“শিক্ষকদের আবার ‘ছুটি কিসের’”(১৪-১) শীর্ষক ঈশা দাশগুপ্তের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে লেখিকার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করি। এ বিষয়ে কিছু বক্তব্য রাখতে চাই। প্রাচীন ভারতে শিক্ষার অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সান্নিধ্যে গুরুর জ্ঞান এবং অনুপ্রেরণায় শিক্ষার্থীর মননশক্তির উন্মেষ। বর্তমান অতিমারির আবহে দীর্ঘ প্রায় দু’বছর যাবৎ বন্ধ রয়েছে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে যান্ত্রিক সান্নিধ্যই এখন শিক্ষালাভের একমাত্র উপায়। এই ‘নিউ নর্মাল’ পরিস্থিতিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কেউই আজ ভাল নেই। কিন্তু সমাজের তথাকথিত কিছু ‘কর্মযোগী’ মানুষ এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকেই শিক্ষকদের অফুরন্ত ছুটির তালিকাভুক্ত করে এক ধরনের ঈর্ষাজনিত আনন্দ উপভোগ করেন। তাঁরা এটা ভুলে যান যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও, শিক্ষাদান কিন্তু বন্ধ হয়নি। অপরিচিত ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিজেদের এক প্রকার জোর করে অভ্যস্ত করে শিক্ষকগণ পাঠদান, মূল্যায়ন প্রভৃতি কাজ করে চলেছেন নীরবে। শুধু তা-ই নয়, অতিমারি উপেক্ষা করে, লোকাল ট্রেন, বাসের অনিশ্চিত চলাচলের তোয়াক্কা না করে, জীবনের ঝুঁকিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাসস্থান থেকে দূরবর্তী কর্মস্থলে প্রায়শই এই শিক্ষকদের ছুটতে হচ্ছে ছাত্রসমাজের কাছে নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার তাগিদে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান করাই যাঁদের একমাত্র কর্তব্য, তাঁরাই মাস্কহীন, করোনাবিধিকে মান্যতা দিতে নারাজ বেপরোয়া মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে কখনও মিড-ডে মিল বিতরণ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য মাইকে প্রচার বা পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক নাবালিকা ছাত্রীর বিবাহ বন্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণে কখনওই পিছপা হন না।
শিক্ষকদের ‘আলস্যভোগী’, ‘ছুটিপ্রিয়’ ইত্যাদি অশ্রদ্ধাজনিত বিশেষণে বিশেষিত করে যাঁরা আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন, ভবিষ্যতে এই শব্দগুলি বুমেরাং হয়ে আবার তাঁদের দিকে ফিরে আসবে কি না, সে বিষয়ে তাঁদের একটু সচেতন হতে অনুরোধ করব। শুধু ৫ সেপ্টেম্বরই নয়, বছরের প্রতিটি দিনই শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য অভিভাবকদের উচিত বাড়ির ছোট সদস্যদের নীতিশিক্ষা প্রদান করা।
স্বাতী চট্টোপাধ্যায়, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
বিকল্প পদ্ধতি
“শিক্ষকদের আবার ‘ছুটি কিসের’” প্রবন্ধটি সময়োপযোগী। কিন্তু, এতে একটি তথ্যগত ভুল আছে। রাজ্যের মুখ্যসচিবের ২ জানুয়ারির আদেশনামায় সর্বস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সব ধরনের অ্যাকাডেমিক কার্যকলাপ বন্ধ’ রাখা ও ৫০ শতাংশ কর্মী নিয়ে প্রশাসনিক কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। অনলাইন শিক্ষা বা পরীক্ষার কোনও উল্লেখ ছিল না। বরং, পরের দিন রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের লেখা উচ্চশিক্ষা দফতরের প্রধান সচিবের চিঠিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাঙ্গনে পঠনপাঠন বন্ধ রেখে ‘বিকল্প পদ্ধতি’-তে শিক্ষাদানের কথা বলে হয়েছে। এই দু’টি সরকারি নির্দেশিকার কোথাও প্রবন্ধকার-উল্লিখিত ‘ব্লেন্ডেড পদ্ধতি’-র নামগন্ধ নেই। বাস্তবে তা হয়ে থাকলে স্থানীয় ভাবেই হয়েছে। এটুকু বাদ দিলে প্রবন্ধের মূল সুরের সঙ্গে এই পত্রলেখক একমত।
এই অতিমারিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ক্ষেত্রগুলির একটি যদি হয় কর্মসংস্থান ও রোজগার, তবে অপরটি নিঃসন্দেহে শিক্ষা। প্রবন্ধকার যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষকরা কাজ না করলে নানা সরকারি প্রকল্পের কাজ শিক্ষালয়ে জারি আছে কী করে? অথচ, শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের মূল কাজ পঠনপাঠন ইতিমধ্যেই বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত। কেউ দাবি করতেই পারেন, অনলাইনে তো ঘরে বসেই, যাতায়াতের শ্রম ও খরচ বাঁচিয়ে, দূরদূরান্তে পাঠ বিতরণ ও গ্রহণ করা যায়। কিন্তু, এই ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত অসুবিধা ও ব্যয়সাধ্যতার কথা যদি ছেড়েও দিই, তা হলেও শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীদের মধ্যে থেকে পাঠগ্রহণ এক জন শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে কতটা জরুরি, তা উপেক্ষা করা যায় কি? বিভিন্ন সমীক্ষা অনুসারে দীর্ঘ দিন বিদ্যালয়-ছুট থাকলে কমবয়সিরা অক্ষর পরিচয়, গণিতের প্রাথমিক পাঠ ভুলতে থাকে। উচ্চশিক্ষাতেও ছবিটা হতাশাজনক। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার উভমুখী বিনিময়কে কি প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়? উন্নত দেশগুলিতে কি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান উঠে গিয়েছে?
অনলাইন ব্যবস্থার অন্যতম শিকার স্বচ্ছ পরীক্ষাব্যবস্থা। রাজ্য সরকারের ঘোষণার প্রায় মাসখানেক আগেই অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়ে ফেলেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। এক দল অসাধু শিক্ষাব্যবসায়ী ও ছদ্ম-ছাত্রদরদির হাতে পড়ে ‘দুয়ারে নম্বর’-এর এই খেলা আদতে উদ্যমী শিক্ষার্থীদের জন্য এক বড় সর্বনাশ। বেতন-তুষ্ট শিক্ষকরাও তার দায় পুরো ঝেড়ে ফেলতে পারেন কি?
কোভিড-১৯-এর প্রাথমিক ধাক্কা আমাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছিল। কিন্তু, দু’বছর পরেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাই কি সব সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে? আশঙ্কা, এ ভাবে চললে এক দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক পদটি অবান্তর হয়ে পড়বে এবং শিক্ষক নিয়োগ, নতুন পদসৃষ্টি, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার ইত্যাদি খাতে অনুদান কমে যাবে। নানা অনলাইন অ্যাপের প্রচার তারই ইঙ্গিতবাহী। সরকারি স্তরে ‘বিকল্প পদ্ধতি’র কথা ভাসিয়ে দেওয়া হলেও সেটি কী হতে পারে, তা নিয়ে কোনও সুষ্ঠু পরিকল্পনা আছে কি? শিক্ষালয়ের ‘প্রশাসনিক কাজ’ তো শুধু সরকারি প্রকল্পের প্রচার ও বিপণনেই সীমাবদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে রেখে পঠনপাঠন ও পরীক্ষাব্যবস্থা সচল রাখাই সঙ্কটমুক্তির একমাত্র উপায়।
সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান
উদ্যোগ চাই
ঈশা দাশগুপ্তের প্রবন্ধটি পড়ে কিছু প্রশ্ন মনে এল। এ কথা ঠিক যে, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তাঁরা তিন-তিনটে লকডাউনে ছুটি কাটিয়েছেন মাসের পর মাস মাইনে নিয়ে। এ নিয়ে রসিকতাও চালু হয়েছে। প্রবন্ধকার অভিযোগ তুলেছেন, অন্য সরকারি কর্মচারীদের বাদ দিয়ে শুধু মাইনে নিয়ে শিক্ষকদের চক্ষুশূল হতে হচ্ছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন, দু’বছর কাজের উপস্থিতি কাদের বেশি ছিল? শিক্ষকদের না অন্যদের? অন্য কর্মচারীদের মধ্যে ধরতে হবে পুলিশ, স্বাস্থ্যকর্মী, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত ব্যক্তি, জরুরি পরিবেশক, অতিমারির সঙ্গে পরোক্ষ ভাবে যুক্ত আরও বহু কর্মী, যার মধ্যে অনেকের মাস মাইনে শিক্ষকদের থেকে কম। তা ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে শিক্ষক বাদে কোন কর্মী মাসখানেকের গরমের ছুটি, দীর্ঘ পুজোর ছুটি, ক্যালেন্ডার বহির্ভূত ছুটি উপভোগ করেন? এগুলো প্রবন্ধকার খেয়াল করলে ‘চক্ষুশূল’ কথাটার উত্তর পেয়ে যেতেন।
বলা হয়েছে, সরকারি নির্দেশে অনলাইন ক্লাস নিতে হচ্ছে এবং তার জন্যে কত কষ্ট করে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে শিক্ষকদের। ভাবতে অবাক লাগে শিক্ষকরা কি শুধু মান্ধাতার আমলের শিক্ষা পদ্ধতিতেই আটকে থাকবেন? পৃথিবীর যে কোনও কর্মস্থলে নতুন পদ্ধতি/ প্রযুক্তি চালু হলে তাতে প্রশিক্ষিত হতেই হয়, এটাই বাস্তব। ঢাল তরোয়াল চালানো না শিখে যুদ্ধে যাওয়া তো আত্মহত্যার সমান। এতে শিক্ষকের অযোগ্যতার দিকেই আঙুল তুললেন না কি প্রবন্ধকার?
পাশাপাশি ‘করোনা বিধি মেনে শিক্ষক নামতা পড়ালেন গাছতলায়’ (৭-১) সংবাদে ইন্দ্রনীলবাবুর মতো শিক্ষকের উদ্যোগ ক’জন শিক্ষক নিয়েছেন? এঁদের মতো প্রকৃত শিক্ষকরাই শিক্ষার মর্ম বোঝেন, প্রাপ্য মূল্যের মূল্যায়ন করতে জানেন। কোনও অনুযোগ, অভিযোগ ছাড়াই নিজের চেষ্টায় শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন। এই অতিমারিতে কয়েক জন শিক্ষকের এই ধরনের উদ্যোগের জন্যই ছাত্রছাত্রীরা ভীষণ ভাবে উপকৃত হয়েছে। অন্যরাও এ ভাবে শিক্ষার প্রসারে সচেষ্ট হলে আজ শিক্ষার হাল এ রকম হত না।
আলী হোসেন খান, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা