artist

সম্পাদক সমীপেষু: শিল্পীর সঙ্কট

সামাজিক ন্যায়-নীতির বোধে বিচ্যুতি ঘটতে থাকলে রুচিবোধও অধঃপতিত হতে বাধ্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২২ ০৪:০৭

কোনও নবীন প্রতিভা যদি সঙ্গীতকে জীবিকা করেন, তা হলে বহু ক্ষেত্রে তাঁকে সামাজিক, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা, তথা অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতে হয়। সমাজ তাঁকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সামান্য সুযোগটুকু দেয় না। অবহেলায় অনেক প্রতিভা অকালে ঝরে যায়। যদি সেই প্রতিকূলতা ঠেলে কোনও শিল্পী দাঁড়িয়ে যান, তখন তাঁর পাশে প্রচুর অবাঞ্ছিত লোক জুটে যায়, যাদের বেশির ভাগই মধ্যস্বত্বভোগী ও স্বার্থান্বেষী। তাদের কাছে সেই শিল্পী তখন সোনার ডিম-পাড়া হাঁস ছাড়া আর কিছু নয়। বিভিন্ন মাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান তখন তাঁর কাছে ভিড় করে আসে বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে বসন্তের কোকিলের মতো। কারণ, সেই শিল্পী তত দিনে এক পণ্য হয়ে উঠেছেন। তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা তৈরির পিছনে কায়েমি স্বার্থও কাজ করে। সেই লেনদেনের কারবারেও অনেকের বখরা রয়েছে। অবহেলা এবং উন্মাদনা, দুয়ের টানাপড়েনে শিল্পী বিধ্বস্ত হন, শিল্পেরও ক্ষতি হয়।

শিল্পের মান কিংবা উৎকর্ষের কথা নাহয় ছেড়ে দেওয়া হল। কারণ, গণ-চাহিদার চাপে তখন তাঁর শিল্পের গুণমানের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেই গিয়েছে। এটাও লক্ষণীয় যে, প্রচারসর্বস্ব জনপ্রিয়তায় যশ-প্রতিষ্ঠা গায়ে মেখে অনেক মধ্যমেধা তথা নিম্নমানের শিল্পী কঠিনতর সাধনক্ষেত্র ছেড়ে নেতা-মন্ত্রী হয়ে সহজতর জীবন ও সাফল্যের পথে পা বাড়িয়েছেন, এমন উদাহরণও কম নয়।

Advertisement

কোনও সুস্থ সমাজের প্রথম শর্ত যদি নীতিবোধ হয়, তবে তার শেষ শর্ত হল রুচিবোধ। সামাজিক ন্যায়-নীতির বোধে বিচ্যুতি ঘটতে থাকলে রুচিবোধও অধঃপতিত হতে বাধ্য। তখন সঙ্গীত, কাব্য, চিত্র-ভাস্কর্যের মতো শিল্পের উৎকর্ষ নিরূপণ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। প্রচারের ঢক্কানিনাদই উৎকর্ষের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। দিশাহারা জনগণও সেটাই মেনে নেন। দিন আসছে, যখন প্রেক্ষাগৃহে শিল্পীর পাশাপাশি সমঝদারও বিরল হয়ে আসবে।

এক দিকে অনাদর ও অবহেলা, অন্য দিকে উন্মাদনার শিকার হয়েও যাঁরা স্বধর্মে নিয়োজিত রইলেন, তাঁরা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য, বিপন্ন প্রজাতির মতো মহার্ঘ। এই প্রসঙ্গে মান্না দে-র কণ্ঠে শোনা সেই ছোট্ট মেয়েটির কথা মনে পড়ে, অসুস্থতা সত্ত্বেও শ্রোতাদের চাপে গানের অনুষ্ঠান করে যার কণ্ঠ চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। অথবা হীরক রাজ্যের সেই বাউল, যিনি তাঁর গানে সত্যভাষণের জন্য রাজশক্তির হাতে নিপীড়িত হন। বাণিজ্য ও ধনতন্ত্রের এই তাণ্ডব অন্যত্রও চলছে। পিট সিগার-এর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে, ‘হু কিলড নরমা জিন’ কিংবা ‘হু কিলড ডেভি মুর’-এর মতো গান। মুনাফা-সর্বস্ব সমাজ সব দায় ঝেড়ে ফেলে নিরুত্তর থেকে গিয়েছে। সেই অন্ধকার এখন আরও গভীরতর হয়েছে। কেন, উত্তর মেলেনি আজও।

রঞ্জন প্রসাদ, কলকাতা-৪০

শেষের অপেক্ষা?

কল্যাণ রুদ্রের “‘দেউলে’ হচ্ছে পৃথিবী’ (৩-৬) প্রবন্ধে কিছু সংযোজন করতে চাই। দ্য এন্ড অব নেচার বইয়ে বিল ম্যাকিবেন বলেছেন, ‘কী ঘটবে কে জানে’ পর্ব থেকে ‘এমন কি সত্যি ঘটতে পারে?’ পর্ব পার হয়ে আমরা এখন ‘ধ্যাৎ, এ কী করলাম’ পর্বে পা রেখেছি। এই সব কিছুরই পরিণতিতে ঘটে চলেছে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও নিত্যনতুন জীবাণুর জন্য নানা মহামারি ও অতিমারি সংক্রমণ।

ভারত-সহ বিশ্বের বহু দেশই তথাকথিত উন্নয়ন চায়। অথচ, উন্নয়নের স্থায়িত্ব তথা প্রকৃতির ভালমন্দ নিয়ে ভাবে না; দেশের কল্যাণকর দিকগুলো মাথায় রাখার প্রয়োজন মনে করে না। আসলে প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে নয়, ভাবা দরকার প্রকৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। প্রকৃতিকে জয় করার অদম্য ইচ্ছায় মানুষ নির্বিচারে ধ্বংস করে চলেছে প্রকৃতিকেই। যেমন খুশি লুট করছে প্রাকৃতিক সম্পদ। অরণ্য, জলাভূমি, ভূগর্ভস্থ জল, এবং খনিজ মূল্যবান সামগ্রী, যেখানে যা কিছুর খোঁজ মিলছে, কিছুই বাদ যাচ্ছে না মানুষের হিংস্র থাবা থেকে।

এই বছর পরিবেশ দিবসের ভাবনা ছিল, ‘পৃথিবী একটাই’। কিন্তু এই ভাবনাটা নতুন কিছু নয়, এই লক্ষ্যে বিশ্বের তাবড় কর্তাব্যক্তিরা আগেও পদক্ষেপ করেছিলেন। অর্থাৎ, প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হলে সে দায়টা সকলের। কিন্তু দশকের পর দশক বা শতক পার হয়ে এসে ‘পরিবেশ দিবস’-এর প্রাপ্তি থেকে যাচ্ছে শূন্য। ১৯৮০-২০০০ সালের মধ্যে ১০ কোটি হেক্টর ক্রান্তীয় অরণ্য হারিয়ে গিয়েছে। ১৯৭০-২০১৬ সালের মধ্যে পৃথিবীতে স্তন্যপায়ী প্রাণী, মাছ, পাখি, সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণীর সংখ্যা ৬৮ শতাংশ কমেছে। এই হারে আগ্রাসন অব্যাহত থাকলে পৃথিবীর মাত্র ১০ শতাংশ এলাকায় জঙ্গল টিকে থাকবে, ক্রমশ আরও উষ্ণ হয়ে উঠবে পৃথিবী। জলস্তর বৃদ্ধি পেতে পেতে এক সময় বিশ্বের বহু ভূখণ্ড হারিয়ে যাবে।

প্রাবন্ধিক যথার্থই বলেছেন যে, শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী পরিবেশের অবক্ষয় আজও অব্যাহত। ঠিক যে সময়কালের মধ্যে পৃথিবী থেকে বহু প্রাণ হারিয়ে গিয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে জনসংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছিল ৭৬০ কোটি। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, শুধুমাত্র কি মানুষের লোভের কারণেই প্রকৃতির এই পরিণাম? না, তা বোধ হয় নয়। সারা বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রও বিপন্ন হচ্ছে অনিবার্য ভাবেই। পৃথিবীর নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূখণ্ডে অধিক মানুষের জন্য অতিরিক্ত বাসস্থান, খাদ্য সঙ্কুলান ও যাতায়াতের জন্য সড়ক-রেলপথ নির্মাণ করতে হচ্ছে অরণ্য-জলাভূমি বিনষ্ট করে। কেউ কেউ অবশ্য যুক্তি দেখান, পৃথিবীতে প্রতি বছর ১৩০ কোটি টন খাদ্য অপচয় হয়, যা ৩০০ কোটি মানুষের ক্ষুধা মেটাতে পারে। প্রশ্ন হল, এই অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রকৃতির উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন আছে? প্রকৃতি এক সময় প্রতিশোধ নেবেই। ‘উপেক্ষিতা পল্লী’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “প্রকৃতিকে অতিক্রমণ কিছু দূর পর্যন্ত সয়, তার পরে আসে বিনাশের পালা।” এখন কি শেষের সে-দিনের অপেক্ষা?

শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া

দৃষ্টান্ত শ্রীতমা

রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা ও সুফল সম্বন্ধে সমাজের বেশির ভাগ মানুষই ওয়াকিবহাল। দুর্ভাগ্যবশত, আজও যত রক্তের প্রয়োজন হয়, তার চেয়ে অনেক কম রক্তই সংগৃহীত হয়।

আবার রক্তদানের তুলনায় দেহদানের প্রয়োজনীয়তা ও সুফল সম্বন্ধে প্রচার ততটা নেই, এবং এ ব্যাপারে আগ্রহও অনেক কম। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকে অঙ্গীকার করলেও মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের অনিচ্ছায় বা অজ্ঞানতার জন্য ওই ব্যক্তির দেহদান সম্ভব হয় না। এই পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রমী নিদর্শন হলেন হাওড়ার শিক্ষক দম্পতি নারায়ণ মণ্ডল ও মঞ্জুশ্রী বাজানি। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তাঁদের একমাত্র কন্যা ১০ বছরের শ্রীতমার দেহ দাহ করবেন না, মানবকল্যাণে দান করবেন (‘ছোট্ট শ্রীতমা রয়ে গেল পিজির অ্যানাটমি বিভাগে’, ৭-৬)। দীর্ঘ প্রায় সাত বছর ধরে শিশু শ্রীতমা এক কঠিন রোগের সঙ্গে লড়াই করেছে। তাঁদের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। নারায়ণ দম্পতি শ্রীতমার অঙ্গদান করতে চাইলেও, চিকিৎসার অঙ্গ হিসেবে রেডিয়েশন নেওয়ার জন্য তা সম্ভব ছিল না। তখন তাঁরা দেহ ও কর্নিয়া দানের কথা ভাবেন।

এখানে অন্য একটি ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৮ সালে দুর্গাপুজোর সময় রক্ত না পেয়ে মারা যায় বছর সাতেকের সৌভিক সামন্ত। তখন তার পরিবার দেহদানের সিদ্ধান্ত নেয়। আজও যেটি নীলরতন সরকার হাসপাতালে আছে। আশা করা যায়, এই দু’টি ঘটনার খবরে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক বেশি মানুষ দেহদানে এগিয়ে আসবেন।

পঙ্কজ সেনগুপ্ত, কোন্নগর হুগলি

আরও পড়ুন
Advertisement