—ফাইল চিত্র।
স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘চিংড়ির শনির দশা’ (২৮-৮) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্র। সত্তরের দশকের আগে আমাদের স্লোগান ছিল ‘মাছে-ভাতে বাঙালি, দুধে-ভাতে বাঙালি’। তখন মৎস্যজীবীরা মাছ চাষ করতেন, মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের রাজ ছিল না। সত্তরের দশকের শুরু থেকে আমাদের এখানে চিংড়ি রফতানি শুরু হয়। রফতানিকারকরা নিজেরা কিছু উৎপন্ন করেন না, কিন্তু অধিক লাভের আশায় কৃষক বা মৎস্য চাষিদের প্রভাবিত করেন সরকারি সহযোগিতায়। ফলে কৃষক বা মৎস্যজীবীরা অধিক লাভের আশায় নিজেদের ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসেন ও কৃত্রিম ভাবে অধিক খাবার ও ওষুধ প্রয়োগ শুরু করেন। বোঝানো হল না, অধিক খাবার দিলে সবটাই মাছ খাবে না, অতিরিক্তটুকু পচে গিয়ে মড়ক ডেকে আনবে। অধিক খাবার দেওয়ার ফলে অন্যরা লাভবান হলেও, মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, ভবিষ্যতেও হবেন।
উপকূল এলাকায় চিংড়ি চাষ নিষিদ্ধ। রাজ্য সরকার দু’বার জরিমানা দিয়েছে। চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারি উৎসাহ-প্রদানকারী সংস্থাগুলির দাপট কমেনি। কারণ, এদের কোনও সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই। এই বিশেষজ্ঞরা সব সময়ে বিদেশি চিন্তাধারা এখানে প্রয়োগে উৎসাহী। যেমন, হেনরি আইল্যান্ডের নোনা জলে মিষ্টি জলের মাছ তেলাপিয়া চাষে উৎসাহী, নলবন ভেড়িতে পাহাড়ি নদীর ঠান্ডা জলের মাছ বরৌলি চাষের জন্য তাইল্যান্ড থেকে মেশিন বসানোয় উৎসাহী। ফলে মাছ চাষে এঁদের পরামর্শে চলতে গিয়ে কৃষক বা মৎস্য চাষিরা সর্বস্বান্ত। এখানকার পরিবেশের উপযোগী মৌরলা, ট্যাংরা, মাগুর ইত্যাদি মাছের প্রজনন না বাড়াতে পারলে কী হবে, এই সমস্ত বিশেষজ্ঞ চাষিদের উৎসাহ দিচ্ছেন ভিয়েতনাম কই, মাগুর, মেক্সিকোর ভেনামি চিংড়ি চাষের। এই বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব রুখে না দিলে কৃষক, মৎস্যজীবী, ডেয়ারি, পোলট্রি সবই অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বে। ‘বিশেষজ্ঞ’ তৈরির কারখানাগুলি চলে বহুজাতিক কোম্পানির পয়সায়। তারা তাদের মাল বিক্রির জন্য বিশেষজ্ঞ তৈরি করে আমাদের বিপথে চালিত করছে। ফলে মাছে-ভাতে বাঙালি আজ অন্ধ্রের মাছের উপর নির্ভরশীল। মাছে স্বনির্ভরতা ফিরিয়ে আনতে হলে মধ্যস্বত্বভোগী ও উপদেষ্টাদের আগে বিদায় জানাতে হবে।
তারাপদ ভৌমিক, রায়চক, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
খেত থেকে ভেড়ি
সুন্দরবনে চিংড়ি চাষ লাভজনক ব্যবসা হিসাবে শুরু হওয়ার পরে নানা জেলায় কৃষিজমির রূপান্তর ঘটেছিল মাছ চাষের জমিতে। একদা সুন্দরবনের নোনা জলে বহু ধরনের মাছ চাষ হত, কিন্তু বিশ্ববাজারে নোনা জলের ফসল চিংড়ি চাষ অর্থকরী হয়ে ওঠার পর তা ছড়িয়ে পড়ল। চার দশকে বদলে গেল বহু চাষির জীবন, অধিকাংশ মানুষের অলক্ষ্যে।
পশ্চিমবঙ্গে বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয় আশির দশকের শুরু থেকে, যখন এই রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন। বামফ্রন্টের নানা শরিক দল ও কৃষক সংগঠনগুলির প্রভাব গ্রামাঞ্চলে ক্রমশ বাড়ে এই সময়। তখন থেকেই শুরু হয় ধানের জমিতে চিংড়ি চাষ। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে কলকাতা থেকে বাসন্তী রোড ধরে সুন্দরবনের দিকে সন্দেশখালি, সরবেড়িয়া, মালঞ্চ, মিনাখাঁ, বাসন্তী, গোসাবা ইত্যাদি অঞ্চলে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন রাস্তার দু’ধারে দিগন্তবিস্তৃত ধানের খেত। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে ভূমি সংস্কারের ফলে ছোট ছোট জোতে জমি ভাগ করে দেওয়া হয় ভূমিহীনদের। জমির সামান্য পরিমাণ, এবং চাষের খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে কৃষি লাভজনক হচ্ছিল না। তবু কৃষিজমি কৃষকের প্রাণতুল্য। কৃষি অলাভজনক হলে চাষি ভাগচাষ করবে, মজুরি খাটবে, তবু জমি হস্তান্তর করতে চাইবে না।
আশির দশকের মাঝামাঝি কয়েকটি কর্পোরেট সংস্থা চিংড়ি রফতানিতে গুরুত্ব দিতে থাকে। নোনা জলের দেশ সুন্দরবনে চিংড়ি চাষে উৎসাহ দেখা দেয়। অন্যান্য জেলাতেও আগ্রহ দেখা দেয়। কিন্তু জমি কোথায়? শুরু হল ধানের জমিতে চিংড়ি চাষের ভাবনা। ইতিমধ্যে শাসক দলের আশ্রয়ে পুষ্ট মাফিয়া সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে গ্রামে। জমি-কেন্দ্রিক খুন-জখম চলছে। অবিভক্ত ২৪ পরগনায় সরকারি প্রশ্রয়ে বহু ‘রাজনৈতিক জমিদার’ জন্ম নিয়েছে। তারা গ্রামের সমাজকে, পুলিশ-প্রশাসনকেও নিয়ন্ত্রণ করে। এরা হয়ে উঠল চিংড়ি ব্যবসায়ী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সমূহের এজেন্ট।
এই সময় শুরু হল মাছ চাষের প্রয়োজনে কৃষককে জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা। গ্রামীণ মাফিয়ারা নেমে পড়ল জমি সংগ্রহে। টাকার বিনিময়ে কৃষকরা জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, কিছু টাকার বিনিময়ে পরিণত হলেন কর্মহীন মানুষে। পাশাপাশি নদীর ধারে ও কৃষিজমিতে গড়ে উঠল ইটভাটা। চিংড়ির আকার ও ওজন বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন-মিশ্রিত খাবার ব্যবহারের ফলে মাটি, পুকুরের জল ও নদীর জলের দূষণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কৃষক জমি হারাচ্ছেন, ভেড়ি ও ইটভাটা জমি গিলে ফেলছে। এই সব পরিবর্তন, জমির বেআইনি হস্তান্তর কৃষক সভার নজর এড়িয়ে গেল কী ভাবে?
চাষি পরিণত হলেন পরিযায়ী শ্রমিকে। রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের পাথুরে এলাকায় চলছে অগণিত বেআইনি খাদান। মাঝেমধ্যেই সংবাদপত্রে মিনাখাঁ, দেগঙ্গা, সন্দেশখালি এলাকায় সিলিকোসিস-আক্রান্তদের মৃত্যুর সংবাদ দেখা যায়। একদা এঁদের প্রায় সকলেই কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন। জমি হারানোর ফলে এঁদের খাদানে কাজ করতে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। খাদানে কাজ করতে গিয়ে পাথরের গুঁড়োয় মিশ্রিত সিলিকা ফুসফুসে ঢুকছে, ঘরে ফিরে মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন তাঁরা।
কর্পোরেটের লোভে সমগ্র সুন্দরবন বিপন্ন, জীবিকা হারানো মানুষের ভিড় বাড়ছে। বিধায়ক, সাংসদ ও প্রশাসনের ভ্রুক্ষেপ নেই।
অশোক ঘোষ, কলকাতা-৯১
গাছের ছায়ায়
‘চিংড়ির শনির দশা’ প্রবন্ধে মাছের ভেড়িগুলির সঙ্গে বৃক্ষরাজির নিবিড় সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। সে কালের খালে, বিলে দেশীয় পদ্ধতিতে মাছ ধরা হত। পুকুরপাড়ে গাছগাছালি শখের মৎস্যশিকারিদের সুশীতল ছায়া দিত। মাছ চাষের সঙ্গে বনরাজির বৈজ্ঞানিক সম্পর্কের কথা নজরে আসে প্রধানত সুন্দরবন অঞ্চলে। এখন তো দক্ষিণ কলকাতার প্রান্তিক অঞ্চলগুলিতে হাইওয়ে বরাবর ভেড়ির ছড়াছড়ি! সত্তরের দশকে মাছ চাষকে বিভিন্ন ভাবে সরকারি অর্থানুকূল্য দ্বারা উৎসাহিত করা হত। একটা দফতরও ছিল, একেবারে ব্লক স্তর অবধি। মাছচাষ এখনও লাভজনক, কিন্তু ব্যবসা মুষ্টিমেয় মানুষের কুক্ষিগত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাঁরা মাছ ধরেন, তাঁরা থেকে যান সেই তিমিরেই!
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১
নিয়োগ কই?
সংবাদে প্রকাশ, আবার এ বছর ডিসেম্বর মাসে প্রাইমারি টেট পরীক্ষা হবে। ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ সালে টেট পরীক্ষা হয়েছিল, তার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। তাদের ইন্টারভিউ এখনও শুরু হয়নি। ২০১৭ সালের পরীক্ষার পর চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ হয়েছে, নিয়োগ হয়নি। পরীক্ষার পর পরীক্ষা হয়ে চলেছে, নিয়োগের জন্য নতুন নতুন শর্ত তৈরি হচ্ছে, অথচ নিয়োগ হচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক স্কুলের টেট পরীক্ষায় পাশ করেও বিএড ডিগ্রিধারীরা নিয়োগ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন। অথচ, হাই কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিএড ডিগ্রিধারীরা অনেক খরচ ও পরিশ্রম করে প্রাথমিক টেট-এ উত্তীর্ণ হন। যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি, তাঁরাই বিএড করেন। আদালতের রায় শিরোধার্য মেনেও বলতে হয়, এর ফলে দক্ষ শিক্ষকদের সান্নিধ্যে শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হবে প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়ারা।
সৈয়দ আনসার উল আলাম, ঘাটাল, পশ্চিম মেদিনীপুর