rape

সম্পাদক সমীপেষু: নৈরাজ্যের নাট্যশালা

সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করতে প্রত্যক্ষদর্শীকেও খুন করার ঘটনা এখন জলভাত। সর্বত্রই এখন এই সব ‘ছোট ঘটনা’র বহ্ন্যুৎসব।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২২ ০৪:২০

সম্পাদকীয় ‘ভস্মীভূত’ এবং অনিতা অগ্নিহোত্রী লিখিত “আমাদের ‘বালিকা বিদায়’” (১৩-৪) শীর্ষক প্রবন্ধ পশ্চিমবঙ্গের নৈরাজ্য প্রকট করল। বিধিভঙ্গের নাট্যশালায় ধর্ষণ-খুন-তোলাবাজির কুনাট্য নিত্য অভিনীত হচ্ছে। সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করতে প্রত্যক্ষদর্শীকেও খুন করার ঘটনা এখন জলভাত। সর্বত্রই এখন এই সব ‘ছোট ঘটনা’র বহ্ন্যুৎসব। গণধর্ষিতারা লজ্জায়, ভয়ে, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অভিযোগ জানানোর পূর্বেই নিহত হচ্ছেন। ধারের টাকা মেটানোর ক্ষমতা না থাকায় নাবালিকা মেয়েকেই এগিয়ে দিচ্ছেন বাবা। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যখন ধর্ষিতার চরিত্রদোষ খোঁজেন, তখন তার যন্ত্রণাময় ভয়াবহ মৃত্যু কি ‘বর্তমান সরকারের প্রকৃত চরিত্রটি উদ্‌ঘাটন’ করে না? সম্পাদকীয়তে উত্থাপিত এই প্রশ্ন এখন সচেতন নাগরিক সমাজের। ব্যতিক্রম বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা সত্যিই “দ্যূতসভার রাজন্যবর্গের মতো মূক থাকবেন, পাছে সমালোচনায় বিরুদ্ধ দলের হাত শক্ত হয়ে ওঠে।” আমরা বিস্মৃত হচ্ছি ‘ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’-এর ৪৩তম সংশোধন— “যৌন সম্পর্কে সম্মতির প্রশ্নে আক্রান্ত মেয়েটির বিবৃতিই তদন্তের জন্য যথেষ্ট, অন্য কোনও প্রমাণ দরকার নেই।” এই সংশোধনীটি সম্পর্কে প্রতিটি থানা, পুলিশ-প্রশাসন এবং আইনজীবীরা অবহিত তো? মুখ্যমন্ত্রী নিজে কি আইনি পরিবর্তন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? ‘এগিয়ে বাংলা’ স্লোগান শুনছি, কিন্তু রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় অতিমারি-অতিক্রান্ত সময়ে স্কুলছুট, বাল্যবিবাহ, অপরিণত মাতৃত্ব, অপুষ্টি বেড়েই চলেছে। টাকার লোভে কন্যাসন্তানকে বিক্রির ঘটনাও বিরল নয়। অতঃপর সেই মেয়েটির ঠাঁই কোথায় হল, দেহব্যবসায় নামানো হল কি না, কতটুকু তথ্যপ্রমাণ মেলে?

তবে ‘পেশিশক্তির পুরুষতন্ত্র’ অভিধায় পুরো পুরুষসমাজকে দেগে দেওয়া অন্যায়। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সুরক্ষিত অবৈধ কাজকারবার-চালানো একটি নির্দিষ্ট অংশ যাবতীয় অপকর্মের জন্য দায়ী। অপরাধ চিহ্নিত হওয়ার পর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানই ‘পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে যাওয়ার লজ্জা’ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ। অপর দিকে, এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়েও বাংলার সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষজন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাসে, ভিড়ের ট্রেনে যাতায়াত করে ‘কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রুজির লড়াই’ করতে নিত্য দিন বেরোচ্ছেন, এটাও ছাইচাপা শ্মশানের নীচে জেগে থাকা আগুনের জ্বলন্ত ছবি।

Advertisement

ধ্রুবজ্যোতি বাগচি
কলকাতা-১২৫

আইনের পথ?
অনিতা অগ্নিহোত্রীর প্রবন্ধ এবং একই দিনের সম্পাদকীয় নিবন্ধ ‘ভস্মীভূত’— দু’টি লেখাতেই বাংলার নারীদের নিরাপত্তার ভয়াবহ অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বর্ধমানের তুহিনা খাতুনের আত্মহত্যা, কাকদ্বীপে ধর্ষিতাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা-সহ বালিকা ও নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ওই সময়েই ঘটেছে। নদিয়ায় হাঁসখালির চোদ্দো বছরের নাবালিকার গণধর্ষণ, এবং মৃত্যুর প্রমাণ লোপাট করতে মৃতদেহ জোর করে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা সারা বাংলা, তথা ভারতের নাগরিকের মনে ভয় এবং ধিক্কার জাগিয়েছে। সরকারের শীর্ষব্যক্তি যখন পরোক্ষে সেই মৃত নাবালিকার দিকেই আঙুল তোলেন, এবং ইঁদুরের মৃত্যুর সঙ্গে ওই ঘটনার তুলনা করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে, তখন তা ঘৃণার উদ্রেক করে। দিল্লিতে নির্ভয়ার মা-ও এই ঘটনার সমালোচনা করেছেন।

ভয়ের আরও এই জন্য যে, ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনাগুলিতে অনেক ক্ষেত্রেই শাসক দলের নেতা-কর্মী বা তাঁদের আত্মীয়েরা জড়িত। ফলে আইন আইনের পথে চলতে পারছে না। পুলিশ অভিযোগ নিতে চাইছে না, নিলেও নিরপেক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত হচ্ছে না। ফলে দোষীরা সহজে জামিন পেয়ে, আক্রান্তদের হুমকি দিয়ে আরও ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে। শাসক দলের নেতা-কর্মীরা এই অবস্থাতেও উত্তরপ্রদেশের উন্নাও, হাথরসের ঘটনার তুলনা টেনে বাংলার আইনশৃঙ্খলা ভাল বলে আত্মপ্রশংসা করছেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যের। প্রশাসনের তরফে বলা হচ্ছে, ঘটনা ঘটলে পুলিশ সেখানে যাচ্ছে, এবং যথাযথ ব্যবস্থা করছে। প্রশ্ন থেকে যায়, আদালত তা হলে একের পর এক রাজনৈতিক হত্যা থেকে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছে কেন?

অতীতে কামদুনির ঘটনায় লক্ষ করা গিয়েছে, মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সরকার আর্থিক সাহায্য, এবং পরিবারের এক জনকে চাকরি দিয়ে মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। ফলে অভিযুক্তরা এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে। রাজ্য জুড়ে বেআইনি অস্ত্র জমায়েত করা হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বেরোতে গেলে ঘটনার ভয়াবহতা স্বীকার করে, রং না দেখে অপরাধীর বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পুলিশকে দলের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করাও জরুরি।

প্রদ্যোত পালুই
বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া

প্রতিধ্বনি
অনিতা অগ্নিহোত্রীর প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই চিঠি। সত্যিই কি আমরা আজ এক সভ্য জগতে বসবাস করছি, না কি ফিরে গিয়েছি মধ্যযুগীয় বর্বরতার কালে? গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত এক জন জনপ্রতিনিধির বাড়ির অনুষ্ঠান একটি নাবালিকার পক্ষে এতটা বিপজ্জনক হয় কী করে? গণধর্ষিতা, রক্তাক্ত বালিকাকে যখন ফেলে যাওয়া হল তার বাড়িতে, তখন সে মরণাপন্ন। সঙ্গে ছিল হাড়-হিম করা হুমকি। সন্ত্রাসের বাতাবরণ এতটাই মারাত্মক ছিল যে, মেয়েটিকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সাহস করেনি। এক হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্য নিয়েছিল। এবং এত বড় ঘটনার পাঁচ দিন পরেও পুলিশ কিছু জানতে পারল না, এটা বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন। ক্ষমতা এতটাই সর্বগ্রাসী যে, ডাক্তারের শংসাপত্র ছাড়াই নাবালিকাকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হল, ময়নাতদন্তের সুযোগ না দিয়ে।

তার উপর তদন্ত শুরুর আগেই শাসক দলের নেতা-নেত্রীর মুখে শোনা যায় মেয়েটির চরিত্র নিয়ে নানা কথা— এর চেয়ে হতাশাব্যঞ্জক কী হতে পারে? যোগী রাজ্যের হাথরসের ঘটনা আর নদিয়ার ‘বালিকা বিদায়’ আজ যেন এক রাগিণীতে বাজছে। দু’টি সুর এমন ভাবে মিশে গিয়েছে যে, আলাদা করা কঠিন।

দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১

শ্মশানে বিধিভঙ্গ
অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখাটি রাজনৈতিক পেশিশক্তির দাপটে বাংলার মেয়েদের অবস্থার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র। লেখাটি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, সমাজের প্রভাবশালীদের লালসার শিকার হওয়ার আরও কত ঘটনা ঘটলে এমন সংবাদ বন্ধ হবে? মেয়েটি গণধর্ষণের শিকার, এটা জানার পরেও বাবা-মা থানায় ছুটলেন না, প্রতিবেশীদের ডাকলেন না, অভিযুক্তরা এসে মৃত মেয়েটিকে নিয়ে শ্মশানে পুড়িয়ে দিল, এটা কী ভাবে সম্ভব? কিসের এত আতঙ্ক? শ্মশানে ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া দাহ করা হয়, এটা প্রশাসন জানত না? থানা তো শ্মশানের লাগোয়া! থানা কেন এত দিন কোনও ব্যবস্থা করেনি? তা হলে তো খুন করেও দেহ জ্বালিয়ে দেওয়া যায়! শুধু তা-ই নয়, তদন্তের আগেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলে দিচ্ছেন, মেয়েটি গর্ভবতী ছিল। কী ভাবে তিনি জানলেন এটি? মেয়েটি কোথায় রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুরক্ষা পাবে, তা না, সরকারের প্রধান মেয়েটিকেই ঘুরিয়ে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করলেন, শুধুমাত্র দলীয় কর্মীদের রক্ষার তাগিদে। সভ্য সমাজ কি এগুলো অনুমোদন করে?

অভিযুক্ত এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাশালী, ক্ষমতার প্রভাবে এরা অনেক কিছুই করে থাকে। তাই এদের নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিদ্যালয়ে নারী সচেতনতা বিষয়ক ক্লাস রাখতে হবে। অপরাধ ঘটলে কালবিলম্ব না করে প্রশাসনকে জানাতে হবে। প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। মুখ বন্ধ রেখে সহ্য করা মানে, অপরাধীকে আরও অপরাধ করার সুযোগ করে দেওয়া।

পরেশনাথ কর্মকার
রানাঘাট, নদিয়া

আরও পড়ুন
Advertisement