প্রায় কুড়ি মাস পরে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিদ্যালয় খুলছে। এর থেকে ভাল খবর আর হয় না। যদিও এই মধ্যবর্তী সময়ে বিদ্যালয় থেকে অভিভাবকদের মিড-ডে মিল, ভিটামিন জাতীয় ওষুধ, অ্যাক্টিভিটি টাস্ক, ক্লাসের পরীক্ষার ফলাফল, নতুন অ্যাডমিশন, বইখাতা দেওয়া প্রভৃতি কাজ হয়েছিল। অনলাইন এডুকেশনও চালু ছিল। কিন্তু বিদ্যালয় ছিল ছাত্রছাত্রীবিহীন। এর জন্য যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল এবং পড়াশোনার ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব ১৬ নভেম্বর। তবে যে সময়বিধি মেনে বিদ্যালয় চালু করার সরকারি নির্দেশ জারি হয়েছে, সে সম্বন্ধে কিছু ভাবনাচিন্তার অবকাশ থেকেই যায়।
সিউড়ি শহরের একটি বৃহৎ সভাকক্ষে শুধুমাত্র দশম শ্রেণির ৫০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে একটি পাঠ সহায়তা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম বিগত কয়েক মাস। আমরা ৩২ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা সেখানে নিয়মিত পাঠদান করতাম। চেষ্টা করেছিলাম মূলত গ্রামগঞ্জের গরিব বাড়ির ছেলেমেয়ে, যারা টিউশনি এবং অনলাইন শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে না, তাদের এই পাঠকেন্দ্রে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে।
পড়াতে গিয়ে আমরা লক্ষ করি ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগের অভাব এবং পড়াশোনার স্বাভাবিক ছন্দে ব্যাঘাত। অবশ্য কয়েক দিনের মধ্যেই তা দূর হয়ে যায়। চারটি পিরিয়ডে ভাগ করে মোট তিন ঘণ্টার ক্লাস নেওয়া হত। ক্লাস চলাকালীন তারা কথা বলছে কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তাদের সবার একটাই বক্তব্য, “দীর্ঘ দিন ক্লাস না করার ফলে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে।” এটাই স্বাভাবিক।
আজ যখন প্রায় ২০ মাস পরে আবার স্বাভাবিক পঠন-পাঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে, তখন ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি বিশেষ ভাবে ভাবার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের পারিবারিক পরিস্থিতির দিকটি ভাবতে হবে। তাদের সাড়ে ন’টা থেকে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত এবং আরও কিছু ছাত্রছাত্রীকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত বিদ্যালয়ে থাকতে হলে দুপুরের খাবারের বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার। কেননা সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যে ‘বাবু বাড়ি’র কাজ থেকে ফিরে ছেলেমেয়েদের রান্না করে খাইয়ে বিদ্যালয়ে পাঠানো অনেক মায়ের পক্ষেই অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারি ভাবে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করলে ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে। দূরদূরান্তের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্কুলে পৌঁছনো ও প্রান্তিক এলাকায় বাড়ি ফেরা দুরূহ হয়ে উঠবে। বিভিন্ন জেলা থেকে করোনা সংক্রমণের খবর আসছে। তাই ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি ফিরে নিত্য দিনের জামাকাপড় কেচে ফেলা ও অন্যান্য সংক্রমণ বিধিকে মেনে চলার জন্য আর একটু সময় পেলে উপকৃত হবে। সোম-বুধ-শুক্র এবং মঙ্গল-বৃহস্পতি-শনি, এই দু’টি বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের ভাগ করে সাড়ে দশটা থেকে চারটে পর্যন্ত স্কুল চালু করলে ভাল হয়। নভেম্বর-ডিসেম্বর এই দুই মাস পরীক্ষামূলক ভাবে স্কুল চালু করার পর জানুয়ারির নতুন সেশনে পঠনপাঠনকে যথানিয়মে প্রবর্তন করার ব্যবস্থা শিক্ষা দফতর ভেবে দেখতে পারে। দু’বছরে পাঠদানের ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে, তাকে এখনই পুষিয়ে দেওয়া দুষ্কর। ছাত্রছাত্রীরা আগে বিদ্যালয়ে প্রাণসঞ্চার করুক, তার পর তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই শিক্ষা সঞ্চারিত হবে।
সব্যসাচী ধর, শিক্ষক, সিউড়ি নেতাজী বিদ্যাভবন
ক্ষতের পরে
‘শিক্ষায় জরুরি অবস্থারই দশা দেখছে সমীক্ষা’ (৪-১১) শীর্ষক প্রতিবেদনটি শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে করোনার থাবা যে ভয়ানক ক্ষত সৃষ্টি করেছে, সেই বিষয়ে আলোকপাত করেছে। করোনাকালীন সময়ে অনলাইন ক্লাস চালু হয়েছিল। এই সময়ে অ্যাক্টিভিটি টাস্ক বিতরণ ও উত্তরপত্র সংগ্রহের কাজ ও মূল্যায়ন চলেছে প্রতি মাসে নিয়ম করে। কিন্তু পড়াশোনার প্রগতিতে তা যে যথেষ্ট নয়, আলোচ্য প্রবন্ধে উল্লিখিত রিপোর্ট অনুযায়ী তা পরিষ্কার। অনলাইন ক্লাসে হাজিরার বেহাল দশা এবং অ্যাক্টিভিটি টাস্কের উত্তরপত্রে বিভিন্ন চ্যানেল থেকে দেদার কপি করার প্রবণতা দেখে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে হতবাক হয়ে যেতে হয়। বাড়িতেও দেখছি, আমার অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত মেয়ের বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে দক্ষতা অনেক নীচে নেমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
আসলে করোনাকালে গৃহবন্দি দশায় স্কুলছুট, বন্ধুছুট হয়ে নিজের মনের সঙ্গে নিয়ত যুদ্ধ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা একেবারেই বিধ্বস্ত। অতিমারিতে পরিবারের আর্থিক সঙ্কট ও বহু নিকটজনের মৃত্যু কাছ থেকে দেখে বহু শিশুর পড়াশুনার প্রতি মনের টানই হারিয়ে গেছে। ‘বেঁচে থাকলে তবেই না পড়াশোনা’— এই জাতীয় মনোভাব দরিদ্র, প্রান্তিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গ্রাস করছে। প্রতি মাসে নিয়মরক্ষার শুকনো মিড-ডে মিল বিতরণ ও উত্তরপত্র সংগ্রহ, এবং ধুঁকতে থাকা অনলাইন ক্লাস— এই তিনটি বিষয় শ্রেণিকক্ষের পঠনপাঠনের বিকল্প তো নয়ই, বরং এই ত্রিফলায় শিক্ষাব্যবস্থা আঠারো মাস ধরে বিদ্ধ হয়ে চলেছে। তবে বেসরকারি বিদ্যালয়ের চিত্রটা অনেকাংশে আলাদা। এই সব বিদ্যালয়ের আর্থ-সামাজিক দিক থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা প্রাণবন্ত পরিকাঠামো, সুষ্ঠ পরিকল্পনা ও উন্নত মানবসম্পদ— এই তিনের সমন্বয়ে করোনা অতিমারির মধ্যেও শিক্ষার মান অনেকটাই ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্য দিকে, সরকারি বিদ্যালয়ে সর্বশিক্ষা মিশনের কল্যাণে পরিকাঠামো ও উন্নত মেধাসম্পন্ন শিক্ষকের ঘাটতি নেই। ঘাটতি শুধু যথাযথ পরিকল্পনার। দেড় বছর পর স্কুল খুলছে বা খুলতে চলেছে, অথচ সরকারি নির্দেশিকা মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ারের বাইরে বেরিয়ে কোনও ভিন্নধর্মী গঠনমূলক পরিকল্পনার দিশা এখনও দিতে পারল না।
তবে কি কোনও অদৃশ্য শক্তি করোনাভাইরাসের আড়ালে শিক্ষাব্যবস্থাকে পরোক্ষ ভাবে বেসরকারিকরণের কাজ সুচারু ভাবে করে চলেছে? ঘরপোড়া মধ্যবিত্ত কিন্তু সেই সিঁদুরে মেঘই দেখছে।
তন্ময় মণ্ডল , গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
মনুষ্যত্বের শিক্ষা
সূর্যকান্ত চক্রবর্তী তাঁর ‘মদ বিক্রির টাকা’ (সম্পাদক সমীপেষু, ২৮-১০) শীর্ষক চিঠিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন ও আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর বক্তব্য একপেশে। এ বছর আমি পূর্ব মেদিনীপুরের এক মফস্সল এলাকায় পুজোর ছুটি কাটিয়েছিলাম। লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন থেকে শুরু হল ডিজে মিউজ়িক। বিরাট ট্রাকে করে ছ’সাত ফুট লম্বা ডিজে বক্স বাজানো শুরু হল পাড়ায়-পাড়ায়, প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে। ১৯ থেকে ২২ অক্টোবর দিনরাত বুক-কাঁপানো ঢিক-ঢিক শব্দ সোজা হৃৎপিণ্ডে ধাক্কা মারছিল। আমার অশীতিপর মা আর বাড়ির সবাই অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলাম। আশ্চর্য হয়েছিলাম! এলাকাবাসীর কি কোনও অসুবিধা হয়নি? শিশু, নারী, বৃদ্ধ, সবাই নাচতে-নাচতে চলেছিল ঘট জলপূর্ণ করতে। পূর্ণিমা শেষ হওয়ার পরেও লক্ষ্মীঠাকুরের আরাধনা চলছিল। আর চলছিল বিরামহীন মদ্যপান। মাঝে-মাঝে ঘোষণা হচ্ছিল, “সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে, প্যান্ডেলে এসে নাচুন, ফুর্তি করুন।”
ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যপূর্ণ তমলুকের অনতিদূরে নতুন অভিজ্ঞতা হল। আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে, জনসাধারণ কি নিজেদের নান্দনিক বোধ ও বৌদ্ধিক গুণ হারিয়ে ফেলল? অনুষ্ঠান-উৎসবে মদ খাওয়া অন্যায় নয়। কিন্তু মদ খেয়ে অচৈতন্য হওয়া, গালিগালাজ বা মারামারি করা, উন্মত্ত হওয়া বা অন্যের অসুবিধা করা অত্যন্ত অন্যায়। যেখানে-সেখানে মদের দোকান আছে বলেই যেখানে ইচ্ছে মাতলামি করতে হবে, অথবা মদ সহজলভ্য বলেই প্রচুর মদ খেতে হবে— এমন হুকুম তো সরকার করেনি। ‘মান’ আর ‘হুঁশ’ যার নেই, সে মদ না খেলেও অমানুষ।
সমরেশ কুমার দাস, জালুকি, নাগাল্যান্ড