Sandhya Mukhopadhyay

সম্পাদক সমীপেষু: কান্নাভেজা আর্তি

সন্ধ্যার গায়নভঙ্গিতে তাঁর ভাব আর কণ্ঠের স্বকীয়তা বিধিবদ্ধ সীমা অতিক্রম করে যেতে পারে এবং শ্রোতাদের কাছে তা ইঙ্গিত করতে পারে এক অনাস্বাদিত সুষমার।

Advertisement
none
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:১২

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানে যে নানা রঙের বৈচিত্র তা তাঁর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নিবিড় অনুশীলনের ফসল। তিনি তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র উস্তাদ মুনাবর আলি খানের কাছে। গেয়েছেন বিভিন্ন ধরনের গান। আধুনিক, চিত্রগীতি, ভজন, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদী, গজল, ঠুংরি, খেয়াল প্রভৃতি। সেই সঙ্গে গীতিনাট্য (রামী চণ্ডীদাস) এবং নাট্যগীতি (আলিবাবা) প্রভৃতিতেও তাঁর কণ্ঠের প্রতিভার স্বাক্ষর মেলে।
মেধাবী পরীক্ষার্থী যেমন উত্তরপত্রের প্রদত্ত পরিসরে জানিয়ে দেয় তার জ্ঞানের সীমা, তেমনই সন্ধ্যার গায়নভঙ্গিতে তাঁর ভাব আর কণ্ঠের স্বকীয়তা বিধিবদ্ধ সীমা অতিক্রম করে যেতে পারে এবং শ্রোতাদের কাছে তা ইঙ্গিত করতে পারে এক অনাস্বাদিত সুষমার। তাঁর একটা বেসিক গানে, ‘মালার শপথ লাগি... ভালবাসো যারে’ কলির মধ্যে ‘যারে’ শব্দটি কণ্ঠের ওঠানামায় যে উচ্চতায় নিয়ে যান সন্ধ্যা, তা অনেক বড় শিল্পীর পক্ষেও গাওয়া কঠিন। ‘জানি না ফুরাবে কবে’ (সবার উপরে), ‘দু’ চোখের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে’ (শ্রাবণ সন্ধ্যা), ‘ঝরাপাতা ঝড়কে ডাকে’ গানে কান্নাভেজা বেদনা তাঁর কণ্ঠ বাহিত হয়ে আমাদের হৃদয়কে যে রকম স্পর্শ করে, তার নজির বিরল। ‘কে তুমি আমারে ডাকো’ (অগ্নিপরীক্ষা) এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ‘সজনী গো সজনী দিন রজনী’ অথবা ‘সজনী গো কথা শোনো’ জাতীয় গানে তাঁর অভিব্যক্তির মধ্যে ছিল খানিক অভাববোধ, যার সঙ্গে বাঙালি মনের মিল ছিল সেই যুগে, যখন সব কিছু সহজ এবং তাৎক্ষণিক ছিল না। অনেক চাওয়ার মধ্যে একটুখানি পাওয়া দীর্ঘস্থায়ী রেশ রেখে যেত। সন্ধ্যার কণ্ঠ এক বিশেষ সময়ের, ব্যক্তিত্বের, ভাবের, পরিশীলিত সংস্কৃতির ফল।
সদা হাস্যময়ী সন্ধ্যা গানের গূঢ় স্বরে মিশিয়ে দিতে পারেন অপ্রকাশিত বেদনা। সে জন্যেই কি এমন মধুর তাঁর কণ্ঠ?
রঘুনাথ প্রামাণিক
কালীনগর, হাওড়া
সুচিত্রা-সন্ধ্যা
ভারতীয় চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকার জুটি বা পরিচালক-অভিনেতার জুটির মতো, অভিনেতা-গায়কের জুটিও অসামান্য জনপ্রিয় হয়েছে। হিন্দি সিনেমায় সম্ভবত রাজ কপূর-মুকেশ তার সেরা উদাহরণ, পরবর্তী কালে অমিতাভ বচ্চন-কিশোর কুমারের জুটিও খুব জনপ্রিয় হয়। বাংলায় সাড়া জাগানো জুটি ছিল উত্তম-হেমন্ত। সেই ধারারই এক অনন্য উদাহরণ সুচিত্রা-সন্ধ্যা জুটি। নায়িকার ভূমিকায় সুচিত্রা সেন, তাঁর অভিনয়ে মূর্ত হয়ে উঠছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান— বাংলা সিনেমার দর্শককে সেই দৃশ্য নিয়ে যেত এক অন্য জগতে। তাঁদের দু’জনেরই উচ্চারণ, স্বরক্ষেপণ, কথার মাধ্যমে আবেগ প্রকাশের ধারাটি ছিল বাঙালি মধ্যবিত্তের একান্ত পরিচিত।
অনেক ক্ষেত্রে অভিনেতা এবং সঙ্গীতশিল্পী সচেতন ভাবে গানের আগের ও পরের সংলাপে নিজেদের কণ্ঠ ও উচ্চারণকে কাছাকাছি নিয়ে আসেন। তবু দেখা যায়, সব শিল্পীর গলা সব নায়ক-নায়িকার গলার সঙ্গে মেলে না, আবার কারও কারও স্বাভাবিক ভাবেই মেলে। এই ধরনের সাযুজ্যের নানা পরিভাষা রয়েছে, তবে সংক্ষেপে বলা চলে যে, শব্দ উচ্চারণের রীতি, বাগভঙ্গি কাছাকাছি হলে এই মিলটা ভাল হয়। যেমন, দিলীপ কুমার আর মহম্মদ রফি, দু’জনেরই হিন্দি কথার উচ্চারণে উর্দুর প্রভাব ছিল, তাই নায়কের গলায় গায়কের গান সুন্দর মিলে যেত।
সন্ধ্যা প্লেব্যাক সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে অসামান্য সফল ছিলেন। তাঁর কণ্ঠে নায়িকার উপযোগী লাবণ্য ও আবেদন ছিল, আবার সংলাপের নাটকীয়তাকে তিনি গানে ধরতে পারতেন— ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানে সুচিত্রার লিপে সন্ধ্যার গানের অংশটুকু সম্ভবত তার সেরা প্রকাশ। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, তনুজার কণ্ঠে সন্ধ্যার গানগুলিও বাংলার সম্পদ। কিন্তু বাঙালি শ্রোতার স্মৃতির মণিকোঠায় মধ্যমণি যেন সুচিত্রা-সন্ধ্যার গানগুলো।
পার্থ হালদার
কলকাতা-৯৯

এই পথ যদি...
প্রথমে চলে গেলেন সুর সরস্বতী লতা মঙ্গেশকর, তার পর মেলোডি কুইন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। জোড়া আঘাতে বাঙালি হৃদয় আজ বিদীর্ণ, বাংলার সঙ্গীত জগৎ বাক্‌রুদ্ধ দিশাহারা। বাঙালির চিন্তায় ভাবনায় মননে এবং সংস্কৃতিতে একান্ত ভাবে মিশে গিয়েছে এই কিংবদন্তি শিল্পীর সব কালজয়ী গান। প্রায় সাত দশকের বেশি সময় ধরে মাতিয়ে রেখেছিলেন বাংলার কৃষ্টিকে। সন্ধ্যার মতো শিল্পীরা ঈশ্বর প্রেরিত প্রতিভা, যাঁরা কালেভদ্রে আসেন এই পৃথিবীতে। আবার চলে যান নিজের জগতে। উত্তম-সুচিত্রার অসংখ্য ছায়াছবি, যা বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল কয়েক দশক ধরে, বাঙালি জীবনে অনুরণন সৃষ্টি করেছিল এবং এখনও করে, তার কৃতিত্ব কি শুধুমাত্র চিত্রতারকাদের?
সাগরিকা ছবিতে সেই দৃশ্য মনে পড়ে, যেখানে সুচিত্রা সেনের লিপে চলেছে সন্ধ্যার গান— ‘এই তো আমার প্রথম ফাগুন বেলা’, কিংবা পথে হল দেরী ছবির সেই সাড়া জাগানো গানটি— ‘তুমি নাহয় রহিতে কাছে’। তাঁর গানেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই— ‘আর জনমে হয় যেন গো তোমায় ফিরে পাওয়া’।
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১

দুই বাংলার
এক জন সঙ্গীতশিল্পী হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও পরোক্ষ ভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের জন্য অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা গড়ে তোলা, সবেতেই অংশ নেন তিনি। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করা বা শেখ মুজিবুর রহমানের জেল থেকে মুক্তি উপলক্ষে গানও গেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতেও বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। সেই জন্যই ও পার বাংলার মানুষের কাছেও একই রকম সম্মাননীয় গীতশ্রী।
অয়ন ভট্টাচার্য
কলকাতা-৪০

টানা তিন দিন
আমাদের হেশাম রোডের বাড়িতে গানবাজনার আসর লেগে থাকত। বিখ্যাত সব সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও যন্ত্রীর প্রায়ই যাওয়া-আসা ছিল। বাবার একটা অর্কেস্ট্রা টিম ছিল— ন্যাশনাল অর্কেস্ট্রা। বাড়ির একতলার বড় হলঘরে প্রায় দিনই কোনও না কোনও বাংলা সিনেমার গানের রিহার্সাল লেগে থাকত। খুব সম্ভবত ১৯৫৪ সাল হবে। অনুপম ঘটক ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ গানটা রিহার্সাল করছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে। কিন্তু অনুপমবাবুর কিছুতেই ‘ইন্দ্রধনু’র ধনুউউ... টানটা মনমতো হচ্ছিল না। ওই একটা লাইনই তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে তিন দিন ধরে রিহার্সাল করিয়েছিলেন।
বরুণ রায়
কলকাতা-১০৪

Advertisement

অবিচার
এক জন গায়িকা হিসাবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রতিভা ভারতীয় সঙ্গীত জগতে অতুলনীয়। তা সত্ত্বেও তিনি জাতীয় ক্ষেত্রে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিতই ছিলেন। বহু দশক আগেই যাঁকে পদ্মবিভূষণ বা ভারতরত্নে সম্মানিত করা উচিত ছিল, তাঁকে কিনা জীবনের অন্তিম প্রান্তে পদ্মশ্রী দেওয়ার কথা ঘোষণা হল! বাঙালি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্য নতুন করে গর্ব বোধ করেছিল পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান করে তাঁর অনন্য আত্মসম্মান প্রদর্শনের জন্য।
কাজল চট্টোপাধ্যায়
সোদপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

আরও পড়ুন
Advertisement