Udaynidhi Stalin

নামভূমিকায়

নিজের রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বভারতীয় বিতর্কে ঢুকে পড়ছেন তামিলনাড়ুর রাজনীতির নতুন তারকা, মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের পুত্র উদয়নিধি স্ট্যালিন

Advertisement
শুভজিৎ বাগচী
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৪৪
উদয়নিধি স্ট্যালিন।

উদয়নিধি স্ট্যালিন। —ফাইল চিত্র।

বছর দুয়েক হল, তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে দ্রুত উত্থান হয়েছে এক নেতৃচরিত্রের। মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের পুত্র উদয়নিধি। তামিল ছবির সফল প্রযোজক ও সাবেক অভিনেতা তিনি। বয়স ৪৫। রাজনীতিতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য সরে গিয়েছেন ছবির জগৎ থেকে। এই বছরেই মুক্তি পাওয়া তাঁর সবচেয়ে সফল রাজনৈতিক থ্রিলার মাম্মানান মুক্তি পাওয়ার আগেই স্ট্যালিন পরিবারের বিনোদন সাম্রাজ্য স্ত্রী কিরুথিগার হাতে ছেড়ে দিয়ে উদয়নিধি ঘোষণা করেছেন ঠাকুরদা এম করুণানিধির দল দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাগাম (ডিএমকে)-এর পুরো সময়ের কর্মী হিসাবে কাজ করবেন। করুণানিধি ১৯৬৯ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত (২০১৮) ডিএমকের সভাপতি ছিলেন।

Advertisement

সক্রিয় রাজনীতিতে পা রেখেই ২০২১ সালে তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে উদয়ানিধি পূর্ব চেন্নাইয়ের চিপক-থিরুভাল্লিকেনি আসনে জিতেছিলেন। কিন্তু লক্ষ করার মতো, সে বার তিনি প্রচার করেন তামিলনাড়ু জুড়ে, অনেকটা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জনসংযোগ যাত্রা’র মতো। তামিলনাড়ুর পত্রপত্রিকায় লেখা হয় উদয়নিধির “আক্রমণাত্মক এবং অভিনব প্রচার ডিএমকের বিরাট সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ।”

তামিলনাড়ু বিধানসভার ২৩৪ আসনের মধ্যে ডিএমকে সে বার পেয়েছিল ১৩৩ এবং ডিএমকে নেতৃত্বাধীন জোট ১৫৯ আসন। দলের মধ্যেই সে বার আওয়াজ ওঠে উদয়নিধিকেই মন্ত্রী করতে হবে। সুতরাং প্রথম বার নির্বাচনে জিতেই বাবার ক্যাবিনেটে যুব ও ক্রীড়া উন্নয়ন মন্ত্রী হন উদয়নিধি। এম কে স্ট্যালিনের বয়স খুব একটা বেশি না হলেও, স্বাস্থ্যের কারণে (তিনি যে ভাল রকম অসুস্থ তা আর কোনও গোপন সংবাদ নয়) উদয়নিধির মুখ্যমন্ত্রী হওয়া তাই কেবল সময়ের অপেক্ষা।

এই নতুন তারকার বৈশিষ্ট্য— এর মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে গেল তামিল রাজনীতির এক নতুন ট্রেন্ড বা ধারা। করুণানিধির আমলেও, ডিএমকে-তে এক জন প্রভাবশালী স্থানীয় নেতার এমএলএ হতে গড়ে ১৫-২০ বছর লেগে যেত, মন্ত্রী হতে আরও বেশি। করুণানিধি মনে করতেন এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত, যে কারণে দলের সভাপতি হতে পুত্র স্ট্যালিনকে ৬৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। তবে ডিএমকের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ, তামিলনাড়ুতে পরিবারতন্ত্রের প্রবর্তক দ্রাবিড় রাজনীতির পুরোধা দলটি। তামিলনাড়ুর প্রায় সব শীর্ষ নেতা-নেত্রী— যেমন পেরিয়ার, আন্নাদুরাই, কামরাজ থেকে এম জি রামচন্দ্রন বা জয়ললিতা— হয় বিয়ে করেননি অথবা সন্তানহীন ছিলেন। ফলে, ব্যক্তিগত দুর্নীতি তাঁদের ছুঁতে পারেনি বলে মনে করা হয়। ফলে আগামী দিনে উদয়নিধির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ স্বচ্ছ সরকার পরিচালনা করা যা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ স্তরের রাজনীতিতে প্রায় একটা অসম্ভব কাজ।

তবে চ্যালেঞ্জ নিতে উদয়নিধি পিছপা হবেন এমন মনে হয় না। ফিল্ম জগতের প্রোডিউসার ছিলেন তিনি, ঝুঁকি নিতে জানেন। তাঁর প্রচারের ধরনটাও আক্রমণাত্মক। এমন সব কাজ তিনি মাঝেমধ্যেই করেন যা আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়ে যায়। যেমন তাঁর সাম্প্রতিক মন্তব্য— সনাতন ধর্ম বিষয়ে।

সেপ্টেম্বরের গোড়ায় তিনি বলেন, “ডেঙ্গি, মশা, ম্যালেরিয়া বা করোনা ভাইরাসের মতো সনাতন ধর্মকে তাড়াতে হবে, উৎখাত করতে হবে।” মন্তব্যের এমনই জোর যে যাদের অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেছেন তামিলনাড়ুর সেই সংগঠন সিপিআইএমের ‘প্রগ্রেসিভ রাইটারস অ্যান্ড আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্যান্য রাজ্যে এই মন্তব্যে উদয়নিধির পক্ষে সওয়াল করেননি।

তামিলনাড়ু এবং ভারতের অন্যান্য প্রান্তে সনাতন ধর্মকে এক চোখে দেখা হয় না। যদিও সর্বত্রই সনাতন ধর্মের আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা একই— হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন ধারার মধ্যে সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণব্যবস্থায় বিশ্বাসী একটি ধারা। এই ধারা সম্পূর্ণ সংস্কার বিমুখ। ব্রাহ্মণ সমাজের একেবারে উপরে থাকবেন এবং শূদ্ররা নীচে— মনুস্মৃতি-নির্ধারিত এই ফর্মুলা থেকে সরে আসেননি সনাতনিরা। তাই ধর্মের নাম সনাতন। কিন্তু ভারতের অন্যান্য প্রান্তে বিশেষত পূর্ব বা উত্তর ভারতে সনাতনকে অনেক সময় হিন্দু ধর্মের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। তামিলনাড়ুতে হয় না। এর কারণ তামিলনাড়ুতে যে ধরনের বর্ণ-বিরোধী আন্দোলন হয়েছে তা ভারতের অন্য প্রান্তে অত গভীরে যায়নি। বিশ শতকের গোড়ায় পেরিয়ার-পরিচালিত বর্ণ বিরোধী আন্দোলনের কারণে তামিলনাড়ুতে সাধারণ মানুষ এবং ভোটার ভাল রকম জানেন, সনাতন ধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণ ব্যবস্থার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। এই জন্যেই এখনও এ রাজ্যে বিজেপি বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।

উদয়নিধির মন্তব্যকে তামিলনাড়ুতে তাই স্বাগত জানানো হয়েছে— তেমন হইহই হয়নি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ ‘ইন্ডিয়া’ জোটের তাবড় দলকে এর বিরোধিতা করতে হয়েছে। এই বিরোধিতা যে অত্যন্ত জোরালো তা অবশ্য বুঝতে ডিএমকের দেরি হয়নি। উদয়নিধিকেও বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০২৪-এর জোটকে দুর্বল করা যাবে না তামিলনাড়ুর নির্দিষ্ট সামাজিক বিচারভিত্তিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে। বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েছেন উদয়নিধি।

রাজনীতির বুদ্ধি তাঁর আছে। উদয়নিধি ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন যে জোরালো নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা তিনি রাখেন। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে তিনি শিক্ষা নেবেন এমনটাও ধরে নেওয়া যেতে পারে, বিশেষত যখন সকলেই লক্ষ করছে তামিল রাজনীতিতে খুব ধীরে গতি বাড়াচ্ছে ডিএমকে-বিরোধী উত্তর ভারতের দল ভারতীয় জনতা পার্টি।

আরও পড়ুন
Advertisement