Development

সম্পাদক সমীপেষু: ‘উন্নয়ন’ মানে কী

মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমাদের দেশে গালভরা বুলির শেষ নেই। আসল সমস্যা ওই সব বড় বড় বুলির রূপায়ণে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০২৩ ০৪:১৭

—ফাইল চিত্র।

স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘উন্নয়নের বিভ্রম’ (২-৮) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন উঠেছে তা হল, উন্নয়ন মানে কী? এখন দেশে একটা স্লোগান খুব চালু হয়েছে, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। উন্নয়ন মানে সবার বিকাশ, সবার উন্নতি। আমাদের দেশে এটা হচ্ছে তো? মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমাদের দেশে গালভরা বুলির শেষ নেই। আসল সমস্যা ওই সব বড় বড় বুলির রূপায়ণে। লেখক ঠিকই বলেছেন, উন্নয়ন এখন দলগত, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল বা তার সমর্থক ব্যক্তি যদি জেতে তবে উন্নয়ন হবে, নয়তো নয়। ভাবলে অবাক হতে হয়, এটা কি গণতন্ত্র না দলতন্ত্র?

Advertisement

কোথাও কোথাও আবার ব্যক্তিতন্ত্র কায়েম হয়েছে। সরকারের টাকা মানেই জনগণের টাকা। কাজেই যে কোনও দল বা ব্যক্তি জিতুক না কেন, সরকারি টাকার সঠিক ব্যবহার হবে না কেন? এখন মানুষ প্রশ্ন করতে, বা ন্যায্য কথা বলতে ভয় পায়। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও প্রকৃত সত্য প্রকাশ করার কর্তব্য এড়িয়ে যান। প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি আমরা স্বাধীন দেশে বসবাস করছি? আসলে শিক্ষিত মানুষের বিবেক যখন মরে যায়, তখনই সেই দেশের, রাজ্যের বা এলাকার অধঃপতন শুরু হয়ে যায়। এর থেকে কী করে উদ্ধার পাব আমরা? এই প্রশ্নের সঙ্গে উন্নয়নের প্রশ্নও জড়িয়ে রয়েছে। এখানেই আসে দেশপ্রেম ও প্রকৃত শিক্ষার প্রসঙ্গ। কেননা, এই দুটোকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন হয় না।

অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ

দখলদারি

স্বাতী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধটি পড়ে একটা পুরনো কথা মনে পড়ল। কোনও একটি সেতু সম্পূর্ণ হওয়ার পরে সেটি উদ্বোধন করানো হয়েছিল এক মহিলা শ্রমিককে দিয়ে। তাতে কি শ্রমজীবীদের দুঃখ লাঘব হয়েছে? প্রজাতন্ত্র স্থাপনের এক নিদর্শন রূপে পরিগণিত হয়েছিল ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪ সংশোধনীর পর। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু হল পঞ্চায়েত নির্বাচন। মানুষ প্রথম দিকে বুঝেছিল তাদের এলাকার উন্নয়ন তাদের উপরই ন্যস্ত। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে তারা হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে আপন সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় শামিল হল। তার পরিণতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার একটি টিকিটের জন্য হানাহানি, হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপ। তার পর নির্বাচনের নামে যা হল, তা অবশ্যই প্রত্যাশিত ছিল না। অথচ, সব রাজনৈতিক দলই শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পক্ষে ছিল বলে দাবি করেছিল।

গ্রামাঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নে পঞ্চায়েতের ভূমিকা নিয়ে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, কিন্তু একনায়কতন্ত্র প্রতিরোধ করা যায়নি। নির্বাচনে যোগদানের যৌক্তিকতা বিষয়ে নির্বাচকমণ্ডলীকে সচেতন করার উদ্যোগ করাই হয়নি, বরং স্থূল কিছু স্বল্পমেয়াদি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। এক সময় স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করে নানান প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর করার প্রয়াস করা হয়েছিল, সেখানেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে কাজের কাজ কিছু হয়নি।

প্রবন্ধকার শ্রদ্ধেয় অজিত নারায়ণ বসুর গ্রামোন্নয়ন কর্মসূচির কথা লিখেছেন। অজিতবাবু গ্রামের মানুষের প্রত্যক্ষ যোগদান নিয়ে যুগান্তকারী কাজ করেন। গ্রামাঞ্চলের সম্পদের যথার্থ ব্যবহার যাতে গ্রামের মানুষের ইচ্ছাক্রমেই হয়, এমনকি তৃণমূল স্তর থেকে যাতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দিঙ্‌নির্দেশনা হয়, সে বিষয়ে সরকারকে অবহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল এলাকার নিয়ন্ত্রণের অধিকার। এক জন মানুষ বা একটি গোষ্ঠী নির্ধারণ করবে মানুষের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, জনগণের মতামত সেখানে ভূলুণ্ঠিত হতে বাধ্য। আম্বেডকর সংবিধান প্রণয়নের সময়ে গণতন্ত্রের এমন একনায়কতন্ত্রে পর্যবসিত হওয়ার কথা অবশ্যই ভাবেননি। সময়োপযোগী হলেও, এই প্রবন্ধে সঙ্গত কারণেই নতুন কিছু দিশা পাওয়া গেল না। রাজনৈতিক চিন্তার দৈন্যদশা সঠিক ভাবে উপস্থাপিত হল, এইটুকুই প্রাপ্তি।

সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি

বিকল্প পথ

গ্রামীণ রাজনীতি এবং পঞ্চায়েতের আলোচনায় স্বাতী ভট্টাচার্য অজিত নারায়ণ বসুর কথা তুলে এনেছেন দেখে ভাল লাগছে। বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে মানুষের ন্যায্য, আইনসম্মত অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, কোনটা ন্যায় ও কোনটা অন্যায়, তা নিয়ে চাপানউতোর চলছে। সেই আলোচনায় অজিতবাবু প্রাসঙ্গিক, কিন্তু বিস্মৃতপ্রায়। তিনি বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে মানুষের যোগদানের কথা বলেন। রাষ্ট্রের তথা দলীয় ক্ষমতার হস্তক্ষেপকে সরিয়ে রেখে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণ, গ্রামীণ সম্পদের তথ্য আহরণ, শ্রমের মূল্যমান নির্ধারণ, শ্রমশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর জীবনের গুণগত মানবৃদ্ধি প্রভৃতি কী ভাবে সম্ভব, তা তিনি দেখিয়েছিলেন। যখন তিনি সপ্তাহে কয়েক দিন ডায়ালিসিস নিচ্ছেন, তখনও বাংলার গ্রামে ঘুরে ঘুরে মিটিং করে আলোচনা করেছেন, গ্রামের মানুষের দ্বারা গ্রামের সরকার গড়তে হলে কী করতে হবে।

‘গ্রামবাসীদের দ্বারা গ্রাম পরিকল্পনা’ কী ও কেন, সে বিষয়ে অজিতবাবুর কথাগুলি অত্যন্ত মূল্যবান। ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর গ্রামবাসীদের নিয়ে স্থানীয় উন্নয়নের পরিকল্পনা করার একটি নির্দেশ জারি করে। ওই নির্দেশনামার মাধ্যমে যে বিকল্প উন্নয়নের দিশাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তার শুরু হয়েছিল আশির দশকে। মেদিনীপুর জেলা পরিষদ ও আইআইটি খড়্গপুরের যৌথ চেষ্টায় একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়— গ্রামভিত্তিক জেলা উন্নয়নের পদ্ধতিগত রূপরেখা। বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলার কয়েকটি এলাকায় ব্লক এবং গ্রাম স্তরে এ ভাবে পরিকল্পনার কিছু কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। অজিতবাবুর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত তাঁর বই আদিম স্বপ্ন নতুন পথ-এর একটি অধ্যায়ে বিশদে এই অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ আছে।

অজিতবাবু উন্নয়নের ভিন্ন দিশার কথা বলেছিলেন। তাঁর মূল কথা ছিল, চলতি সমাজব্যবস্থার মধ্যেই গ্রামবাসীদের উন্নয়নের জন্য যেটুকু করা যায় তার চেষ্টা নিশ্চয়ই করতে হবে, কিন্তু তার পাশাপাশি একটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যও থাকবে। ভবিষ্যতের একটা ভিন্ন সমাজব্যবস্থা (সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়) গঠনের চেষ্টা, যেখানে উন্নয়ন এখনকার তুলনায় শুধু পরিমাণের দিক থেকে বেশি হবে না, গুণগত দিক থেকেও মৌলিক ভাবে আলাদা হবে।

অজিতবাবু বার বার বলতেন, প্রতিনিধিত্বমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়ার যতগুলি জায়গা এখন রয়েছে, গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে সংসদ পর্যন্ত, তার কোনওটিতেই শ্রমজীবীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্তর যত উপরে, ততই সেখানে আধিক্য ‘পরশ্রমজীবী’দের। ব্যতিক্রম গ্রাম সংসদ। গ্রামের সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ গ্রাম সংসদের সদস্য হিসাবে সিদ্ধান্তে অংশ নিতে পারেন, যাঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবীরাই।

নব দত্ত, কলকাতা-৩৯

নীতিহীন

পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন সম্পন্ন। যেখানে ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েত, সেখানে নীতিহীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ দিয়ে বোর্ড গঠনে নিজের সুবিধা বুঝে দলবদল করছে নির্দল জয়ী প্রার্থীরা। আবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলের মধ্যেও প্রধান, উপপ্রধানের পদ নিয়ে দলীয় কোন্দলের ফলে বোর্ড চলে যাচ্ছে অন্য দলের হাতে। জয়ী নির্দল (বিক্ষুব্ধ) প্রার্থীকে পুরনো মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পুরে দিচ্ছে শাসক দল, যতক্ষণ না বোর্ড গঠন হচ্ছে। মানুষের মূল্যবোধ, নীতিবোধ বলে আর কিছু রইল না। অবশ্য হাই কমান্ড যখন রাজ্যে রাজ্যে চূড়ান্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও, শুধু কেন্দ্রে ক্ষমতা লাভের জন্য জোট বাধতে পারে, তখন নিচুতলার কর্মীদের দোষ কী?

জয়ন্ত কুমার দেবনাথ, রানাঘাট, নদিয়া

আরও পড়ুন
Advertisement