনিয়াকে দেখে। মনে হল, সত্যিই তো, সাফল্য নায়ককেও চেনে না। চেনে শুধু মহানায়ককে। সে খেলার মাঠই হোক বা পরীক্ষার হল। তৃতীয় তো বটেই, দ্বিতীয়েরও কোনও জায়গা নেই। আমাদের চারপাশের ভোগবাদী সমাজ আর কনজিউমারিস্ট দুনিয়া তেমনই শেখায়। সেই দুনিয়া তুঙ্গ সাফল্য ছাড়া কিছু চেনে না। সেই দুনিয়া বজরং পুনিয়াদের ঠেলে ফেলে নীরজ চোপড়াদের জড়িয়ে ধরতে চোখের পলক ফেলে না। দ্বিধা করে না। কনজিউমারিস্ট দুনিয়া শেখায়, বীর সে-ই, যে প্রথম। সে দুনিয়া লড়াইয়ের গরিমা মানে না। চেষ্টার মর্যাদা দেয় না। পরিশ্রমের দাম দেয় না। প্যাশনের ধার ধারে না। আশাভঙ্গকে রেয়াত করে না। সে দুনিয়া কাব্য নয়, মহাকাব্য চায়। সে দুনিয়া সেই মহাকাব্যের মহানায়ক বাছে তুঙ্গ সাফল্যের নিরিখে।
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! শুধুই বীরভোগ্যা। যে বীরত্ব নিরূপণ করে সাফল্যের দাঁড়িপাল্লা। শুধুই তুঙ্গ সাফল্য।