ঈশানী দত্ত রায়ের ‘জীবন যে রকম’ (২২-২) পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছিল শহরের বেসরকারি নার্সিংহোমের কয়েকটাতে ‘ভিজ়িটর’ হিসাবে কাটানো সেই সব দিনের কথা। তখন নিজের প্রিয়জনের একমাত্র পরিচয়, ‘আপনার পেশেন্ট ক্যাশে আছেন না ক্লেমে?’ ওষুধ-ফিনাইলের ঝাঁঝালো গন্ধ, অ্যাম্বুল্যান্সের হুটার, রোগীর কষ্ট, রোগীর পরিজনদের উৎকণ্ঠা, সারা দিন নার্সিংহোম চত্বরে বসে থেকে রোগীর কাছাকাছি থাকার ‘বৃথা’ চেষ্টা, আর ভিজ়িটিং আওয়ার শুরু হতেই ভেন্টিলেশন-আইসিইউ-এইচডিইউ’তে থাকা মানুষটিকে ‘আজ কেমন দেখব’— এই অমোঘ প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মানুষগুলোকে দেখে নিজেরও মনে হয় সব অভিযোগ ভুলে জীবনের কাছে ফিরে যাই! স্ত্রীর ডায়ালিসিস চলাকালীন অপেক্ষায় বসে আছেন অশীতিপর বৃদ্ধ, গত দু’বছর ধরে সপ্তাহে তিন দিন এমনটাই চলছে, একমাত্র কন্যা কাজের সূত্রে বিদেশে, তাকে বার বার ডেকে আনতে চান না বাবা-মা। গাড়িচালককে নিয়ে একাই চিকিৎসার জন্য এসেছেন এক বৃদ্ধা, স্বাস্থ্যবিমার কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন ভর্তির আগে, শুধু আধার কার্ড আনতে ভুলে গেছেন বলে ফোনে পুত্রবধূর থেকে চেয়ে নিলেন। পুত্রের মিটিং পড়ে যাওয়ায় তাকে বিরক্ত করলেন না মা। হ্যাঁ, এ ভাবেও বাঁচা যায়, এ ভাবেও জীবনকে আগলে রাখা যায়।
এ প্রসঙ্গে সুজিত সরকার পরিচালিত আই ওয়ান্ট টু টক সিনেমাটির কিছু অংশ মনে পড়ল। চিকিৎসালয় আদতে একটা খেলার মাঠ যেখানে ডাক্তারের পারফরম্যান্স আর স্কোরের উপর এক রোগক্লিষ্ট মানুষের হারজিত নির্ভর করে। তাই জীবন, চিকিৎসা আর যমে-মানুষে টানাটানির মধ্যে একটাই উপলব্ধি জাগে, ‘মরে যেতে পারতাম’ বলে কিছু হয় না।
অনিশা ঘোষ, পাণ্ডুয়া, হুগলি
ভালবাসার জীবন
পদ্মপাতায় জলের মতো অনিশ্চয় জীবন যখন শুকায়ে যায়, পূজার প্রদীপে যখন জ্বলে দীপ্ত-শোক, প্রিয়জনের চলে যাওয়ার দুঃসহ রাতে যখন দুয়ারগুলি ঝড়ে ভেঙে পড়ে, হৃদয় যখন তীব্র দহন জ্বালায় মথিত হয়, তখনও ‘আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার’ অনুরণনে শান্তির অন্বেষণ করে জীবন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “জীবন যেমন আসে জীবন তেমনি যায়। মৃত্যুও যেমন আসে মৃত্যুও তেমনি যায়। তাহাকে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা কর কেন? হৃদয়টাকে পাষাণ করিয়া সেই পাষাণের মধ্যে তাহাকে সমাহিত করিয়া রাখ কেন? তাহা কেবল অস্বাস্থ্যর কারণ হইয়া উঠে। ছাড়িয়া দাও, তাহাকে যাইতে দাও— জীবনমৃত্যুর প্রবাহ রোধ করিয়ো না। হৃদয়ের দুই দ্বারই সমান খুলিয়া রাখো। প্রবেশের দ্বার দিয়া সকলে প্রবেশ করুক, প্রস্থানের দ্বার দিয়া সকলে প্রস্থান করিবে।” রবীন্দ্র-অনুভবে জীবনবোধকে মান্যতা দিয়েও, জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েও বেঁচে থাকার জন্য কেন তবে অদম্য জিজীবিষা? ‘জীবন এত ছোট কেনে’ প্রশ্ন করেও জীবনকে কেন ভালবাসা? ‘জীবন যে রকম’, তাকে সে ভাবেই চলতে দিতে হবে। বাঁচিয়ে রাখার জন্য বারি সিঞ্চন করে তারই পরিচর্যা চলে। সেই আকুল বাসনার ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন ঈশানী দত্ত রায়, যার প্রতিটি ছত্রে এসেছে আমাদেরই জীবনকাহিনি, করেছেন আমাদের ঋণী।
দু’টি ঘটনার সাক্ষী আমার অকিঞ্চিৎকর জীবন। যত্নে, আদরে, নিয়মনিষ্ঠায় যাপিত ছিল আমার মায়ের চাহিদাহীন জীবন। দুপুরে খুঁটিয়ে পড়তেন কাগজ। বিকেলে চা করে, টিভি দেখতে দেখতে অপেক্ষা করতেন ছেলের ফেরার। সেই অপেক্ষায় থাকার মাঝেই কাল হয়ে এল ঘোরতর অনিয়ম। হার মানলেন বার্ধক্যজনিত অসুখের কাছে। আইসিইউতে এক ঘণ্টার ভিজ়িটিং আওয়ার। আকুল জিজ্ঞাসা প্রত্যেক বার। “কবে বাড়িতে নিয়ে যাবি?” শেষে চলে গেলেন মৃত্যুর কাছে হার মেনে। ...আলমারি ভর্তি শাড়ি, শাল...। আবিষ্কৃত হল একটি ডায়েরি। কবে দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে গিয়েছি, তারা মাকে দর্শন করে কেমন শান্তি পেয়েছেন, কোন নাতি-নাতনির জন্মদিন, কী উপহার দেওয়া হল, আমার অজানতে কবে দু’প্যাকেট দুধ নেওয়া হয়েছিল, যাতে রাতে বাড়িতে ফিরে পায়েস খেতে পারি।
যখন অসুস্থ হয়ে বাক্শক্তিরহিত হলেন, দু’বেলা আয়া-নির্ভর জীবন কেটেছে চোখের জলে। কত কী যে বলতে চাইতেন! দুয়ারে শমন উপস্থিত যথা সময়ে। প্রাণবায়ু নির্গত হওয়া প্রত্যক্ষ করলাম চোখের সামনে। ঠিক মুহূর্তখানেক আগেই তিনি আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন। কেন? জীবনকে ধরে রাখার জন্য?
দ্বিতীয় ঘটনা সাম্প্রতিক অতীতের। এক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হল। অবহেলায় পেটের অসুখকে পাত্তা না দিয়ে এই দশা। ডে-কেয়ারে কেমো চলছে। ও দিব্যি হেডফোনে গান শুনছে, শরীরে প্রবিষ্ট হচ্ছে মারণরোগের স্যালাইনবাহিত ওষুধ। আমরা যাচ্ছি। গল্পও হচ্ছে। “ভয় পাবেন না দাদা। ঠিক তিন-চারটে কেমো নিলেই...। তার পর আপনাদের বোনকে নিয়ে ওয়ার্ল্ড টুরে বেরোব।” কিন্তু তিনটে কেমোও নিতে পারল না। চলে গেল আমাদের সেই অত্যন্ত নিকটজন।
সেই ক্যানসার হাসপাতালে বা মাকে যেখানে রাখা হয়েছিল বরাবর, সেই সুপার-স্পেশ্যালিটি হাসপাতালেও দেখেছি এক ছবি। রোগীর পরিজনদের আকুল জিজ্ঞাসা। ডাক্তারবাবু কখন ওয়র্ডে ভিজ়িট করতে আসবেন, তাঁর কাছ থেকে জেনে নেওয়া রোগীর অবস্থা, ক্যান্টিনে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পরিবারের আত্মজনদের চিন্তিত মুখে খাওয়া, ভালবাসার জীবনকে ধরে রাখতে হলে যে উদরপূর্তি করে চলতেই হবে!
জীবন নিজের নিয়মে চলে। শুধু মানিয়ে নিতে জানতে হয়।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫
সুখের অভিনয়
ঈশানী দত্ত রায়ের লেখা ‘জীবন যে রকম’ প্রবন্ধে মৃত্যুর অববাহিকায় দাঁড়িয়ে জীবনের ক’টা দিনের নাট্যময় স্বাচ্ছন্দ্যের কথাবার্তা বেদনাময়। অনেকে বলবে নাট্যময় কেন বললাম? যে ছোট্ট মেয়েটি বা ছেলেটি বা যারা মারণরোগ নিয়েও হাসি মুখে নিজেদের জীবনের পরিসীমা না জেনে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলছে, সত্যিই কি তাদের হাসিমুখের জীবন? অতি আপনজনদের ভাল রাখার জন্য মৃত্যু অনিবার্য জেনেও হাসি হাসি মুখ করে কথা বলা। আর ধরুন যাদের ঠিকানা ফুটপাতে? কেমন দিনে রাতে অত্যন্ত উচ্ছ্বাসে খেলে বেড়ায়। তাদেরও তো শিয়রের পাশ দিয়ে শোঁ-শোঁ রবে চলে যাচ্ছে চাকারূপী মৃত্যুদূত।
আর সম্পর্ক বা ভালবাসা হারানো এ জীবন? কখনও ভাসছে, কখনও ডুবছে। ডুবতে ডুবতে মাঝে-মাঝে ভেসে উঠছে। ডুকরে-ডুকরে অন্তরালে কাঁদছে। হ্যাঁ, সে জীবনও মরণের ছবি আঁকতে আঁকতে এগিয়ে চলেছে তারকাখচিত আকাশ দেখে, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে সে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া জীবনের কথা বললে? সে তো মায়ের কোল খালি হওয়ার বা কফিন বন্দি হয়ে ঘরে ফেরার আশঙ্কার জীবন। সাধারণ নাগরিকের জীবনের কথা ভাবুন। কাজে গিয়েছে। ফিরবে কি না অনিশ্চয়তা ভরা। রাজনৈতিক হিংসার কারণে রাস্তায় বোমাবাজি, বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কা বা দুর্ঘটনা কাটিয়ে নিশ্চিন্তে ঘরে ফেরা এ জীবনে অনিশ্চিত। আসলে, প্রতি পদক্ষেপে ভিন্ন ভিন্ন জীবন মৃত্যুর উপত্যকায় হাঁটছে। কে কখন উপত্যকা থেকে পিছলে পড়বে বা উধাও হয়ে যাবে তা সকলেরই অজানা। আবহমান কাল ধরে এমনই চলে আসছে।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০