বালি আবার বালিতে ফিরে এল (‘আলাদা হয়ে বালি পুরসভা ফিরছে তার পুরনো অবস্থানে’, ১০-১১)। ২০১৫ সালে বালিকে যুক্ত করা হয়েছিল হাওড়ার সঙ্গে। নিজস্ব পুরসভা হারিয়ে সঙ্কট দেখা দিয়েছিল আত্মপরিচয়ের। তখনই আপত্তি জানানো হয়। এখন মুক্তির আনন্দ। হবে না-ই বা কেন? এখানে ভটচায্যি বাড়ির ছেলে, সকলের কাছে যিনি ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বলে সুপরিচিত, গান গেয়ে অনেক দিন আগেই বলে গিয়েছেন, ‘মাটিতে জন্ম নিলাম মাটি তাই রক্তে মিশেছে’।
হাওড়া পুরসভা অনেক দূরে। আট মাইলের ব্যবধান। খানাখন্দে হোঁচট খেলে, রাস্তার বাতি নিবে গেলে, মৃত পশুর দেহ গন্ধ ছড়ালে সঙ্গে সঙ্গে পুরসভায় যাওয়া যাচ্ছিল না। বালির পাঁচ-পাঁচটা রেল স্টেশনের যাত্রীদের অসংখ্য সমস্যা অনুধাবন করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই ক’মাসে জলে ডুবে থাকা বেলুড় স্টেশনের খবর কেউ নেননি। বৃষ্টি আর তার সঙ্গে গঙ্গার জোয়ারের জল মানুষের দুর্ভোগকে কোন অবস্থায় নিয়ে যায়, অত দূর থেকে তা কোনও মতেই বুঝতে পারা সম্ভব নয়।
পুরপিতাদের পুর পরিষেবার সঙ্গে বালির ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতির পুনরুদ্ধারও খুবই জরুরি। এখনও হদিস মেলেনি বালির মেয়ে, দেশের প্রথম মহিলা রাজবন্দি ননীবালা দেবীর জন্মভিটার। শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়নি নেতাজির ভাইঝি বীরাঙ্গনা বেলা মিত্রকে, যিনি সে দিনের বালির আওতায় থাকা অভয়নগরের জন্য প্রাণপাত করেছিলেন। ভাল করে জানলই না কেউ যে, এখানে লালাবাবু সায়র রোডে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়িতে দীক্ষাদান করে স্বামীজি যে মেয়েটিকে নতুন পরিচয় দিলেন, তাঁর নাম ভগিনী নিবেদিতা। চূড়ান্ত অবহেলায় পড়ে আছে অক্ষয়কুমার দত্তের বিশাল বাগান বাড়িটি। ঠিক করে জানা হয়নি কোন কোন বাড়িতে বসে বিদ্যাসাগর মশাই বিধবা বিবাহের অস্ত্রে শাণ দিয়েছিলেন। এ সব শুধু জানলে হবে না, সেগুলিকে ফিরেও পেতে হবে। এমনকি বিদ্যাদেবীর সামনে নামতা পড়ার সেই গানটিও।
অরুণকান্তি দত্ত
বালি, হাওড়া
একটি মৃত্যু
‘ফুসফুসে বাসা বাঁধে অবহেলা’ (১-১১) শীর্ষক প্রবন্ধে প্রিয়ব্রত ভৌমিক সিলিকোসিস-আক্রান্ত শ্রমিক আবু জ়াফর মল্লিকের উল্লেখ করেছেন। প্রবন্ধটি প্রকাশ পাওয়ার ছ’দিন পরে বছর ৪৫-এর আবু জ়াফর মারা গেলেন। তিনি ছিলেন দেগঙ্গার এক সাধারণ চাষি, ১৭-১৮ বছর আগে রোজগারের আশায় আসানসোল-জামুড়িয়ার স্টোন ক্রাশারে পাথর ভাঙার কাজ করতে গিয়েছিলেন। সাত-আট বছর কাজ করে ২০১১ সালে ফিরে এলেন অসহ্য শ্বাসকষ্ট নিয়ে। সিলিকোসিস নামক মারণরোগের নামও শোনেননি তখনও। ২০১১ সালেই আর জি কর হাসপাতালে শ্বাসকষ্টের কথা ডাক্তাররা রেকর্ড করলেন, চেস্ট এক্স-রে হল, যথারীতি যক্ষ্মার কথাও উঠে এল, যা সিলিকোসিস আক্রান্তদের সঙ্গী, এবং যার পোশাকি নাম হল সিলিকো-টিউবারকিউলোসিস।
কিছু কাল বাদে আবু জ়াফরের মুখ থেকে নিয়মিত রক্ত ওঠা শুরু হয়ে গেল। ২০১৯ সালের এপ্রিলে বারাসত হাসপাতালের ডাক্তার লিখলেন সিলিকোসিস এবং মুখ দিয়ে রক্ত ওঠার সমস্যার কথা। এর পরে আমাদের সংগঠনের লাগাতার চাপে প্রশাসন সম্ভাব্য আক্রান্তদের চেস্ট এক্স-রে করা শুরু করল। আমরা মনে করি যে, রাজ্য জুড়ে এমন অগণিত মানুষের রোগনির্ণয় ও আক্রান্তদের চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব শুধু রাজ্য সরকারই নিতে পারে, কোনও অসরকারি সংগঠনের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয় এবং উচিতও নয়। কারণ, এই সব মানুষের মৃত্যুর কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেআইনি কারখানা, যেগুলো চলতে দেওয়ার অপরাধ তো সরকারেরই। মহামান্য উচ্চ আদালতও সেই কারণে এমন নির্দেশই দিয়ে রেখেছে।
আবু জ়াফর একা নন, শুধু দেগঙ্গাতেই মাত্র চারটে গ্রামে অন্তত ৬৫ জন সম্ভাব্য সিলিকোসিস-আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। তাঁদের অন্তত পাঁচ জন ইতিমধ্যেই মৃত। একাধিক ক্ষেত্রে সিলিকোসিস চিহ্নিত হলেও, এবং রাজ্য প্রশাসনের কাছে বার বার আবেদন জানিয়েও, অসহায় পরিবারগুলোর কাছে ছিটেফোঁটা ক্ষতিপূরণ পৌঁছয়নি। যা-ই হোক, এই সব মানুষের চেস্ট এক্স-রে শুরু হলেও লাভ হল না বিশেষ, কারণ দেগঙ্গার ব্লক আধিকারিক সেই সব এক্স-রে প্লেট রোগনির্ণয়ের জন্য সরকারি চিকিৎসকদের সিলিকোসিস বোর্ডে পাঠালেন না। আশঙ্কা, ওঁর অফিসেই সেগুলো পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে। এই নির্মম উদাসীনতার দৃষ্টান্ত আবু জ়াফর, যাঁর চেস্ট এক্স-রে প্লেট সংগ্রহ করানো হয় ব্লক আধিকারিক মারফত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, বেড়াচাঁপার এক বেসরকারি পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে। পরীক্ষাকেন্দ্রের চিকিৎসক ফুসফুসের দুরবস্থার কথা লিখলেও, ব্লক আধিকারিক বা ব্লক মেডিক্যাল অফিসার নির্বিকার থাকলেন, এবং জ়াফরের হাতে ওই ইংরেজিতে লেখা রিপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে (যা রোগীর পরিবারের কেউ আজও পড়তে পারেননি) বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সেপ্টেম্বর, ২০২০ থেকে নভেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার আবুর রোগনির্ণয় করে উঠতে পারেনি। যদিও এর মধ্যে ঘটা করে সরকারি ডাক্তারদের সিলিকোসিস কর্মশালা হয়ে গিয়েছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে, ১২ নভেম্বর, ২০২০ সালে। প্রবল যন্ত্রণা নিয়ে আবু জ়াফর হাসপাতালে ভর্তি হলেন মার্চ, ২০২০ সালে। এই দফায় আর জি করের ডাক্তাররা সরাসরি লিখলেন সিলিকোসিস, ম্যাসিভ ফাইব্রোসিস এবং আরও নানা সমস্যার কথা। সঙ্গে স্পষ্ট লিখলেন আবু জ়াফরের পাথর কারখানায় শ্রমিকজীবনের কথা। এই রিপোর্ট নিয়ে আবু জ়াফর বাড়ি ফিরে এলেন। শুরু হল যক্ষ্মার চিকিৎসা, কিন্তু অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকল। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ভূমিকা দেখা গেল দেগঙ্গার ব্লক আধিকারিক এবং ব্লক মেডিক্যাল অফিসারের। ৩০ অক্টোবর, ২০২১ তারিখে ব্লক মেডিক্যাল অফিসার নির্বিকার চিত্তে জানালেন, আবু জ়াফর তেমন গুরুতর অসুস্থ বলে উনি মনে করেন না!
এক দিকে সরকারি কর্মীদের এই অসংবেদনশীলতা, আর অন্য দিকে এত বছর বাদেও সরকারের সিলিকোসিস নিয়ে নির্দিষ্ট নীতি গ্রহণে (আদালত ও মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশ সত্ত্বেও) ও বেআইনি ক্রাশারকে আইনের আওতায় এনে শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অনিচ্ছা— এই দুইয়ের ফাঁসে পড়ে নিহত হলেন আবু জ়াফর মল্লিক। গ্রাম কালিয়ানি, থানা দেগঙ্গা, সময় ৭ নভেম্বর, ভোর চারটে।
রাজ্জাক মোল্লা
সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি
উপোস-বিধি
‘উপোস কখন উপকারী’ (পত্রিকা, ৬-১১) প্রসঙ্গে বলি, অনেকে উপোস চলাকালীন চা, কফি পান করেন বার বার। এটা কিন্তু স্বাস্থ্যের পরিপন্থী। নির্জলা উপবাস ভাল কি না, তা-ও বিবেচনা করা উচিত। উপবাস ভঙ্গের পর কী খাবার খেতে হবে, তার পরিমাণ কতটা, সে দিকেও নজর দিতে হবে। যা ইচ্ছে খেয়ে নিলে শরীর খারাপ হতে পারে। উপোস ভঙ্গের পর অনেকে তেলেভাজা, লুচি, মিষ্টি এ সব খেয়ে থাকেন। এমনও দেখেছি, অনেকে পর পর দু’দিন উপবাস করেন, নজর দেন না শরীরের দিকে। শরীর সুস্থ থাকলে তবেই তো ধর্মাচরণ।
উৎপল মুখোপাধ্যায়
চন্দননগর, হুগলি
ভোলার ক্ষমতা
পুজো উপলক্ষে দোকানে, পার্লারে, শপিং মলে মাস্কবিহীন মানুষের উপচে-পড়া ভিড় দেখে মনে হয়েছে, করোনা আমাদের কিচ্ছুটি করতে পারেনি, পারবেও না। আমাদের অর্থনীতি ভাঙেনি, উৎসাহ দমেনি, মনোবল কমেনি। ভয়কে জয় করা নিশ্চয়ই বীরত্বের কাজ। কিন্তু এই সর্বনাশা বীরত্বকে সমর্থন করা যায় না। এই উৎসব থেকে বুঝলাম যে, ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের স্মৃতিও মানুষ বেশি দিন মনে রাখতে পারে না।
সাধন দাস
ভৈরবটোলা, মুর্শিদাবাদ