Sound pollution

সম্পাদক সমীপেষু: শব্দের দাপট

শব্দদানবের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রতি বছর অত্যাচারীদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েক জন প্রতিবাদী শব্দশহিদও হয়েছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২২ ০৬:১৬
বেআইনি ভাবে ডিজে বক্স ব্যবহার, উচ্চৈঃস্বরে মাইক এবং শব্দবাজির অত্যাচারে মানুষের দুর্ভোগ হয় সবচেয়ে বেশি।

বেআইনি ভাবে ডিজে বক্স ব্যবহার, উচ্চৈঃস্বরে মাইক এবং শব্দবাজির অত্যাচারে মানুষের দুর্ভোগ হয় সবচেয়ে বেশি। ফাইল চিত্র।

‘উৎসবের হর্ষ ও বিষাদ’ (১৫-১১) উত্তর সম্পাদকীয় সম্পর্কে দু’একটি কথা বলতে চাই। পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ মানুষের উপর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় ও অন্য নানা উৎসবের অত্যাচারের কথা যথার্থ ভাবে বর্ণনা করেছেন লেখক। কিন্তু উৎসবের মরসুমে যে অত্যাচার এই বঙ্গের মানুষকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, এমনকি প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটায়, সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অনুল্লিখিত থেকে গিয়েছে দেখে আশ্চর্যও হলাম।

বেআইনি ভাবে ডিজে বক্স ব্যবহার, উচ্চৈঃস্বরে মাইক এবং শব্দবাজির অত্যাচারে মানুষের দুর্ভোগ হয় সবচেয়ে বেশি। সাধারণ মানুষ, বিশেষত শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ নাগরিকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে থাকেন, কারণ তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হন। ডিজে ও বাজির শব্দে কত শিশু বধির হয়ে যায়, কত বয়স্ক মানুষ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন, তার হিসাব কেউ রাখে না। আর যাদের কথা আমাদের ভাবনাতেই আসে না, সেই পশু ও পক্ষীকুল বিপুল সংখ্যায় প্রাণ হারায়।

Advertisement

শব্দদানবের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রতি বছর অত্যাচারীদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েক জন প্রতিবাদী শব্দশহিদও হয়েছেন। কিন্তু খুনিদের বিচারে শাস্তি হওয়ার ঘটনা শোনা যায় না। ডিজে এবং শব্দবাজির বিরুদ্ধে আইনসভায় আইন তৈরি হয়, আদালতের রায় ঘোষণা হয়, কিন্তু প্রশাসন যেমন নির্বিকার তেমনই থাকে। জনগণের মধ্যে সচেতনতাও তেমন বাড়ে না। উপরন্তু দেখা যায়, ডিজে এবং শব্দবাজি সহকারে বিসর্জনের শোভাযাত্রায় প্রশাসনিক আধিকারিকদের উপস্থিতি।

শেষে লেখকের কথার সঙ্গে সহমত হয়ে বলি, বহু লোকের চোখের জলে উৎসব বিষাদে পরিণত হলেও রাষ্ট্র কোনও দায় অনুভব করে না।

প্রদীপ বসু, নৈহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

নতুন রায়

জাতীয় পরিবেশ আদালত ১০ নভেম্বর এক ঐতিহাসিক রায়ে বলেছে, এখন থেকে অ্যামপ্লিফায়ার নির্মাতাদের ওই যন্ত্রের মধ্যেই ‘সাউন্ড লিমিটার’, অর্থাৎ ডেসিবেল সীমিত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কেউ শব্দের মাত্রার অপপ্রয়োগ না করতে পারে। মাননীয় বিচারপতিরা আরও বলেছেন, এই ভাবে শব্দ নিয়ন্ত্রণে সকল রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলকে শামিল হতে হবে। এটি নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের কল্যাণে এক গুরুত্বপূর্ণ রায়। এখন দেখার, প্রশাসন কী ভাবে এটিকে বাস্তবে রূপায়িত করে মানুষকে শব্দযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

মৃণাল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১০৭

সিরাজের জন্য

‘জীবন-কথক’ (কলকাতার কড়চা, ৫-১১) সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ মূলত জলে-ভেজা মাটি ঘেঁষা জীবনের রূপকার। জীবনের পদে পদে তিনি শুনেছেন অন্ত্যজ শ্রেণির পদধ্বনি। ব্রাত্যজীবনকে দেখেছেন গভীর ও ঘনিষ্ঠ করে। আর ভাষার পৌরুষ ও লাবণ্যের যুগল মন্দিরায় রচনা করেছেন জীবনের জটিল স্বরলিপি। বহরমপুরের সুপ্রভাত পত্রিকায় ইবলিশ ছদ্মনামে প্রকাশিত ‘কাঁচি’ তাঁর প্রথম গল্প। নীলঘরের নটী (১৯৬৬) সিরাজের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হলেও তাঁর পথ চলা শুরু কিংবদন্তীর নায়ক উপন্যাস দিয়ে।

ভিজে মাটির বুকভরা ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে সিরাজ দেখেছেন দ্বারকা নদীর অপরূপ সৌন্দর্য, লিখেছেন হিজলের প্রকৃতিলালিত মানুষের সুখ-দুঃখের বারমাস্যা সম্বলিত উপন্যাস তৃণভূমি। আবার যাঁরা সমাজে আবর্জনার শামিল, গ্রামের এক প্রান্তে আবর্জনার মতোই পড়ে থাকেন, তাঁদের কান্নাভেজা মন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন হিজলকন্যা উপন্যাস। মায়ামৃদঙ্গ তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস। তাঁর নিজের ভাষায়, “প্রথম যৌবনের ছ’সাতটা বছর, এখনকার বিবেচনায় খুব দামী আর সম্ভাবনাপূর্ণ ছ’সাতটা বছর— তার মানে, খুব কম করে ধরলেও আড়াই হাজার দিন আর আড়াই হাজার রাত, আমার যা নিয়ে এবং যাদের সঙ্গে সৌন্দর্য ও যন্ত্রণায় কেটে গেছে, তাই এবং তাদের নিয়েই এই উপন্যাস।” (ভূমিকা, মায়ামৃদঙ্গ)। আধুনিক বাংলা উপন্যাসে একটি উজ্জ্বল সংযোজন তাঁর অলীক মানুষ (১৯৮৮), যা চতুরঙ্গ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। লেখক নিজে বলেছেন, “রক্তমাংসের মানুষকে কেন্দ্র করে যে মিথ গড়ে ওঠে, সেই মিথই একসময় মানুষের প্রকৃত বাস্তব সত্তাকে নিজের কাছেই অস্পষ্ট এবং অর্থহীন করে তোলে। ব্যক্তিজীবনের এই ট্রাজেডি ‘অলীক মানুষ’ এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।” (কোরক, শারদীয়া সংখ্যা, ১৪০০ সাল)। এই উপন্যাসটি ভুয়ালকা পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার-সহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।

এর সূত্রেই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে ডি লিট (সাম্মানিক) উপাধিতে ভূষিত করে। আবার জীবনবোধ, জটিল মন ও সময়ের হাত ধরে উঠে এসেছে তাঁর প্রেম ঘৃণা দাহ, কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি’র মতো উপন্যাস। আবার তিনিই বিবেকের মর্মঘাতী চাবুক হাতে হাজির করেছেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে, যা পড়তে পড়তে মগজের কোষে তীব্র আলোড়ন শুরু হয়।

সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি

অযথা তিক্ততা

‘দিনটা ভাই আর বোনের সমান’ (১২-১১) শীর্ষক প্রবন্ধে রূপালী গঙ্গোপাধ্যায় বেশ একটা সহজিয়া সুরের ছটা ছড়াচ্ছিলেন। তাঁর বক্তব্য, দিনটি একান্তই ভাই এবং বোনেদের, কোনও পুজোআচ্চা নয়, নিখাদ ভালবাসার। ধনসম্পদের দেবীর পুজো শেষে দীপালিকায় আলো জ্বালিয়ে ঘোর অমানিশায় মা কালী আসেন ধরাধামে। তখন থেকেই অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু। ‘ভাইফোঁটা’ আসছে। বেশ গুছিয়ে সাতসকালে স্নান সেরে, ধুতি বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে দিদিদের বা বোনেদের শিশির-চন্দন বাটায় আঙুল ডুবিয়ে ঈষৎ ঠান্ডা ফোঁটা প্রাপ্তির পর প্লেট ভর্তি লুচি-আলুর দম, মিষ্টি ইত্যাদি পেট পুরে খাওয়া, উপহার আদান-প্রদান, সারা দিন হইচই— কোনওটিই বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়ার নয়। কিন্তু, কখনও তো মনে হয়নি, আমাদের ফোঁটা পাওয়ার মধ্যে বোন বা দিদিদের কম গুরুত্বপূর্ণ করা হয়! দিনটির পুরোভাগে থাকে বোনেরা। আজকের দিনে যাঁদের বোন বা ভাই নেই, তাঁরাও অফিসতুতো-পাড়াতুতো ভাই-বোনদের সঙ্গে ভাইফোঁটার আনন্দ ভাগ করে নেন। পথশিশু বা অনাথ আশ্রমের শিশুরাও বঞ্চিত হয় না। বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েও অরাজনৈতিক সংগঠনের তরফে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালন করা হয়।

কিন্তু এমন পবিত্র দিনটি নিয়েও নারীবাদীরা পুরুষ জাতটাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দোষী হিসেবে দেগে দিয়ে কোন আনন্দ লাভ করেন? কেন বেচারি মা দুর্গা কোনও দিন ভাইফোঁটা দিতে পারেননি, সে কথাটা কখনও মনেই আসেনি। গোটা শারদোৎসবটাই তো গল্পগাথা। দুর্গার সঙ্গে তাঁর চার ছেলে-মেয়েকে জুড়ে দিয়ে যে পারিবারিক বাঙালিয়ানার আবহ তৈরি হয়েছে, তাতে আগমনী থেকে বিজয়ার সুর রচিত হয় কাব্যে, গানে। মা দুর্গার একটা ভাই থাকলে তিনি আবার পিতৃগৃহে আসতেন, ব্যাপারটা বেশ মানানসই হত, কোনও খেদ থাকত না নারীদের— এমনটাই তো ভাবনা? তা, চালু করে দিলেই হয়। কিন্তু, পবিত্র দিনটিকে অযথা ‘পিতৃতান্ত্রিক’ দেগে দেবেন না। প্রাক্-করোনাকালে এই পত্রলেখক এক বার সাতসকালে দমদম পার্কে দিদির বাড়িতে ফোঁটা নিয়ে, দশটার ফ্লাইট ধরে বাগডোগরায় পৌঁছেছিল। সেখান থেকে ভাড়া-গাড়িতে শিলিগুড়িতে আর এক দিদির বাড়িতে ফোঁটা নিয়ে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন শেষে, সন্ধেবেলায় জলপাইগুড়িতে দুই বোনের কাছে ফোঁটা নিয়ে, পর দিন ফিরেছে কলকাতায়। বোনেরা ভাইয়ের মঙ্গলার্থে ফোঁটা দিয়ে থাকেন। ভাইরাও আন্তরিক ভাবে বোনেদের মঙ্গল কামনা করেন। এই দিনটির এটুকু মাহাত্ম্যই কি মর্যাদা পেতে পারে না?

ধ্রুবজ্যোতি বাগচি, কলকাতা-১২৫

আরও পড়ুন
Advertisement