বিমল কর সম্পর্কে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “ঋণ রেখে যাননি, আমরাই ঋণী তাঁর কাছে।” আবার এমনটাও বলা যায়, আমরাও ঋণী শীর্ষেন্দুবাবুর কলমের কাছে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুণপোকা প্রাথমিক ভাবে সর্বসাধারণের মধ্যে সে ভাবে সাড়া জাগায়নি, মুগ্ধ করেছিল একটু উচ্চাঙ্গের পাঠককে। তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন, জাত লেখক ছাড়া এ জাতীয় রচনা সম্ভব নয়। তাঁদের সে অনুমান যে ভ্রান্ত ছিল না, কথাকারের পরবর্তী সৃষ্টিসমূহই তার প্রমাণ বহন করে চলেছে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা অনেকটা বাতাবি লেবুর মতো। খোসাটা নরম ঠিকই, তবে ছাড়াতে একটু কসরত করতে হবে। তার পর ভিতরে রস। এই বল্কল-উন্মোচনের কষ্টটুকু তিনি পাঠককে দিয়ে করিয়ে নেন। যিনি সেইটুকু শ্রম স্বীকার করতে রাজি নন, তেমন পাঠক বোধ হয় এ-লেখক চান না। চির-তুলনাপ্রিয় বাঙালিদের অনেককে তাই বলতে শুনি, “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা অনেক সহজ, এক বার পড়লেই বোঝা যায়। কিন্তু শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যে কী লেখেন, পড়ে কিছু ধরতে পারি না।” ‘স্বপ্নের ভিতরে মৃত্যু’ লেখাটি সম্পর্কে লেখক স্বয়ং বলছেন, “এ গল্প লিখতে গিয়ে আমার নিজেরই লেখালিখির জীবনের মৃত্যু-লক্ষণ ফুটে উঠেছিল।” কিন্তু পাঠক জানেন, সে মৃত্যু সাহিত্যের জীবন-গান গেয়েছে।
প্রতি বছর শারদীয়া আনন্দমেলা-য় তাঁর উপন্যাস এক বিশেষ আকর্ষণ। তাঁর কাহিনির ভূতরা ততখানি ভয়ঙ্কর নয়, যতখানি উপকারী, মজাদার। লেখক বলছেন, “ভূতকে নিয়ে ভয়ের গল্পের চেয়ে মজার গল্প লিখতেই আমার বেশি ভাল লাগে।... আর লেখায় প্লটের অভাব কখনও আমি অনুভব করিনি।” অনেকেই শুনলে অবাক হবেন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। অথচ, দু’জনের স্বভাবে কী বিপুল পার্থক্য, বলার অপেক্ষা রাখে না।
কলকাতা বইমেলায় তাঁকে দেখেছিলাম সতেরো-আঠারো বছর আগে এক সন্ধ্যায়। সে আসরে বুদ্ধদেব গুহ, নবনীতা দেব সেন, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শীর্ষেন্দুবাবুকে দেখেছিলাম চুপ করে এক দিকে বসে রয়েছেন। যেন বহু মানুষের ভিড়েও তিনি স্বতন্ত্র। আজ বুদ্ধদেববাবু নেই। কিন্তু তাঁর সেই দিনকার মন্দ্রকণ্ঠ এখনও কানে বাজে— “...এমনিতেই আমি শীর্ষেন্দুর লেখার খুব ভক্ত। কী গভীরতা! আর কত ধরনের প্লট, কত বৈচিত্র। ও যে কোথা থেকে এত রসদ পায়, ও-ই জানে।”
সুগত ত্রিপাঠী
মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর
উধাও দেশি মাছ
বাঙালির রসনা বিলাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে বাংলার খালবিলের চুনোমাছ। মৌরলা মাছের বাটিচচ্চড়ি, মৌরলার পাতুরির স্বাদ ইলিশের পাতুরির থেকে কম কিছু ছিল না। পূর্ববঙ্গের পদে থাকত চালকুমড়োর পাতায় মৌরলা মাছের ভাতে। পুঁটিমাছের ভাজা, চাঁদামাছের টক, তেলকই থেকে শিঙি-মাগুরের ঝোল যেমন সর্বসাধারণের লোভনীয় পদ, তেমনই ছিল রোগীর পথ্য। লাউ-চিংড়ি, চিংড়ির সঙ্গে অমর্ত্যমান বা দুধমান কচুপাতার ভাপার আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার। বাংলার এই সব মাছ শুধু রান্নাঘরে নয়, কাব্যে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতেও জায়গা করে নিয়েছিল।
বিশ-পঁচিশ বছর আগেও বাংলার খাল, বিল থেকে সহজেই মিলত বিভিন্ন ধরনের চুনো ও জিওল মাছ। পুঁটি, মৌরলা, খলসে, চাঁদা, কুচো চিংড়ি, নয়না বা ন্যাদস, বেলে, চেঙো, ফলুই, বাটা, আমুদি, কই, ল্যাটা, পাঁকাল, খয়রা প্রভৃতি মাছ গ্ৰামের মানুষকে বেশির ভাগ সময় কিনতে হত না। বর্ষাকালে যেমন ঘুনি, আটল, মুগরি অথবা ফাঁদি জাল টাঙিয়ে ধরা হত, তেমনই গ্রীষ্মের সময় জল কমে এলে ছাঁকনি জাল দিয়ে, কখনও গামছা ও মশারি দিয়ে নানা রকমের মাছ ধরা গ্রামগঞ্জে স্থানীয় উৎসবের আকার নিত। হাতছিপ, ঢিল, খোলা জাল (খোলাম কুচিকে নাইলনের সুতো দিয়ে গেঁথে এক ধরনের জাল), পোলো, কুড়োর ঝুলি, মাটির কলসি ফুটো করে জলে ডুবিয়ে, এমনকি ঘাটে কাঁসার থালায় চামচ দিয়ে কম্পন তৈরি করেও মাছ ধরা যেত।
কিন্তু অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই চিত্রটা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু এই মাছগুলো গ্রামবাংলা থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে বা বিলুপ্তির পথে। চুনোমাছ কমে যাওয়ার ফলে শাল, শোল, বোয়াল ইত্যাদি যে মাছ চুনোমাছ খেয়ে বেঁচে থাকত, তারাও বিলুপ্তির পথে। যদিও বা কোথাও পাওয়া যায়, তার দাম সাধারণের সাধ্যের বাইরে। এই বিলুপ্তির কারণ নির্বিচারে কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার। কৃষিক্ষেত্রের এই বিষ জলে মিশে সমস্ত দেশীয় প্রজাতির মাছ নষ্ট করে দিচ্ছে। বেশির ভাগ পুকুর বা জলাশয়গুলোতে আগে এই সব মাছের স্বাভাবিক প্রজনন হত। সেখানে এখন বাণিজ্যিক ভাবে মাছ চাষ হচ্ছে। নানা ভাবে মানুষের আগ্রাসনের ফলে গ্রামগঞ্জের জলাভূমি, যেখানে এই মাছেরা স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠত, সেগুলো জমি মাফিয়াদের হাতে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অতি দ্রুত লাভের আশায় এখন বিভিন্ন ধরনের বিদেশি প্রজাতির মাছ চাষ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। হাইব্রিড মাগুর, গ্ৰাস কার্প, পাঙস, রূপচাঁদা ইত্যাদি মাছ আমাদের ছোট দেশীয় মাছগুলিকে খেয়ে ফেলছে। গ্রামের পতিত জলাশয়ে অন্য কোনও মাছ না জন্মালেও শাল, শোল, ল্যাটা, কই ইত্যাদি জিওল জাতীয় মাছ জন্মাত। এই মাছগুলো মশা-সহ অন্যান্য ক্ষতিকারক লার্ভা ও পোকামাকড় খেয়ে উপকারও করত। সেই পতিত জলাশয়গুলোও ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
কয়েক বছর যাবৎ রাজ্য সরকার এই দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছগুলিকে রক্ষার জন্য চুনোমাছ উৎসব করছে। এটা ইতিবাচক উদ্যোগ। কিন্তু যে কারণে আজ এই মাছগুলি বিলুপ্তপ্রায়, সেই সমস্যার সমাধান না করলে উৎসবটাই মুখ্য হবে, দেশীয় মাছকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্য আর পূরণ হবে না।
অজয় দাস
উলুবেড়িয়া, হাওড়া
পুলিশ দিবস
আমার দাদু ছিলেন পুলিশের দারোগা। বাবা চাকরি করতেন ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশে। আমার ছোট কাকা ছিলেন আইবি ডিপার্টমেন্টে। ২১ অক্টোবর ‘পুলিশ দিবস’ অথবা ‘পুলিশ স্মরণ দিবস’ নামে পরিচিত। এই দিনটা আমার বুক গর্বে ভরে ওঠে দাদু, বাবা, ছোট কাকা এবং সমগ্র পুলিশ বাহিনীর জন্য।
পুলিশ বাহিনী প্রতিটি রাজ্যের এবং দেশের একটি সাহায্যকারী আবশ্যিক অঙ্গ, যে কোনও সঙ্কটের প্রথম উত্তরদাতা, আইনশৃঙ্খলার প্রতীক। ছোটবেলায় বাবা বুঝিয়েছিলেন, কেন ২১ অক্টোবর ‘পুলিশ স্মরণ দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়। ১৯৬১ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ অক্টোবর ‘পুলিশ স্মরণ দিবস’ পুলিশের কর্তব্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী শহিদদের স্মরণে শ্রদ্ধার চিহ্ন হিসাবে উদ্যাপন করা হয়। এই দিনটি ১৯৫৯ সালের হট স্প্রিংয়ের ঘটনার স্মরণে পালিত হয়। উত্তর-পূর্ব লাদাখের হট স্প্রিংয়ে চিনা সেনারা এক দল পুলিশকর্মীকে আক্রমণ করেছিল। এ ঘটনায় ১০ জন পুলিশকর্মী নিহত হন এবং ৭ জনকে আটক করা হয়। ২৮ নভেম্বর ১০ জন পুলিশ শহিদের মরদেহ হস্তান্তর করার পর যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দাহ করা হয়েছিল। ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল, ২১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘পুলিশ স্মরণ দিবস’ হিসাবে পালিত হবে, নিহত পুলিশকর্মীদের আত্মত্যাগ এবং তাঁদের স্মরণার্থে।
এই দিনটি আমাদের দেশে পুলিশ বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত কর্তব্যগুলির বহুমুখী মাত্রা সম্পর্কে একটি অন্তর্দৃষ্টি দেয়। আইনশৃঙ্খলা ছাড়া সমাজ কল্পনা করা অসম্ভব, এবং পুলিশকর্মীরা এই ধরনের স্বীকৃতি এবং সম্মানের প্রাপ্য। পুলিশ অফিসারদের জন্য এই ধরনের দিন উদ্যাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পুলিশ বাহিনীতে যোগদানকারী নতুন কর্মীদের মধ্যেও একই নৈতিকতা জাগায়। পুলিশ আমাদেরই এক জন এবং এই বিশ্বাস সমাজে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
সুপ্রিয় দেবরায়
অলকাপুরী, গুজরাত