National Education Policy

সম্পাদক সমীপেষু: কেন্দ্রের পথেই

২০২০ সালে অগণতান্ত্রিক ভাবে সংসদকে উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় জাতীয় শিক্ষানীতি পাশ হওয়ার পর থেকেই দেশের সর্বত্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৪৫
Protest against National Education Policy.

একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে সে দেশের শিক্ষানীতি। ফাইল চিত্র।

শিক্ষাক্ষেত্রে দেশ সঙ্কটের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাম্প্রতিক নির্দেশিকাটি কার্যত শিক্ষাকে খাদের ভিতর ঠেলে দিল। ‘গোঁজামিল’ (২১-৩) সম্পাদকীয়টি যে দৃঢ়তার সঙ্গে এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত করেছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। ২০২০ সালে অগণতান্ত্রিক ভাবে সংসদকে উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় জাতীয় শিক্ষানীতি পাশ হওয়ার পর থেকেই দেশের সর্বত্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে সে দেশের শিক্ষানীতি। এই শিক্ষানীতি যে গণতান্ত্রিক, সর্বজনীন, ধর্মনিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক শিক্ষার উপর এক বড় আঘাত, সেটি শিক্ষানুরাগী সকল মানুষ অনুধাবন করতে পারছিলেন। আমাদের রাজ্যের সরকার যখন এই শিক্ষানীতি চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করলেন এবং একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে তা পর্যালোচনা করে নতুন শিক্ষানীতি রচনা করার কথা জানালেন, তখন রাজ্যের মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত, তাই জাতীয় শিক্ষানীতি রূপায়ণের সিদ্ধান্ত অনেকাংশেই রাজ্য সরকারের হাতে। কিন্তু সেই অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে রাজ্য সরকার কী উদ্দেশ্যে আসন্ন শিক্ষাবর্ষ থেকে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স, মাল্টিপল এন্ট্রি এগজ়িট-সহ ইউজিসি প্রস্তাবিত ‘কারিকুলাম অ্যান্ড ক্রেডিট ফ্রেমওয়ার্ক’ চালু করার নির্দেশিকা প্রকাশ করল, তা বোধগম্য নয়। উচ্চশিক্ষায় ‘সিবিসিএস’ পদ্ধতির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আমরা বয়ে চলেছি। যেখানে পরিকাঠামো নেই, শিক্ষক নিয়োগ তলানিতে, শিক্ষাখাতে বাজেট ক্রমাগত হ্রাস করা হচ্ছে, সেখানে গাল-ভরা এই সকল অবাস্তব পদ্ধতির রূপায়ণ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

মুখে যতই বিরোধিতা থাক, রাজ্য সরকার কি তবে কেন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে রুগ্‌ণ করে শিক্ষাক্ষেত্রে অবাধ বাণিজ্যের দ্বার খুলে দিতে চাইছে? একই সঙ্গে একাধিক বিষয়ে পারদর্শী করতে গিয়ে ভবিষ্যৎকে কেন গভীর জ্ঞানচর্চা থেকে বিরত করতে চাইছে? শিক্ষার্থীদের সেই ডিকেন্সিয়ান ‘হ্যান্ডস’-এ পরিণত করে সস্তা শ্রমের বাজারকে উন্মুক্ত করতে চাইছে? রাজ্য সরকারের উচিত, অবিলম্বে শিক্ষানীতি নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট সামনে এনে আলোচনার পরিসর প্রশস্ত করা।

Advertisement

অর্পিতা চক্রবর্তী, আসানসোল, পশ্চিম বর্ধমান

ঝুঁকি কোথায়?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সাংসদ শশী তারুর তাঁর প্রবন্ধে (আমরা পারব কি, ১৫-৩) বলেছেন, ‘চ্যাটজিপিটি’ এমন একটি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে মানুষ তাঁর চিন্তা-ভাবনার সৃজনশীলতা বা বুদ্ধিমত্তার কোনও ব্যবহার ছাড়াই পেতে পারেন কোনও একটি বিষয়ের উপর প্রশ্নের উত্তর (সম্ভাব্য), সমাধান এবং সংজ্ঞা। তারুর অবশ্য এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন।

যে কোনও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত উত্তর সংজ্ঞা, কিংবা সমাধান ‘ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসি‌ং’ প্রযুক্তির মাধ্যমেই হয়ে থাকে, যা মানুষের ভাষা এবং কম্পিউটারের মধ্যে একটি যোগাযোগ তৈরি করে মাত্র। গুগল বা উইকিপিডিয়া, অথবা ‘অ্যালেক্সা’ ও ‘সিরি’ নামে দু’টি বৈদ্যুতিন যন্ত্র আগেই মানুষের কণ্ঠস্বর থেকে নির্গত শব্দ বা আদেশ অনুসরণ করে সুনির্দিষ্ট কাজটি করার দক্ষতা দেখিয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশ তার সার্ভারে ডেটা ব্যাঙ্ক-এর মধ্যে মজুত থাকা চাই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জনসাধারণকে আক্ষরিক পরিষেবা প্রদান করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে পরিষেবা প্রদান করার জন্যে দরকার রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যস্থতা। বিভিন্ন ওয়েবসাইট-এ ‘চ্যাট-বট’ যেমন অনেকটা স্বয়ংক্রিয় ভাবে একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত গ্রাহককে সেবা দিতে সক্ষম, ঠিক তেমনই এই চ্যাটজিপিটি। বস্তুত চ্যাটজিপিটি-র প্রেরিত তথ্য ওই কোম্পানির একাধিক প্ৰযুক্তি বৈজ্ঞানিকের বানানো তথ্যভান্ডার থেকে প্রাপ্ত ফল, যা অনেকটা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্তের উপর তৈরি। তাই এ থেকে কোনও উপসংহারে আসা যাবে না।

মনঃসংযোগ ছাড়া মস্তিষ্কে কোনও বিষয়ে ঝড় ওঠে না। বলা বাহুল্য, সহজাত এই চিন্তা বা বুদ্ধিমত্তা ছাড়া কোনও উৎপাদন বা গবেষণা উৎকর্ষ লাভ করে না। এই উৎকর্ষ অফিস কর্মীদের মধ্যে ইদানীং আর দেখা যাচ্ছে না। মানুষের মধ্যে সামাজিক সৌজন্য যেমন লোপ পাচ্ছে, তেমনই সহজাত বুদ্ধিমত্তার মৃত্যুও ঘটছে। মানুষের মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তির বিশ্রামের কথা ভেবে, না কি মানুষকে আরও বেশি চিন্তাপ্রবণ এবং শিক্ষিত হওয়ার কথা ভেবে এই প্রযুক্তির আত্মপ্রকাশ, সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। এখনও পর্যন্ত যে অবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রয়েছে, তার সঠিক ব্যবহার পেতে হলে যতটা প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়া দরকার, তার থেকে বেশি দক্ষতা থাকা দরকার ইংরেজি ভাষা এবং তার সঠিক উচ্চারণের উপর।

আমাদের দেশে ৭০ শতাংশ নাগরিক যেখানে গ্রামীণ জীবন-যাপন করছেন, সেখানে শতাংশের হারে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। কিন্তু আসল কথাটি ঢাকা পড়ে গেল প্রযুক্তির কচকচানিতে। আমরা জানি, স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই বিভিন্ন সার্চ এঞ্জিন ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। যার অর্থ, এই বিপুল সংখ্যক জনগণের রুচি, ব্যক্তিগত পছন্দ প্রভৃতি নানা তথ্য মজুত থাকছে ওই পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার কাছে। যে তথ্য বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে বাণিজ্যিক ভাবে অত্যন্ত মূল্যবান, তা দিয়ে তারা ‘ডিজিটাল মাৰ্কেটিং’ করতে পারে। ইন্টারনেটে আমরা কোন ওয়েবসাইট দেখছি, কোন পণ্য পছন্দ করছি, সে তথ্য চলে যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার হাতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। এই তথ্য প্রয়োজনে তারা বিক্রি করতে পারে বিভিন্ন সংস্থাকে। তবে একটি বিশেষ শ্রেণির নাগরিকের তথ্য পাওয়ার জন্যে দরকার একটি বিশেষ ধরনের মাধ্যম, যা শুধু একটি বিশেষ শ্রেণির নাগরিকরাই ব্যবহার করতে পারেন। চ্যাটজিপিটি সম্ভবত সে রকমই একটি মাধ্যম। কে বলতে পারে, এই মাধ্যমে কোনও উদ্ভাবনী গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সেটিও একটি বিক্রয়যোগ্য পণ্য বলে বিবেচিত হবে কি না?

পিনাকী রুদ্র, অধিকর্তা, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি

উদ্দেশ্য দ্বিবিধ

‘ভুল হয়ে যাচ্ছে বিলকুল’ (২১-৩) শীর্ষক আমার উত্তর-সম্পাদকীয় সম্পর্কে শিবাশিস দত্ত ‘বঙ্কিম কি বিদ্বেষী’ (সম্পাদক সমীপেষু, ৫-৪) শীর্ষক চিঠিতে যে মন্তব্য করেছেন, সেই প্রসঙ্গে এই চিঠি। আমার লেখার উদ্দেশ্য ছিল দ্বিবিধ— এক, স্থান-কাল নিরপেক্ষ ভাবে গেরুয়া শিবির গান্ধী, বিবেকানন্দ, বঙ্কিম, অরবিন্দ প্রমুখ ব্যক্তিত্বকে আত্তীকরণ করে হিন্দুত্বের সমর্থনে একটি ন্যারেটিভ নির্মাণ করতে সচেষ্ট। বঙ্কিমের আনন্দমঠ-কে তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকীর্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার একটি বিকৃত পাঠের উপস্থাপনার মাধ্যমে তাঁকে মুসলিম-বিদ্বেষী প্রতিপন্ন করার এই স্ট্র্যাটেজিক ভাবনাটা গেরুয়া শিবিরের, আমার নয়। আনন্দমঠ আমার আলোচনার বিষয়ও ছিল না। থাকলে অবশ্যই পত্রলেখকের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করতাম। দুই, প্রগতিশীল শিবিরের একটি অংশও যখন বাম দৃষ্টিকোণ থেকে এঁদের ভাবনাকে মূলত রক্ষণশীলতার নিরিখেই বিচার করে, তখন তারা হিন্দুত্ববাদীদের পাতা ফাঁদেই পা দেয়। এটা আদৌ যথার্থ বাম দৃষ্টিভঙ্গি নয়।

প্রয়োজন ছিল সামগ্রিকতার প্রেক্ষিতে এঁদের চিন্তাকে স্থাপন করে বিকল্প ন্যারেটিভ নির্মাণ করা, চিহ্নিত করা সেই উপাদানগুলিকে, যেগুলির সমন্বয়ে নির্মিত হতে পারত তাঁদের ভাবনাকেই কাজে লাগিয়ে হিন্দুত্বের প্রতিস্পর্ধী একটি কাউন্টার ন্যারেটিভ। লেনিনের টলস্টয় মূল্যায়ন এবং বলশেভিক বিপ্লবের পরে প্রলেতকাল্টের প্রবক্তাদের ঐতিহ্য প্রসঙ্গে অতি বাম অবস্থানের কড়া সমালোচনা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

শোভনলাল দত্তগুপ্ত, কলকাতা-১৯

আরও পড়ুন
Advertisement