Ishwar Chandra Vidyasagar

সম্পাদক সমীপেষু: কেবলই কল্পনা?

বিদ্যাসাগর বিষয়ে শুধু বই বা প্রবন্ধ লেখাই নয়, মাঝে মাঝেই তিনি এ দেশে আসেন মূলত রবীন্দ্রনাথ এবং বিদ্যাসাগরের টানে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২২ ০৬:২০

ব্রায়ান হ্যাচার মহাশয় বেশ কয়েক দশক ধরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা এবং সংস্কৃত, দু’টিতেই তিনি সড়গড় এবং পণ্ডিত। এই উপমহাদেশের প্রাচীন এবং সাম্প্রতিক সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়েও তাঁর মনন এবং পড়াশোনা নিবিড় এবং গভীর। বিদ্যাসাগর বিষয়ে শুধু বই বা প্রবন্ধ লেখাই নয়, মাঝে মাঝেই তিনি এ দেশে আসেন মূলত রবীন্দ্রনাথ এবং বিদ্যাসাগরের টানে। ‘সমাজবিজ্ঞানী বিদ্যাসাগর’ (৪-৬) প্রবন্ধে তিনি বলছেন যে, ঈশ্বরচন্দ্রই ‘ভারতের প্রথম সমাজ গবেষক’। বলছেন যে, তাঁর মতে ঈশ্বরচন্দ্রের পদ্ধতিগত প্রয়োগ তিনটি— ১) ইতিহাস সমালোচনা, ২) সমাজতত্ত্ব কল্পনা,৩) তথ্য সংগ্রহ। কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ধতিটির প্রয়োগ বিষয়ে, বিদ্যাসাগর ব্যবহৃত কুলীন বিবাহ সংক্রান্ত একটি ঘটনার উল্লেখ করে, কিছুটা সংশয় থেকেই তিনি লিখছেন যে, “কেননা সত্যি এমন ঘটেছিল, না কি চার পাশের যন্ত্রণাময় সামাজিক বাস্তবের নির্যাসটুকু তিনি এই ভাবে কাল্পনিক-আখ্যানে উপস্থাপিত করেছিলেন, তা আজ আর বোঝার উপায় নেই।”

এ প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, খড়দহের একটি প্রাচীন কুলীন পরিবারের মেয়ে আমি, বড় হয়েছি কুলীন পাড়ায়। এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের সঙ্গে ‘মেল’ অনুযায়ী বিবাহ সম্পন্ন হত আনুলিয়া, শিবনিবাস, রানাঘাট, ব্যারাকপুর, রিষড়া— এই সব অঞ্চলের ‘পাল্টি’ ঘরে। ফলে, অধিকাংশ সময় কৌলীন্য প্রথার বিধিনিষেধের জেরে নানা রকম অবিশ্বাস্য পরিস্থিতির শিকার হতে হত, বিশেষত মেয়েদের। এই মর্মান্তিক পীড়নের শিকার হয়ে উন্মাদ হয়ে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন আমার বাবার একমাত্র পিসিমা ফুলরাণী। সতিন ও তাঁর সন্তানদের নিয়ে কপর্দকহীন অবস্থায় আমৃত্যু ঘর করেছেন এ বাড়ির আর এক পিসিমা, প্রতিভা। আমার নিজের বড় পিসিমা বাল্যবিধবা রমাদেবীর স্বামী সত্যিই মারা গিয়েছিলেন, না নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন বহুবিবাহের চাপে, সে বিষয়েও কোনও হদিস নেই। রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়ের লেখা আমাদের পরিবারের পারিবারিক ইতিহাস পিতৃতর্পণ শিরোনামের বইটিতে এ ব্যাপারে সামান্য কিছু আভাস মেলে। কিছু অভিমানের প্রকাশ মেলে এই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত কবি কৃষ্ণকুমারী চট্টোপাধ্যায়ের বনফুল কবিতার বইটিতে। বিদ্যাসাগরের থেকে আন্দাজ ২০ বছরের ছোট ছিলেন এই কৃষ্ণকুমারী।

Advertisement

ফলে এ সব কথার বিশদ লিখিত বিবরণ না থাকলেও, লোকমুখে বা পারিবারিক বিষাদে, অপমানে সে সব কাহিনি আজও আত্মীয়-পরিজনদের মুখে মুখে ফেরে। সেগুলিকে কল্পনা বলে ভাবা বেশ কষ্টসাধ্য।

মন্দার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৪৫

বঙ্কিমের প্রবন্ধ

ব্রায়ান হ্যাচারের ‘সমাজবিজ্ঞানী বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধের সূত্রে সুদেব মাল তাঁর ‘অশাস্ত্রীয় প্রথা’ চিঠিতে (সম্পাদক সমীপেষু, ২৩-৬) উল্লেখ করেছেন “এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও সে দিন বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় গ্রন্থের বিরুদ্ধে কলম শাণিয়ে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (১২৮০, ৩য় সংখ্যা) প্রকাশ করেন ‘বহুবিবাহ’ নামে প্রবন্ধ।”

আইন করে বহুবিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে সমকালীন বিদ্বৎসমাজের অনেকের সঙ্গেই বিদ্যাসাগরের মতবিরোধ হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রও বঙ্গদর্শন-এ প্রকাশিত ‘বহুবিবাহ’ শীর্ষক প্রবন্ধে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। সমালোচনার মূল প্রতিপাদ্য ছিল যে, যদি আইন করেই বহুবিবাহ প্রথা রদ করতে হয়, তবে শাস্ত্রের উল্লেখের প্রয়োজন কেন! কারণ, শাস্ত্রে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ নয়। তাঁর মতে, “এ বিষয়ে রাজবিধি প্রণীত করিতে গেলে তাহা কি শাস্ত্রসম্মত হওয়া আবশ্যক? না শাস্ত্রবিরোধী হইলেও ক্ষতি নাই? আর যদি শাস্ত্রবিরুদ্ধ হইলেও চলে তবে বহুবিবাহের অশাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করিতে প্রয়াস পাওয়া নিষ্প্রয়োজনে পরিশ্রম করা মাত্র।”

তিনি আরও যা লিখেছিলেন, তা আজকের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “আর একটি কথা এই যে এদেশে অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক মুসলমান। যদি বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আইন হওয়া উচিত হয় তবে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্বন্ধেই সে আইন হওয়া উচিত। হিন্দুর পক্ষে বহুবিবাহ মন্দ, মুসলমানদের পক্ষে ভাল এমত নহে। কিন্তু বহুবিবাহ হিন্দুশাস্ত্র বিরুদ্ধ বলিয়া, মুসলমানের পক্ষেও তাহা কি প্রকারে দণ্ডবিধির দ্বারা নিষিদ্ধ হইবে? রাজব্যবস্থা বিধাতৃগণ কি প্রকারে বলিবেন যে, ‘বহুবিবাহ হিন্দুশাস্ত্রবিরুদ্ধ, অতএব যে মুসলমান বহুবিবাহ করিবে তাহাকে সাত বৎসরের জন্য কারারুদ্ধ হইতে হইবে।’”

তবে বঙ্কিমচন্দ্র কোনও তত্ত্ব বা মূল্যবোধকে নির্দ্বিধায় মেনে নেননি। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন, বহুবিবাহ অতি কুপ্রথা, যিনি তার বিরোধী তিনিই কৃতজ্ঞতাভাজন। সুশিক্ষার ফলে এই প্রথা ক্রমশ লুপ্ত হবে, তার অশাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করে কোনও ফল হবে না। তার জন্য আইনের প্রয়োজন নেই। আর সাধারণের স্বার্থে আইন আবশ্যক মনে করলে, “ধর্ম্মশাস্ত্রের মুখ চাহিবার আবশ্যক নাই।” প্রবন্ধের শেষে তিনি লিখছেন, “উপসংহার কালে আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। তিনি বিজ্ঞ শাস্ত্রজ্ঞ দেশহিতৈষী এবং সুলেখক ইহা আমরা বিস্মৃত হই নাই। বঙ্গদেশ তাঁহার নিকট অনেক ঋণে বদ্ধ। এ কথা যদি আমরা বিস্মৃত হই, তবে আমরা কৃতঘ্ন।”

বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় না হলেও, ১৮৯২-এ প্রকাশিত বিবিধ প্রবন্ধ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয় ওই প্রবন্ধের একাংশ। পুনর্মুদ্রণকালে বঙ্কিমচন্দ্র ভূমিকায় লিখেছিলেন, “স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বারা প্রবর্তিত বহুবিবাহ বিষয়ক আন্দোলনের সময়ে বঙ্গদর্শনে এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রণীত বহুবিবাহ সম্বন্ধীয় দ্বিতীয় পুস্তকের কিছু তীব্র সমালোচনায় আমি কর্ত্তব্যানুরোধে বাধ্য হইয়াছিলাম। তাহাতে তিনি কিছু বিরক্তও হইয়াছিলেন। তাই আমি এ প্রবন্ধ আর পুনর্মুদ্রিত করি নাই। এই আন্দোলন ভ্রান্তিজনিত ইহাই প্রতিপন্ন করা আমার উদ্দেশ্য ছিল, সে উদ্দেশ্য সফল হইয়াছিল। অতএব বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবদ্দশায় ইহা পুনর্মুদ্রিত করিয়া দ্বিতীয়বার তাঁহার বিরক্তি উৎপাদন করিতে আমি ইচ্ছা করি নাই। এক্ষণে তিনি অনুরক্তি বিরক্তির অতীত। তথাপি দেশস্থ সকল লোকেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা করে, এবং আমিও তাঁহাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করি, এ জন্য ইহা এক্ষণে পুনর্মুদ্রিত করার ঔচিত্য বিষয়ে অনেক বিচার করিয়াছি। বিচার করিয়া যে অংশে সেই তীব্র সমালোচনা ছিল তাহা উঠাইয়া দিয়াছি। কোন না কোন দিন কথাটা উঠিবে দোষ তাঁহার, না আমার। সুবিচার জন্য প্রবন্ধটির প্রথমাংশ পুনর্মুদ্রিত করিলাম।

ইচ্ছা ছিল যে এ সময়ে উহা পুনর্মুদ্রিত করিব না, কিন্তু তাহা না করিলে আমার জীবদ্দশায় উহা আর পুনর্মুদ্রিত হইবে কিনা সন্দেহ! উহা বিলুপ্ত করাও অবৈধ; কেন না ভাল হউক মন্দ হউক উহা আমাদের দেশে আধুনিক সমাজসংস্কারের ইতিহাসের অংশ হইয়া পড়িয়াছে— উহার দ্বারাই বহুবিবাহ বিষয়ক আন্দোলন নির্ব্বাপিত হয়, এই রূপ প্রসিদ্ধি।” (বঙ্কিম রচনাবলী)।

প্রসঙ্গত, বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ রদকারী আইন প্রণয়নের দাবিতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও যে হেতু বড়লাট লর্ড এলগিন আইনের মাধ্যমে এই প্রথা বিলোপে পক্ষপাতী ছিলেন না, সে জন্য বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করে কোনও আইন প্রণীত হয়নি। তবে ধীরে ধীরে কৌলীন্য প্রথা ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে এক সামাজিক জনমত গড়ে ওঠায় ক্রমে এই প্রথার বিলুপ্তি ঘটে, যে সম্ভাবনার ইঙ্গিত বিধৃত ছিল বঙ্কিমের প্রবন্ধে।

শান্তনু রায়, কলকাতা-৪৭

মুদ্রার অভাব

বেশ কিছু দিন ধরেই কুড়ি টাকা, দশ টাকা, পাঁচ টাকার নোট অথবা কয়েনের অত্যন্ত অভাব দেখা যাচ্ছে। অথচ, সাধারণ মানুষের প্রতি দিনের দরকার এই ছোট অঙ্কের টাকাগুলোর।

অমিতাভ দাশ, কলকাতা-১২৬

আরও পড়ুন
Advertisement