Bangladesh Protest

সম্পাদক সমীপেষু: ক্ষোভের ভিত্তি

সংরক্ষণ-বিরোধী হিংসায় তিন সপ্তাহে তিন শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মূল কারণ ছিল একটি গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের স্বৈরশাসক হয়ে ওঠা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২৪ ০৫:৪৩

সেমন্তী ঘোষের লেখা উত্তর সম্পাদকীয় ‘আশঙ্কাটাও কিন্তু থাকল’ (১৪-৮) প্রসঙ্গে কিছু কথা। যদিও প্রাথমিক ভাবে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে সংরক্ষণ-বিরোধী আন্দোলন থেকে সৃষ্ট ক্ষোভ, কিন্তু এই ক্ষোভের ভিত্তি রচিত হয়েছিল সাত মাস আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অনিয়মের পর। সংরক্ষণ-বিরোধী হিংসায় তিন সপ্তাহে তিন শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মূল কারণ ছিল একটি গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের স্বৈরশাসক হয়ে ওঠা। শেখ হাসিনা জনরোষকে হালকা ভাবে নিয়েছিলেন। যার ফলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল যে, তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে খেলা হচ্ছে। যদিও পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এই ক্ষোভকে নিজেদের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি করতে ব্যবহার করেছিল, অনেক বিদেশি শক্তিও এই সঙ্কটকে উস্কে দিতে পিছিয়ে থাকেনি। বস্তুত, মাত্র সাত মাস আগে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে দেশে জনরোষ বাড়তে থাকে। দক্ষিণপন্থী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল সাধারণ নির্বাচন বর্জন করেছিল। তারা জনগণের কাছে বার্তা দিতে পেরেছে যে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। যা শেখ হাসিনার বিজয়কে কলঙ্কিত করেছে, বিশ্বেও ভাল বার্তা দেয়নি। সে কারণেই সম্প্রতি শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য ভারত ও চিন সফর করেছিলেন।

Advertisement

কিন্তু নিজের দেশের ক্রমবর্ধমান বিস্ফোরক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে সক্ষম হননি। সংরক্ষণ-বিরোধী আন্দোলনের দমন এই পরিস্থিতিতে ইন্ধন যোগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি পর্যন্ত ভেঙে ফেলার ঘটনা থেকে জনগণের ক্ষোভের তীব্রতা অনুমান করা যায়। এই আন্দোলন শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের বিক্ষোভ স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে রাজাপক্ষে ভাইদের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে, এবং বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।

সাধনা রায়, জামশেদপুর

সন্ধিক্ষণে

সেমন্তী ঘোষের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু সংযোজন করতে চাই। বাস্তবিক অর্থেই এখন তাৎপর্যপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। জুলাই-অগস্টে বাংলাদেশের মাটিতে হাসিনা সরকারের নাম-কা-ওয়াস্তে ‘গণতন্ত্র’ চালিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে যে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেল, তা আকস্মিক নয়। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোট নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা ভাবে। কারচুপির ছবিগুলো কোনও ভাবে আড়াল করা যায়নি। আন্দোলনের প্রত্যুত্তরে সরকারের নিষ্ঠুরতম রাষ্ট্রীয় হিংসা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের ছাত্রবিপ্লব দমনের ছবিটা হাসিনার চোখে ভেসেছিল কি? তবে বাংলাদেশের এই গণঅভ্যুত্থানে কোনও নতুন ইতিহাস তৈরি হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা, উদ্বেগ রয়েই গেল। নতুন আন্দোলনে ঢুকে পড়ল রক্ষণশীল রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গ। ইসলামি মৌলবাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে ভারত বিরোধিতা।

বাংলাদেশে যত্রতত্র ভারত-বিরোধী মনোভাব কেন মাথা তুলছে, ভারতের তা অজানা নয়। স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে বাংলাদেশে সত্তরটিরও বেশি বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছিল। এত সাহায্য, এত দ্বিপাক্ষিক সফর, এত উন্নয়ন সত্ত্বেও বিরোধিতার বহর কেন দিন দিন বেড়েই চলেছে, তা গভীর ভাবে অনুধাবন করতে হবে। নেপাল, মলদ্বীপেও এমনই হচ্ছে। তা হলে কি ধরে নিতে হবে ভারতের বিদেশনীতি এবং তার রূপায়ণে কোথাও ভুল হচ্ছে?

মাটিতে দাঁড়িয়ে ঘ্রাণ না-নিলে বাস্তবের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায় না। ভারতীয় নেতৃত্বকে মাটিতে নেমে আসতে হবে। সন্দেহ নেই, শেখ হাসিনা ছিলেন ভারতের স্বীকৃত ও পরীক্ষিত বন্ধু। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে তাঁর অবস্থান দৃঢ় থাকা ভারত এখনও জরুরি মনে করে। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের দেশে শাসককে জনপ্রিয়ও থাকতে হবে— যেটা সহজ নয়। দুই ক্ষেত্রেই ভারতের করণীয় অনেক কিছুই। সেই দায়িত্ব থেকে মুখ ফেরালে সঙ্কটে পড়বে দু’টি দেশই।

শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া

তবুও স্বপ্ন

‘আশঙ্কাটাও কিন্তু থাকল’ প্রবন্ধে লেখক বাংলাদেশের গণআন্দোলন ও সরকারের পতনের প্রেক্ষিতে আশা ও আশঙ্কার কথা সুস্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মৌলবাদের অপশক্তি আমাদের দেশেরও চরম ক্ষতি করতে পারে, এ বিষয়ে প্রবন্ধকার সতর্ক করে দিয়েছেন— তা সে কেন্দ্রের দলের হিন্দু মৌলবাদ হোক, বা রাজ্যের দলের ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে ইসলামি মৌলবাদের ভয়াবহতাকে মেনে নেওয়া হোক। বাংলাদেশের ছাত্র-আন্দোলনের একটা গৌরবময় ঐতিহ্য আছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বা এখনকার শেখ হাসিনার সরকারের পতনে তাদেরই মুখ্য ভূমিকা ছিল। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আরও কিছু মৌলবাদী শক্তি, সঙ্গে কিছু স্বার্থপর মানুষ যারা সে দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের তাড়িয়ে সম্পত্তি দখল করতে চায়, এরা বরাবরই সক্রিয় ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশবাসীর স্বাধীন হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই এরা ‘রাজাকার’ নামে গোষ্ঠী তৈরি করে পাকিস্তানি সেনাকে দেশের মানুষ খুন করতে সাহায্য করে।

প্রবন্ধকার ১৯৭৫-এ বিএনপি মদতে পুষ্ট সেনা অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের লোকেদের হত্যার ভয়াবহতার কথা লিখেছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে সেনা তত্ত্বাবধানে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার চলাকালীনও যে ভাবে পুলিশ খুন, শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙচুর, বেগম রোকেয়ার ছবিকে কালিমালিপ্ত করে নোংরা ভাষা লিখে দেওয়া, শতাব্দীপ্রাচীন লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেওয়া, ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি চুরমার করা, আরও অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ধ্বংস ও অগ্নিসংযোগ করা, সংখ্যালঘু হিন্দুদের মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া ও তাদের ঘরদুয়ার ভেঙে ফেলে লুটপাট চালানো ইত্যাদি অবাধে ঘটছে বলে অভিযোগ উঠছে, তখন ভয় হয় দেশটা তালিবান-শাসিত আফগানিস্তানের মতো হয়ে যাবে না তো?

তবুও ভরসা করি ওই নবীন প্রজন্মের ছাত্রদের উপরে, যারা কালিগুলো ধুয়ে ফেলছে, হাতে হাত রেখে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। সংখ্যালঘু হিন্দুরাও দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে, হাজারে হাজারে জমায়েত করছে, আওয়াজ তুলছে দেশটা তাদেরও জন্মভূমি। এ-পার বাংলায় শিকড়ের টানে আমরা উদ্বিগ্ন হই, ওখানেই আমাদের পিতা-পিতামহের চরণধূলি ছিল। বর্তমান ইন্টারনেট-এর যুগে সমাজমাধ্যমে বাংলাদেশের অনেক মুক্তমনা, শুভমনস্ক মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। তাঁরা আশ্বাস দেন যে, তাঁদের বাংলাদেশ কখনও গোঁড়া ইসলামপন্থীদের কবলে যাবে না।

শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

চিঁড়ে-কলা

জাত-যন্ত্রণা (২৩-৮) খুবই যথাযথ ও যুক্তিপূর্ণ ভাবে ভারতে জাতপাতের সমস্যাটি তুলে ধরেছে। জাতপাতের এমন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপ-রূপান্তর পৃথিবীর আর কোনও দেশে এমন ভাবে ছেয়ে আছে কি না, জানা নেই। আমাদের দেশে, কিছু বিশেষ বিশেষ রাজ্যে তা খুবই জটিল ও সমস্যাবহুল। বাংলাতেও যে ছিল না এমন নয়। আমার জীবনেরই একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন স্কুলে পড়ি, একটি বন্ধু ছিল, তার পদবি সর্দার। তার সঙ্গে ওদের বাড়িতে গেছি এক দিন, বন্ধু দাওয়ায় ওঠার আগে তার মাকে বলল, “মা, তিন থাল ভাত বাড়ো দিনি!” ওর মা আমায় দেখলেন, তার পর ওকে ডেকে কিছু বললেন। পরে খেতে বসার সময় দেখি, ওরা মা-ছেলে ভাতের সঙ্গে চুনো মাছের ঝোল-ঝাল নিয়ে চাটাই পেতে মাটিতে বসল। আর আমার জন্য বাটিতে কাঁচা চিঁড়ে, ঘটিতে জল, এক জোড়া পাকা কলা, আখের গুড়। আমি হতভম্ব। বন্ধুর মা আমাকে একটু দূর থেকেই চিঁড়ে ভেজানোর কথা বলতে লাগলেন, ওরা ঢেঁকিছাঁটা লাল চালের ভাত ঝোল দিয়ে খেতে থাকল।

বিকাশ মুখোপাধ্যায়,কলকাতা-৫০

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement