Rampurhat

সম্পাদক সমীপেষু: গণতন্ত্রের লজ্জা

বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাটমানির ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ চলছে। এটা গণতন্ত্রের চরম লজ্জা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২২ ০৫:০২

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বীরভূমের রামপুরহাটের গণহত্যা গোটা বাংলা তথা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সভ্য সমাজের মানুষ হয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে নিরীহ নারী ও শিশুগুলিকে ঘরের ভিতর বন্ধ করে পেট্রল জ্বালিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হল। এই বাংলায় আগেও গণহত্যা হয়েছে। কিন্তু বাংলা শান্তি ও সম্প্রতির জন্য যে দলের সমর্থনে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করল, তারা বাংলায় আইনের শাসনের বদলে শাসকের আইন প্রতিষ্ঠা করছে।

শাসক দলের এক জন উপপ্রধান খুন হওয়ার আগে নিরাপত্তা চেয়ে পাননি। এই খুন হওয়ার পরেও পুলিশ ওই এলাকায় টহলদারি করেনি। ফলে খুনের বদলা নিতে রাতে কিছু দুষ্কৃতী এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। এর পর সকাল থেকেই শাসক দলের পক্ষ থেকে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। কেউ বলেন শর্টসার্কিট থেকে হয়েছে, কেউ বলছেন টিভি ফেটে হয়েছে, কেউ বলছেন শাসক দলের বদনাম করতে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আবার গণতন্ত্রের রক্ষাকারীরা এই ঘটনাকে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র বলে চালাচ্ছেন। আসল সত্য স্বীকার করার সাহস এঁদের নেই। একের পর এক সত্য ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

Advertisement

এই ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এক সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অনেকে রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়েছেন। তা সত্ত্বেও শাসক দল চিৎকার করে বলছে, অন্য রাজ্যে এর থেকেও বেশি খুন হয়। অর্থাৎ, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত নন। আসলে পুলিশ-প্রশাসন আর পার্টি সব এক সঙ্গে মিশে গিয়েছে। শাস্তি আর হেনস্থার ভয়ে পুলিশ-প্রশাসন নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে পারছে না। ভোট পরবর্তী কালে লাগামছাড়া হিংসা বিরোধীদের রাজনৈতিক ময়দান ছাড়া করেছে। এখন শুধু এক দলের গোষ্ঠীর লড়াই চলছে, কে বেশি এলাকায় ‘রাজ’ করবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাটমানির ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ চলছে। এটা গণতন্ত্রের চরম লজ্জা। বুদ্ধিজীবীরাও ভীতসন্ত্রস্ত। তাঁরাও রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছেন না। সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরাতে শাসক দলের তৎপর হওয়া উচিত।

চিত্তরঞ্জন মান্না

গড়বেতা, পশ্চিম মেদিনীপুর

বিবেক জলাঞ্জলি

সম্প্রতি রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের ঘটনায় যে ভাবে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পেশ করা হয়েছে শাসক দলের তরফে, তা বিস্মিত করে আমাদের। সব শেষে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। কিন্তু যাদের হাতে গেল তদন্তের ভার, তারাও নিরপেক্ষ কি না, সে বিষয়ে বিস্তর মতবিরোধ রয়েছে। ইতিপূর্বে নোবেল চুরি, সারদা তদন্তের ক্ষেত্রেও শুধু সময়ের অপব্যয় হয়েছে, তদন্ত শেষ করা যায়নি। রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা পুলিশ বাহিনী হোক কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা সিবিআই, নিরপেক্ষতার প্রশ্নে পর্বতপ্রমাণ অভিযোগ দু’পক্ষের বিরুদ্ধেই। কেন এমনটা হয়? ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের দাসানুদাসে পরিণত হওয়ার অভিযোগ কেন ওঠে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে? ঠিক কী কারণে তাঁরা সরকারের নির্দেশে চালিত হন, সবটাই অজানা।

অন্য দিকে, গভীর বেদনায় অগণিত জনতা নিমজ্জিত হন। তদন্তের পরিণতি সম্পর্কে অজানতেই একটি ধারণা তৈরি হয়ে যায়। আশ্চর্যের বিষয় হল, পুলিশ আধিকারিক যাঁরা, তাঁরা তো রীতিমতো যোগ্যতা অর্জন করে স্বপদে বহাল হয়েছেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের নির্দেশে চালিত হন কী ভাবে! শুধু চাকরি বাঁচাতে, না কি আরও উচ্চ পদ ও ব্যক্তিসুখ লাভের বাসনায় বিবেক শব্দটিকে জলাঞ্জলি দিয়ে বসেন! অপরাধী কে জেনেও তাকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যান! নিরপরাধ মানুষ শাস্তি পায়, আর অর্থের বিনিময়ে আইন দোষীদের সাজামুক্ত করে দেয়। বিবেকের কাছে কি এই সব আধিকারিককে সামনাসামনি হতে হয় না? আত্মসুখ কি জীবনের সবচেয়ে মহার্ঘ বস্তু?

সম্ভবত পুলিশ বাহিনী এবং দেশের বিচার বিভাগও কিয়দংশে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছে। আগে যদিও বা দু’-এক জন বিকর্ণের দেখা মিলত, এখন সে সম্ভবনাও দূর অস্ত্। ভরসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জেদটুকুও অবশিষ্ট নেই। অতঃপর, সাধারণ মানুষের কাছে থেকে যায় সেই একটাই কথা, ‘প্রশ্ন করা মানা!’

রাজা বাগচী

গুপ্তিপাড়া, হুগলি

হিংসার ধারা

রাজ্যে বর্তমান হানাহানির পরিপ্রেক্ষিতে অশোক সরকারের ‘দীর্ঘলালিত হিংসার সংস্কৃতি’ (২৯-৩) প্রবন্ধটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এটা ঠিক যে, রাজনীতি না সম্পদ দখল, কী কারণে এই সমস্ত খুন, তা আলাদা করা খুবই মুশকিল। আসলে সম্পদ দখল বা নিজস্ব সম্পদ বৃদ্ধিই প্রধান লক্ষ্য এক শ্রেণির রাজনীতিকদের কাছে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তাঁরা রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও নিজেদের কলেবর বৃদ্ধির জন্যে এঁদের সমস্ত অন্যায় মেনে নিয়ে এবং সব কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। এই ব্যাপারটিই খুব সুন্দর ভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন, যা আরও এক বার উল্লেখ করা প্রয়োজন বলেই মনে হয়— “একটা ক্ষীণ ভদ্রলোক শ্রেণি বাদ দিলে, সমাজের অধিকাংশ যেখানে জীবিকার পরিসরে আর সামাজিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতা অথবা মাফিয়াদের উপর নির্ভরশীল, সেই সমাজের কোল থেকে হিংসা দমনের সহমত তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।” যত দিন না কোনও নির্বাচিত সরকার মানুষকে শ্রম ও পরিষেবার বিনিময়ে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার অধিকার না দিয়ে, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিভিন্ন সরকারি অনুদান প্রকল্পের মাধ্যমে পরমুখাপেক্ষী করে রাখবে, তত দিন এই হিংসার সংস্কৃতি চলবেই। এর অন্যথা যে দল করতে পারবে, ‘রাজনৈতিক হিংসা দমন করব’ এই স্লোগান নিয়ে, একমাত্র সেই দলই পারবে মানুষের সামনে আসতে।

অশোক দাশ

রিষড়া, হুগলি

তুলনাসর্বস্ব

আমতায় আনিস খানের মৃত্যুর পরে ঝালদা এবং পানিহাটিতে নবনির্বাচিত দুই কাউন্সিলরের হত্যাকাণ্ড, তার পরে বগটুইয়ে উপপ্রধান ভাদু শেখের হত্যা এবং আগুনে পুড়ে ন’জনের মৃত্যু, প্রায় সমসাময়িক সময়ে বসিরহাট এবং মালদহে নাবালিকা ধর্ষণ, বাসন্তী এবং মালদহে বোমা ফেটে আগুন লাগার মতো ঘটনা-সহ সারা রাজ্যে অস্থিরতা সকলের নজরে এসেছে। এই নিয়ে বিরোধীরা আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন তুললে শাসক দলের নেতা এবং সরকারের পক্ষ থেকে বিজেপিশাসিত একাধিক রাজ্যের উদাহরণ টেনে বাংলার আইনশৃঙ্খলা যথেষ্ট ভাল বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। অন্য রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে এ রাজ্যের তুলনা টেনে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ঠিক নয়। বরং তাতে দুষ্কৃতী এবং আইনভঙ্গকারীদের হাত শক্ত হয়। পুলিশ রাজনৈতিক নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে চলে, এমন প্রশ্ন উঠলে শাসক দলের নেতারা পূর্বের বাম আমলের উদাহরণ টানেন। ফলে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে নেতাদের সক্রিয়তা দিন দিন বেড়ে যায়। তাই প্রকাশ্য সভায় যখন কোনও পুলিশ আধিকারিক মুখ্যমন্ত্রীকে ‘মায়ের সমান’ বলে তুলনা টানেন, তখন বোঝা যায় যে, পুলিশ-প্রশাসনের একটা বিরাট অংশ ন্যায়ের পরিবর্তে সরকারের প্রতি অন্ধ অনুগত হয়ে উঠেছে। এ ভাবে বারে বারে একটা অন্যায়কে অন্য একটা অন্যায়ের সঙ্গে তুলনা করে এ রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা অনেক মসৃণ প্রমাণ করতে চাওয়ার ফলে একটু একটু করে এখন তার অগ্নিগর্ভ অবস্থা। তাতেও নেতাদের চোখ খোলেনি। এখনও অন্যায়কে অন্যায় বলে স্বীকার করতে দল থেকে সরকার দ্বিধান্বিত। এ ভাবে চললে আইনশৃঙ্খলার অবনতি আরও হওয়ার আশঙ্কা।

প্রদ্যোত পালুই

বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া

আরও পড়ুন
Advertisement