কোভিড-১৯ আমাদের প্রচলিত অভ্যাসগুলোকে বদলে দিয়েছে। শহরের মধ্যবিত্ত মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি কম্পিউটার-নির্ভর হয়েছেন। অভিরূপ সরকারের ‘অন্ধকারে তবু সামান্য আলো’ (৩১-১২) প্রবন্ধটি একটি যথাযথ মূল্যায়ন। ভিড় এড়াতে আজকাল দোকানে গিয়ে মানুষ জিনিসপত্র কেনার বদলে অনলাইনে কেনাকাটা সারছেন। অযথা সময় নষ্ট করার চেয়ে ঘরে বসে মোবাইলে সংসারের দৈনন্দিন জিনিসের অর্ডার দিলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঘরের দরজায় সমস্ত জিনিস নিয়ে হাজির হচ্ছেন ডেলিভারি বয়রা। দামও দিতে হচ্ছে না ক্যাশে। সবটাই অনলাইনে হয়ে যাচ্ছে। করোনাকালে এই অনলাইন কেনাকাটায় ঘরের বাইরে বেরোনোর প্রয়োজন যেমন নেই, তেমনই অপরিচিত মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বা ছোঁয়াছুঁয়ির আশঙ্কাও থাকে না।
এই নতুন লেনদেন ব্যবস্থায় কিছু লোক যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনই নয়া কর্মসংস্থানের দিশাও দেখা দিয়েছে। অনেক বেকার ছেলে এই ডেলিভারির কাজে নিযুক্ত হয়েছেন। এর সঙ্গে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা— আরও বেশি সংখ্যায় মানুষকে আকৃষ্ট করে এই অনলাইন কেনাকাটায় শামিল করতে। নতুন এই অনলাইন কেনাকাটা সাধারণ মানুষের কাছে আজ আকর্ষণীয়। যে কোনও কেনাকাটায় বিপুল ছাড়, এমআরপি থেকে কম দামের কারণে এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। প্রশ্ন জাগে, এত কম দামে কী ভাবে চলছে এই বিকিকিনি? এতে তো পাড়ার মোড়ের দোকানের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়বে। অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অনেক সাধারণ গ্রাহক পণ্য কিনে নানা ভাবে প্রতারণারও িশকার হচ্ছেন। ঠিক পণ্য সরবরাহ না করে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। পুরনো ব্যবস্থা থেকে একটি নতুন ব্যবস্থায় উত্তরণ সহজ নয়, আর সেই উত্তরণকে তরান্বিত করতে বিশ্বাসের মানদণ্ডটি মজবুত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় কি?
উৎপল মুখোপাধ্যায়, চন্দননগর, হুগলি
শিক্ষা নেবে কি
‘ট্রেনের ভিড়ে রাশ দেবে কে, পড়ে মৃত্যু প্রৌঢ়ের’ শীর্ষক সংবাদটি (৫-১) পড়ে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ট্রেনের সংখ্যা কমিয়ে ভিড় কমানোর মধ্যে দিয়ে করোনার সংক্রমণে বাধা সৃষ্টি করার চিন্তা কতখানি ভ্রান্ত। দুঃখের কথা, এত দিনেও তা শেখেনি সরকার। কেউ বিচার বিবেচনা করে পা ফেলে, কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে শেখে। এখানে তার কোনওটাই দেখা গেল না। চন্দন প্রচণ্ডের (৫৫) মর্মান্তিক মৃত্যু সরকারকে নতুন করে ভাবাবে কি না, জানি না। তবে করোনার অগ্রগমনে রাশ টানতে ট্রেন বা বাসের সংখ্যা অর্ধেক নয় বা কম সময় চালানো নয়, বরং সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে। শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা সংক্রমণ ঠেকানোর প্রশ্নে অন্যতম বিষয়। আর সেটা ট্রেন-বাসের সংখ্যা বা সময় কমিয়ে কি কখনও সম্ভব? বরং করোনাকে প্রকারান্তরে তা বাড়তে সাহায্য করবে।
তা ছাড়া করোনাকে বাড়তে সাহায্য করেছে পুরভোট, বড়দিন, বর্ষশেষ, বর্ষবরণের বাধাবন্ধনহীন রকমারি অনুষ্ঠান। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখলেও সিনেমা-থিয়েটার, রেস্তরাঁ-পানশালা খুলে রাখা হয়েছে। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক জমায়েত বন্ধ রাখার জন্য সরকার বা নির্বাচন কমিশনের কোন আগ্রহই তেমন চোখে পড়ল না। এর পর জনগণকে প্রতিনিয়ত উপদেশ দেওয়া হচ্ছে— মাস্ক পরো, দূরত্ববিধি বজায় রাখো, সাবান বা স্যানিটাইজ়ার সহযোগে হাত-মুখ প্রতিনিয়ত পরিষ্কার রাখো ইত্যাদি। এ যেন চোরকে বলা হচ্ছে চুরি করতে আর গৃহস্থকে সজাগ থাকতে। সবটার মধ্যেই কেমন যেন বিবিধ মুনাফা আর ব্যালটের হিসাব-নিকাশের গন্ধ। জনগণের স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালনের প্রতিনিয়ত প্রচারও বোধ করি সেই হিসাবেরই এক অঙ্গ।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
নিষ্ক্রিয়তা
এক দিকে বর্ষশেষ, বর্ষবরণে জনগণের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, তার সঙ্গে ভোট দোসর। ডিসেম্বর, ২০২১-এ কলকাতা পুর-নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। সামনেই রাজ্যের আরও চারটি পুরনিগমে ভোট ‘উৎসব’ উদ্যাপিত হতে চলেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে বাকি পুরসভাগুলির নির্বাচন হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ-সহ সমগ্র ভারতে করোনার তৃতীয় ঢেউ এসে গিয়েছে। এই অবস্থায় সামনের এই সব নির্বাচনের পর রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে গত বছর বিধানসভা নির্বাচন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ডেকে এনেছিল। সেই প্রসঙ্গে মহামান্য আদালত নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল। কমিশন যে কোভিডবিধি মেনে নির্বাচন করতে বলেছিল, সেটা কোনও রাজনৈতিক দলই মানেনি। এক দিকে দিল্লি থেকে পরিযায়ী নেতারা যেমন উড়ে এসে করোনা বৃদ্ধিতে অনুঘটকের কাজ করেছেন, তেমনই রাজ্যের নেতারাও কোনও অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। কিন্তু এই সব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও যথাযথ ছিল না। তারা শুধুমাত্র প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করেই নিজেদের দায়িত্ব সেরেছিল। এ বার কলকাতার পুর নির্বাচনের সময়ও একটি গাইডলাইন প্রকাশ করেছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। বিধানসভার মতো সে ক্ষেত্রেও কোনও রাজনৈতিক দলই তা মানেনি। দিকে দিকে বিজয়োল্লাস হয়েছে, তাও কমিশন চুপ করে থেকেছে। আর রাজনৈতিক নেতারাও তাঁদের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনও চেষ্টা করেননি। এ ভাবে খেলা ভাঙার খেলায় মেতে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলি। নির্বাচন কমিশন চোখ বন্ধ করে থেকেছে আর করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে নিজেদের কিছুটা ভূমিকা রেখে গিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক সংস্থার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আজ করোনা বৃদ্ধির পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
চন্দ্র মোহন নন্দী, কসবা, হালতু
আগুনে ঝাঁপ
‘হুল্লোড়ে উড়ে গেল বিধি’ (১-১) খবরে জানা গেল, বর্ষশেষ উৎসবে কোনও রকম করোনাবিধি না মেনে কলকাতার মতোই দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়ং, লাটাগুড়ি, দিঘা, মন্দারমণি, বিষ্ণুপুর, মুকুটমণিপুর, মায়াপুর ইস্কন মন্দির, ব্যান্ডেল চার্চ ইত্যাদি সর্বত্র প্রচুর জনসমাগম হয়েছে। মানুষ হুল্লোড়ে মেতেছেন। অবাক লাগে যখন ডাক্তাররা ওমিক্রনের সাংঘাতিক সংক্রমণ ক্ষমতা নিয়ে বলছেন, সংবাদমাধ্যমে আমরা জানতে পারছি প্রতি দিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে, তখন মানুষ এত অসচেতন হলেন কী করে? আমরা কি দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম? রক্ত নেই, অক্সিজেন নেই, রোগীর তুলনায় হাসপাতালে বেডও ছিল অপ্রতুল। মানুষ অন্তিম নিশ্বাস নিতে নিতে বারান্দায় বসে সেখানেই মারা গিয়েছেন, হাসপাতালের গেটের সামনে মানুষ মরে পড়েছিলেন, এ সব কি স্মৃতি থেকে এত তাড়াতাড়ি মুছে গেল?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গঙ্গাসাগর মেলার প্রস্তুতিতে গিয়ে বললেন, ওমিক্রন অতটা ভয়াবহ নয়, তবু মানুষ যেন সাবধানে থাকেন। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি ওমিক্রনেও মানুষ মারা যাচ্ছেন। ব্যাপক এর সংক্রমণের ক্ষমতা। খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠার ছবিতে দেখা গেল, বর্ষশেষের রাতে মুম্বইয়ের গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া করোনা নিয়ন্ত্রণের আদেশে যেখানে শুনশান, সেখানে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে প্রচুর মানুষের হুল্লোড়। যাঁরা ফ্রন্টলাইনে নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই ডাক্তারবাবুদের সাবধানবাণীতে মুখ্যমন্ত্রী নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ছয়-সাত হাজার ছাত্র সমাগমে তাঁর বক্তৃতা বন্ধ রাখলেন। পুলিশ মহল পার্ক স্ট্রিট, মিলেনিয়াম পার্ক, দিঘা— সর্বত্র কঠিন পরিশ্রম করে মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে অনেক পুলিশ, ডাক্তার, রেলকর্মী করোনা-আক্রান্ত। আমাদের হুঁশ কখন ফিরবে?
শিখা সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১