Books

সম্পাদক সমীপেষু: বইচোরের শাস্তি

বিদ্যালয়ের দেওয়াল আলমারি থেকে চোর নিয়ে গেছে নানা রকমের বই। অনেক আসবাবপত্র ও রান্নার সাজসরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও চোর কোনও কিছুতেই হাত দেয়নি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৩১

শুধুমাত্র উদরপূর্তির জন্য অন্ন সংস্থান যে মানুষের জীবনের একমাত্র উপকরণ নয়, তা আর এক বার প্রমাণ করে দিল ‘স্কুলের আলমারি থেকে বই নিয়ে গেল চোরে’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি (৬-৪)। পূর্ব বর্ধমানের গুসকরা শহরের উত্তরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেওয়াল আলমারি থেকে চোর নিয়ে গেছে নানা রকমের বই। অনেক আসবাবপত্র ও রান্নার সাজসরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও চোর কোনও কিছুতেই হাত দেয়নি।

জ্ঞান-সমুদ্রে সঞ্চিত বহুমূল্য রত্নরাজির আধার হল গ্রন্থ। জ্ঞানপিপাসু চোর চুরি করতে এসে পান্না, জহরত, হিরে কুড়িয়ে তার জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করতে চেয়েছে। পেটের খিদের চেয়েও তার কাছে মনের খিদে প্রাধান্য পেয়েছে। চোরের এমন কাণ্ড দেখে অনেকে তাজ্জব হলেও আমি তাৎপর্য বিশ্লেষণে সচেষ্ট। কারণ, আধুনিক প্রযুক্তির দাপটে কালো অক্ষরের গ্রন্থের মূল্য যে আজ তলানিতে ঠেকেছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বইয়ের জগৎটাই আজ লুপ্তপ্রায়। স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য থেকে এটাও জানতে পারলাম যে, চোর যে বইগুলো নিয়ে গিয়েছে, তার মধ্যে আছে ক্ষীরের পুতুল, আম আঁটির ভেঁপু, পথের পাঁচালী, টুনটুনির বই, গুপী গাইন বাঘা বাইন, শরৎ রচনাবলী, পাগলা দাশু, ঠাকুরমার ঝুলি। এই চোরকে সবাই তিরস্কারই করবে জানি, কিন্তু যাঁরা পুস্তকপ্রেমী, তাঁরা এমন আদর্শবাদী, শৃঙ্খলাপরায়ণ, সুচিন্তাধারী গ্রন্থনির্বাচক চোরের প্রশংসা না করে থাকতে পারবেন না।

Advertisement

আর বইগুলো চুরি করে সে যে বিক্রি করতে পারবে না, তার অনেক প্রমাণ আছে। স্কুল গ্রন্থাগারের বইয়ে‌ সিলমোহর‌ লাগানো থাকে। সুতরাং বিক্রি করতে গেলেই চোর‌ ধরা পড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত সে স্কুলের কোনও দামি জিনিস চুরি হয়নি। ভবিষ্যতে টাকার অভাবে কেউ বই কিনে পড়তে না পারলে তার চোখে যদি বড়লোকের ঘরের শোভাবর্ধনকারী কাচের আলমারি ভর্তি বইয়ের উপর নজর পড়ে যায়, তাকে লঘু অপরাধ বলে বিবেচনা করা যায় না কি?

নিতাইপদ মণ্ডল
কলকাতা-১৫২

আলমারি-বন্দি
‘স্কুলের আলমারি থেকে বই নিয়ে গেল চোরে’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে যারপরনাই আশ্চর্য বোধ করলাম। কিঞ্চিৎ পুলকও জাগল মনে। এটাও কি সম্ভব! আমি মফস্সলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ দুই দশক প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যুক্ত। আমার বিদ্যালয়েরও অফিসঘরে এক আলমারি ভর্তি বই আছে। নতুন বইগুলো আসার পর ছাত্রছাত্রীদের দিয়েছিলাম পড়তে।

ছবিওয়ালা রঙিন বইগুলো কিছু ক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে তারা ছুটল মিড-ডে মিল খেতে কিংবা খেলার মাঠে। অপর সহকর্মীরাও টেবিলে পড়ে থাকা শিশু সাহিত্যের বইগুলো নিয়ে তেমন কোনও উৎসাহ দেখালেন না। অগত্যা আলমারি-বন্দি হল বইগুলো। কিশোরী বয়সে যে বইগুলো পড়ে আনন্দ পেতাম, তা দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই আলমারিতে তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি।

আমিও পঠনপাঠন ও স্কুলের নানান প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকায় ইচ্ছে থাকলেও আলমারি খুলে ঠাকুরমার ঝুলি বা ঠাকুরদার থলে-র মতো রূপকথার বই খুলে বসতে সময় ও সুযোগ পাইনি। তাই তালাবন্ধ বইয়ের আলমারি কেবল স্কুলের অফিস ঘরের শোভাবর্ধক হয়েই পড়ে আছে। কোনও দিন মনে আশঙ্কা হয়নি যে, বইগুলো কখনও চুরি হতে পারে। এখন দেখি ছাত্রছাত্রীরা কেবল পাঠ্যবইয়ের পড়া মুখস্থ করতে বা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেই সারা ক্ষণ ব্যস্ত থাকে। যেটুকু অবসর পায়, তা মোবাইলে গেম খেলতে বা টিভিতে কার্টুন দেখতেই কেটে যায়। বয়স্কদেরও দৈনিক সংবাদপত্রের বাইরে আলাদা করে শখের বই পড়তে তেমন দেখা যায় না।
এ-হেন পরিবেশে বাস করে স্কুলের আলমারি থেকে রাতের অন্ধকারে বই চুরির ঘটনাটি বিচিত্র খবর বলেই মনে হল। আলমারিতে বন্ধ থাকার বদলে যদি চোরেও বইগুলো পড়ে, তা হলে অন্তত বইগুলোর যথার্থ সদ্গতি হয়।

সুদীপ্তা চিনা
মুন্সিরহাট, হাওড়া

পুস্তকপ্রেমী
‘স্কুলের আলমারি থেকে বই নিয়ে গেল চোরে’ শীর্ষক খবরটি সম্পর্কে কিছু কথা নিবেদন করতে চাই। যে হেতু এটি পুকুর চুরির ঘটনা নয়; ছোটখাটো ছিঁচকে চোর কাণ্ডটি ঘটিয়েছে, তাই রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন শীঘ্রই চোরের হদিস পেয়ে যাবে। জানি না, এর পর বইচোর গ্রেফতার হয়ে জেল হেফাজতে যাওয়ার নির্দেশ পাবেন কি না! কিন্তু ঘটনাটি থেকে যে ইতিবাচক বার্তা গ্রহণ করা যায় তা হল, এই ‘পিছিয়ে পড়া’ সমাজে বই পড়ার মানুষের খুব একটা অভাব নেই। যে পুস্তক পাঠকটি বই ‘চুরি’ করতে বিদ্যালয়ে এসেছিলেন, তিনি যে প্রকৃত অর্থেই চোর নন তার বড় প্রমাণ, কিছু বইয়ের সঙ্গে প্রয়োজনীয় একটিমাত্র সিলিং ফ্যান ছাড়া তিনি আর কোনও দ্রব্যে হাত দেননি।

আমরা চাই, সংশ্লিষ্ট ‘চোর’ অবিলম্বে ধরা পড়ুক এবং তাঁকে মুক্তি দেওয়ার আগে পুলিশ ও জনতার পক্ষ থেকে এই ‘চুরি’র জন্য বই দিয়ে পুরস্কৃত করা হোক। প্রসঙ্গত, এ-হেন ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যাঁরা প্রকৃত পুস্তকপ্রেমী, বই পড়ার সামর্থ্য তাঁদের অনেকেরই নেই। আর যাঁরা আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল, তাঁদের মধ্যে কত জন সংগৃহীত বইগুলির সদ্ব্যবহার করেন, সন্দেহ থেকেই যায়।

শক্তিশঙ্কর সামন্ত
ধাড়সা, হাওড়া

নীল-সাদা
পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত সরকারি বিদ্যালয়ে একই রকম নীল-সাদা পোশাক চালু করার যে উদ্যোগ করা হচ্ছে বলে খবর, সেই প্রসঙ্গে দু’একটি কথা। শুরুতে বানান নিয়ে একটি মজার কাহিনি বলি। গরু বানান ‘গোরু’ করা হবে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরদাতা বলেন, ওতে গরুর কলেবর বৃদ্ধি হলেও দুধের পরিমাণ কিঞ্চিৎ পরিমাণও বাড়বে না। সমস্ত বিদ্যালয়ে একই রকম স্কুল ইউনিফর্ম চালু করার বিষয়টিও খানিকটা এমন। উদ্যোগটি অভিনব, কিন্তু আখেরে শিক্ষার কিছু লাভ হবে না। উপরন্তু দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এক-একটি বিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী স্কুল ইউনিফর্মের প্রতীকটি নষ্ট হবে। আমরা অনেকেই রাস্তাঘাটে স্কুল ইউনিফর্ম পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের দেখে খুব সহজেই বুঝতে পারি কোন স্কুলের শিক্ষার্থী। বহু বছর আগে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়া মানুষ নবীন বিদ্যার্থীদের গায়ে একই রকম ইউনিফর্ম দেখে স্মৃতিচারণ করেন তাঁদের ছেলেবেলা কিংবা মেয়েবেলার।

শোনা যাচ্ছে, পোশাকের রং হবে নীল-সাদা। এ কথা এখন সর্বজনবিদিত যে, বর্তমান সরকারের পছন্দের রং নীল-সাদা। হয়তো বিদ্যালয়ের পোশাকে এই দু’টি রঙের সহাবস্থান ভালই লাগবে। কিন্তু কত দিন? সমাজ আর সরকার দুটোই পরিবর্তনশীল। তাই এ কথা খুব সহজেই অনুমেয় যে, সুদূর ভবিষ্যতে যদি কোনও নতুন রাজনৈতিক দলের সরকার স্থাপিত হয়, তারা কি এই নীল-সাদার তুলির আঁচড় বহন করবে? অন্য কোনও সরকার যে এই রঙের পোশাক পছন্দ করবে না, সেটা বলার জন্য কোনও গবেষণার দরকার নেই। ঠিক যে ভাবে বর্তমান সরকার পূর্বতন সরকারের যত্রতত্র রেড কার্পেট বা লাল রঙের ছোঁয়া মুছে দিয়েছে সচেতন ভাবে।

তা হলে ঘটনা কী দাঁড়াল? এই নতুন সরকারি উদ্যোগের ফলে একটি বিদ্যালয়ের নিজস্ব ইউনিফর্মের ঐতিহ্য নষ্ট হল। কিন্তু তার পরিবর্তে পাওয়া গেল না কোনও নতুন ঐতিহ্যের চিরস্থায়ী রূপ! তাই মনে হয়, পোশাকের বিষয়টি বিদ্যালয়ের হাতেই থাকুক। বিগত প্রায় দু’বছর করোনা সংক্রমণের কারণে বিদ্যালয়-শিক্ষা এমনিতেই খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই খামতি দূর করতে বরং উঠে আসুক অভিনব গঠনমূলক উদ্যোগ। শুধুমাত্র ‘শিখন সেতু’র উপর হেঁটে শিক্ষার প্রবহমান নদী পার হওয়া যাবে না।

বিভাস চন্দ
মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

আরও পড়ুন
Advertisement