Abhijit Gangopadhyay

সম্পাদক সমীপেষু: দিশার সন্ধান

তাপস রায় তৃণমূলের চাণক্য নন এবং তিনি কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্যও ছিলেন না। অতএব ভোটের বাজারে তৃণমূলকে খানিকটা বেকায়দায় ফেলা ছাড়া বিজেপির প্রাপ্তি তেমন কিছু নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪ ০৫:৫১
Abhijit Gangopadhyay

— ফাইল চিত্র।

‘ছদ্মে পদ্মে একাকার’ (৭-৩) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। প্রবন্ধকার দেবাশিস ভট্টাচার্য দুই ভিন্ন পরিসর থেকে দু’জনের বিজেপিতে যোগ ভোট-রাজনীতিতে আলোড়ন তোলার কথা বললেও, তা ক্ষণস্থায়ী হবে বলেই মনে হয়। তাপস রায়ের দল ছাড়ার নেপথ্যে দুর্নীতির থেকেও তাঁর প্রতি দলের দীর্ঘ বঞ্চনা এবং উপেক্ষাই আসল কারণ। তবে বিধানসভার সদস্য পদে ইস্তফা দিয়ে দলবদল করায় নীতিবোধের বার্তা তিনি দিলেন।

Advertisement

তাপস রায় তৃণমূলের চাণক্য নন এবং তিনি কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্যও ছিলেন না। অতএব ভোটের বাজারে তৃণমূলকে খানিকটা বেকায়দায় ফেলা ছাড়া বিজেপির প্রাপ্তি তেমন কিছু নেই। তাপস রায়েরও বিজেপিতে বড় কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে দু’পক্ষই সুবিধাজনক অবস্থায় বর্তমান। নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় তিনি যে সমস্ত আদেশ দিয়েছেন, তা সবটাই তথ‍্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করে, যা উচ্চতর বেঞ্চ বা শীর্ষ আদালতে খারিজ হয়নি। এমনকি মামলা তাঁর আদালত থেকে সরলেও বিচার প্রক্রিয়ার ধারা প্রায় একই দেখা যাচ্ছে। এসএসসি এবং রাজ‍্যকে একাধিক বার ইতিমধ্যে ভর্ৎসিতও হতে হয়েছে। কোনও দল বা ব‍্যক্তিবিশেষকে লক্ষ্য করে তাঁর কিছু অনভিপ্রেত পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্যে জলঘোলা হওয়া ছাড়া আর কিছুই হওয়ার নেই। বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দানের পূর্বে রাজনীতিতে যোগদানের ইঙ্গিত করা তাঁর পদের প্রতি সুবিচার করে কি না, জনমানসে প্রশ্ন থেকেই যায়। রাজনীতির কাদা ছোড়াছুড়ি খেলায় তিনি কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন, তা সময়ই বলবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব নিজের দলের ক্ষেত্রে তিনি বজায় রাখতে পারবেন তো? বিপুল ভোটে জেতা সত্ত্বেও অমিতাভ বচ্চন এক সময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনীতির আঙিনা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তৃণমূলের টিকিটে রাজ‍্যসভায় নির্বাচিত প্রসার ভারতীর এক প্রাক্তন শীর্ষকর্তা দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলায় কী অবস্থায় পড়েছিলেন, তা অনেকেই হয়তো জানেন।

অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কোন পথ অবলম্বন করবেন, বাংলার পঙ্কিল রাজনীতিতে তিনি নতুন দিশা দেখাতে পারবেন কি না, সেটাই আসল প্রশ্ন হতে চলেছে।

ধীরেন্দ্র মোহন সাহা, কলকাতা-১০৭

পার্থক্য নেই

দেবাশিস ভট্টাচার্য ‘তৃণমূলের ভাগ্যচক্রে ত্রিফলা যোগ’ বলে আলোচনা শুরু করে শেখ শাহজাহান, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও তাপস রায় এই তিন জনকে একই বন্ধনীতে নিয়ে চলে এসেছেন। কিন্তু কোনও ভাবেই এই তিনটি ফলা ধারে বা ভারে একই রকম তীক্ষ্ণ নয়। আলোচ্য তিন জনের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থান পৃথক পৃথক। শেখ শাহজাহান যে সন্দেশখালির বেতাজ বাদশা ছিলেন, ইডি রেড করার আগের দিন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। শাহজাহান যখন আত্মগোপন করে পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিলেন, তখন সুযোগ পেয়ে এলাকার মানুষ সমস্ত ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রকাশ্যে আনতে শুরু করে। এখনও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে শাহজাহানের মতো যে সকল প্রভাবশালী ব্যক্তি ঘাপটি মেরে রয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কেও বহু তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি। স্বভাবতই ‘সন্দেশখালি-কেলেঙ্কারির ধাক্কায় রাজ্য রাজনীতি এখনও কম্পমান’। বিগত বেশ কয়েকটি বছর ধরে সন্দেশখালি ঘিরে যা যা ঘটছে, তার সামাজিক অভিঘাত নস্যাৎ করা খুব সহজ হবে না বুঝেই ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়া রুখতে রাজ্য সরকার এত তৎপরতা দেখিয়েছে কি না, সে প্রশ্ন অবান্তর বলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্য দিকে, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বিচারক জীবনের শেষ কয়েক মাসে এমন কিছু মামলার রায় দানের সুযোগ পেয়েছেন, যা তাঁকে কিছু মানুষের কাছে পরম নির্ভরযোগ্য বলে প্রতিপন্ন করেছিল। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় সে আসন ত্যাগ করে, আরও বড় কিছু করে দেখাবার প্রত্যাশায় রাজনীতির ময়দানে এসেছেন। এই রাজনীতির ময়দানে আসার নেপথ্যে নাকি রয়েছে তৃণমূল নেতাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার তীব্র তাগিদ। ফলে তিনি এতটুকু কালক্ষেপ করেননি। বিজেপিকে ভারতের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দল’ বিবেচনা করে তিনি সরাসরি সেই দলে যোগ দিয়েই দলের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। কিছু দিন আগেও যিনি তৃণমূল বাদে অন্য সব দলের সমর্থকদের কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য ছিলেন, তিনি এক ধাক্কায় নিজেকে শুধুমাত্র বিজেপির সমর্থকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেন। অথচ, সযত্নে এড়িয়ে গেলেন বিজেপির বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ।

প্রবন্ধকার সঠিক ভাবেই বলেছেন, যে দ্রুততায় বিচারপতি অভিজিৎ নিমেষে রাজনৈতিক অভিজিৎ হয়ে গেলেন, তাতে ‘বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটি দরজা খুলে যায়। আর তাপস রায় যে নিতান্তই ব্যক্তিগত উষ্মায় তৃণমূল দল ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগদান করেছেন, সে বিষয়ে তিনি নিজেও এতটুকু গোপন করেননি। ‘সুদীপের সঙ্গে তাপসের অহি-নকুল সম্পর্ক তৃণমূলের সুবিদিত’ হলেও, এই দলে থাকাকালীন তাপসবাবু যে ভাবে প্রায় প্রতি দিন বিজেপিকে আক্রমণ করতেন, সে অস্ত্রগুলি কি এখন সব আস্তিনের তলায় ঢুকে যাবে? এই আলোচনার বৃত্তে আরও এক জন সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থান বদল যে অনেককেই আশ্চর্য করেছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। জাতীয় কংগ্রেসের চরম দুঃসময়ের একনিষ্ঠ সৈনিক কৌস্তুভ বাগচী যে সকল যুক্তি উপস্থাপন করে বিজেপিতে যোগদান করলেন, তা তাঁর পূর্বতন দলের সহযোদ্ধাদের যেমন হতাশ করেছে, সাধারণ মানুষের মনেও তুলেছে প্রশ্নের ঝড়। এ ভাবে কি রাজনৈতিক মতাদর্শকে উপেক্ষা করে রাতারাতি দল বদল করা যায়?

প্রতি দিনই কোনও না কোনও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মতাদর্শের সঙ্গে নির্দ্বিধায় আপস করেছেন। এঁরা নিজেরা যেমন ছলে বলে কৌশলে ভোট যুদ্ধে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তেমনই সমর্থকদেরও দেখান। মতাদর্শের পার্থক্য বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।

রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

নয়া সমীকরণ

‘ছদ্মে পদ্মে একাকার’ প্রবন্ধটি রাজ্যের ঘটমান বৈচিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সন্দেশখালির শাহজাহান এক জন বেতাজ বাদশা। নিশ্চিন্ত মনে লুকিয়ে থেকে দক্ষ রাজ্য পুলিশের হাতে ৫৬ দিন পর তিনি গ্রেফতার হন। তাঁকে সিআইডি দফতর থেকে সিবিআই-এর হাতে নিতে উচ্চ থেকে উচ্চতম আদালতে ৫ দিন ধরে ছোটাছুটি হল। ফলে শাহজাহান তৃণমূলের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ, উনি বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীশূন্য বোর্ড গঠনের কারিগর ছিলেন। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় উচ্চ বিচারালয়ে সাড়া জাগানো এক বিশেষ ব্যক্তি। নিয়োগ-দুর্নীতি কাণ্ডে তাঁর সাহসী রায়দান বঞ্চিতদের মনে দারুণ আশা জুগিয়েছে। সেই তিনি পদত্যাগ করে বিজেপিতে নাম লিখিয়ে এক দিকে গুণগ্রাহীদের হতাশ করেছেন, অন্য দিকে রায়দানের পক্ষপাতিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর এই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত তৃণমূলকে কতটুকু লাভবান করতে পারে, তা সময়ই বলবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই যদি অভিজিৎবাবুর মূল লক্ষ্য হয়, তবে বিজেপি দলে থেকে তা কতখানি সম্ভব?

অন্য দিকে, তৃণমূল নেতা তাপস রায়ের দল ও বিধায়কের পদে ইস্তফা দেওয়া শাসক তৃণমূলের পক্ষে অশুভ লক্ষণ। একই সঙ্গে তাঁর বিজেপিতে নাম লেখানো এক নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ। এটা মান-অভিমান না কি নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ, সেটা আগামী দিনেই বঙ্গবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সারনাথ হাজরা, কদমতলা, হাওড়া

আরও পড়ুন
Advertisement