Bengali Language

সম্পাদক সমীপেষু: বাণিজ্যের ভাষা

আসলে সব জিনিসেরই প্রচার ও প্রসারের জন্য বাণিজ্যিক অভিমুখ দরকার। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রচার ও প্রসারে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৪ ০৪:২৬
Language

— ফাইল চিত্র।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভাবার দায়টা আমাদেরই’ (২১-২) প্রসঙ্গে কিছু কথা। গত ৩০ বছর ধরে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান (প্রধানত রসায়ন) ও পরিবেশ তথা স্বাস্থ্য বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে লেখালিখি করেছি, কর্মশালাও করছি। কিন্তু যাদের জন্য এই চেষ্টা, তারা অধিকাংশ কর্মজীবনে বেকার। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষায় বাংলায় নেই বই, নেই গবেষণার সুযোগ। গালভরা বাংলায় পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্মেলন হয়। অনেকেই বাংলায় বলেন, তবে অধিকাংশ কথাই ইংরেজিতে হয়, এমনকি শংসাপত্রটিও ইংরেজিতেই দেওয়া হয়। কাজের বাজার দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। আবার কাজ জুটলেও সেখানে বাংলায় কাজের সুযোগ শূন্য। যেমন, এক জন শিক্ষার্থী বাংলা মাধ্যমে রসায়নে স্নাতক হতে পারবে কি? ক’জন চিকিৎসক বাংলায় ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন লেখেন? ইমেল বাংলায় লেখা গেলেও ইমেল আইডি কি এখানে বাংলায় হয়? আন্তর্জাল বা ইন্টারনেটের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ইংরেজি। আমরা সেখানে বাংলা ভাষায় কতটা তথ্য সংযোজন করি? বাংলা সিরিয়ালে হিন্দি গানের ছয়লাপ। ট্রেনে নিত্যযাত্রী কয়েক জন তরুণ-তরুণীর আলোচনা বা মোবাইল ফোনে কথোপকথন শুনি এক আজব ভাষায়।

Advertisement

আসলে সব জিনিসেরই প্রচার ও প্রসারের জন্য বাণিজ্যিক অভিমুখ দরকার। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রচার ও প্রসারে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি আজীবন অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও ধর্মীয় ভাবাবেগে আচ্ছন্ন বাঙালিকে কর্মমুখর ও বাণিজ্যমুখী করার চেষ্টা করেছেন। আত্মবিস্মৃত বাঙালি আচার্যকে ভুলে গিয়েছে। তাই নিম্নবিত্ত বাঙালিও বাংলা মাধ্যম ছেড়ে আজ সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করে।

অসীম বসাক, নবপল্লি, উত্তর ২৪ পরগনা

কিসের দায়?

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি পড়ে আশ্চর্য হলাম। বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় খামোকা আমার হতে যাবে কোন দুঃখে? লোকে মাতৃভাষা নিয়ে যে এত হইহই করে, সেটা কি অপর কোনও বহুল ব্যবহৃত ভাষা শুদ্ধ ভাবে বলতে ও লিখতে না পারার হীনম্মন্যতা চাপা দেওয়ার জন্য? প্রবন্ধকার বিস্মৃত হয়েছেন যে, ভাষাশিক্ষা একটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। পেটের দায়েই রামমোহন রায় ফারসি শিখেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত, পরবর্তী প্রজন্ম ইংরেজি— সওদাগরি ‘হৌস’-এ কেরানির কাজ পাওয়ার জন্য। আজকের বিশ্বে বাংলা ভাষাচর্চার উপযোগিতা কী? কোন ব্যবহারিক লাভ হবে বাংলা শিখে? সেই সময় ইংরেজি শিখলে বরং ভাত জোটা সহজতর হবে।

চর্যাপদের পদকর্তাদের থেকে রায়গুণাকর, কেউই ইংরেজি জানতেন না; তাই তাঁদের স্বচ্ছন্দে বাদ দেওয়া যায়। তার পরের যুগে ক্যাপটিভ লেডি বা রাজমোহন’স ওয়াইফ আমাদের এক গূঢ় ও অপ্রিয় সত্যের ইঙ্গিত দেয়— সেটা হচ্ছে এই যে, যাঁরা ইংরেজিতে কল্কে পান না, তাঁরাই মাতৃভাষার তথাকথিত আরাধনায় লিপ্ত হন। আর ইংরেজি জানার, বুঝতে, বলতে পারার সুবিধা তো চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছি। বামেদের চৌত্রিশ বছরে বাংলার বামেরা খেটে মরতেন; আর দিল্লি থেকে ছড়ি ঘোরাতেন প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরিরা। কারণ তাঁরা ইংরেজি বুঝতে, বলতে পারতেন।

তপন পাল, কলকাতা-১৪০

আত্মপরিচয়

বাংলার নবজাগরণের দুটো উল্লেখযোগ্য ঘটনা— ইংরেজি শিখে শেক্সপিয়রচর্চা আর জাতীয় চেতনার উন্মেষ। এই উন্মেষ পর্বের একটা দিক হল দেশীয় বা দেশজ ভাষার ও জ্ঞানের পুনরায় আবিষ্কার আর তার চর্চা। বঙ্কিমচন্দ্র শুরুতে ইংরেজিতে লিখেও পথিকৃৎ হয়ে উঠলেন বাংলায় লিখে। রামমোহন গৌড়ীয় ব্যাকরণ ইংরেজিতে লিখে শেষ পর্যন্ত বাংলাতেও তার ভাষান্তর করেন। বিদ্যাসাগর এ ব্যাপারে চলে যান শিকড়ের গভীরে। তাঁরই সহপাঠী স্বল্পালোচিত অক্ষয়কুমার দত্ত সে যুগে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করেন। নবজাগরণের আর এক অগ্রদূতকে যেমন এর জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে, তারও আগে করতে হয়েছে দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ। বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য সে যুগে তাঁকে বিদ্রুপও সহ্য করতে হয়। তবুও অবিচল থেকে চারুপাঠ প্রণেতা যে দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন, তা ভবিষ্যতের কাছে কতটা অনুসরণযোগ্য হয়ে উঠল, বলা কঠিন।

পরবর্তী কালে যে কাজটি আরও অবিচল ও সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে করা দরকার, তা মনে হয় আরও এক বার ভাবার সময় এসেছে। অক্ষয়কুমার দত্ত, মধুসূদন দত্ত, তরু দত্ত থেকে উৎপল দত্ত ইংরেজিকে ক্ষেত্রবিশেষে গুরুত্ব দিলেও শেষ পর্যন্ত ফসল ফলিয়েছেন বাংলা ভাষাতেই। লেখাপড়া-জানা মানুষ যদি সবার উপরে বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ার মানসিক দৃঢ়তা দেখান, তা হলে আজ বাংলাকে নিজের স্থানে ফেরানোর কাজটা গতি পায়। আজকে অনেক ভাষাতেই অন্যান্য ভাষা ‘কাজের ভাষা’ হয়ে উঠছে। এই পর্বে বিদ্যালয় স্তরে পাঠ্যবই আর সংবাদমাধ্যমগুলো যদি বড় ভূমিকা গ্রহণ করে, ভাল হয়। সর্বগ্রাহ্য নীতি নির্ধারণ করার জন্য কিছুটা হলেও সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। যাঁরা বাংলা ভাষাটাকে বাংলা বলে পরিচয়ের জায়গাটা পরিষ্কার রাখতে চান, তাঁদের বাংলা ভাষা ঘরে-বাইরে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবলীল হওয়াটাও বাঞ্ছনীয়। অনেক বাঙালি বাংলা ভাষা ব্যবহারে সঙ্কোচ করেন। এটা কেন হবে? কোনও জাতির আত্মোপলব্ধি ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সোপান মাতৃভাষা, যা পরিচয়ের ভিত্তিকে মজবুত করে।

শান্তি প্রামাণিক, উলুবেড়িয়া, হাওড়া

চাই অস্মিতা

অনেক দিন ধরেই বাঙালির বাংলা ভাষার চর্চা কেবল ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস পালন এবং আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার কয়েকটি দিন উদ্‌যাপনে সীমাবদ্ধ। প্রতি দিনের ভাষা ব্যবহারে তা পরিলক্ষিত হয় না। ২০১৭ সালে চেন্নাই গিয়েছিলাম। দেখলাম, রাজ্য পরিবহণের সব বাসে কেবল তামিল ভাষাতেই লেখা ছিল তার রুট নম্বর এবং চলাচলের বিবরণ। একটু অসুবিধাই হয়েছিল। কিন্তু, এটাও মনে হয়েছিল, তামিলদের ভাষা বিষয়ে অস্মিতা সম্মানযোগ্য। আমাদের বাংলার প্রতি সেই শ্রদ্ধা কোথায়? সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজ ধর্মতলায় দাঁড়ালে কিছু দোকানের নাম, নির্দেশ বাংলায় দেখতে পাই। তার পরে আর কোনও সাহিত্যিক সেই উদ্যোগ করেননি।

বাঙালির তরুণ প্রজন্মের কথোপকথনে বাংলা ভাষার কী করুণ অবস্থা! ‘থোড়ি না আছে’, ‘খুশবু’, ‘ইয়ানি’— এই রকম আরও অজস্র আজব শব্দ ঢুকে যাচ্ছে বাংলায়। বাংলা, বাঙালিকে কি শুধুমাত্র চেনা যাবে তার ইতিহাস বা সাহিত্যের সেরা সময় দিয়েই? একে টিকিয়ে রাখার জন্য চাই বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ভাবনা ও পথ।

সন্তোষ কুমার দে, হাওড়া

হলুদ ট্যাক্সি

কলকাতার রাস্তায় এখন হলুদ ট্যাক্সিতে মিটারের ব্যবহার প্রায় উঠেই গিয়েছে। তার পরিবর্তে ইচ্ছেমতো ভাড়া চাওয়া, না পোষালে ট্যাক্সি নিয়ে সটান বেরিয়ে যাওয়া— এটাই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনের সময় এই হয়রানি আর কত দিন চলবে?

শ্রী মিত্র, কলকাতা-৩৩

আরও পড়ুন
Advertisement