Tata Motors

সম্পাদক সমীপেষু: ক্ষতির পরিমাপ

ট্রাইবুনালের রায় পর্যালোচনার ক্ষেত্রে টাটার সঙ্গে রাজ্যের কী চুক্তি হয়েছিল, দেখা প্রয়োজন। এটি জনসমক্ষে প্রকাশিত নয়। কিন্তু এই রায়ের একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিহিতার্থ আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:৫৮
An image of Singur

সিঙ্গুরের জমি দেওয়া নিয়ে একটা সমস্যা প্রথম থেকেই ছিল। —ফাইল চিত্র।

সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য টাটা মোটরস-এর যা ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ বাবদ আরবিট্রাল ট্রাইবুনাল পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমকে প্রায় ৭৬৬ কোটি টাকা জরিমানা ধার্য করেছে (সিঙ্গুর নিয়ে টাটাকে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ, ৩১-১০)। খড়্গপুরের কাছে টাটা বহু দিন ধরে জমি নিয়ে শিল্প না করে ফেলে রেখেছে, ওড়িশার গোপালপুর বন্দরেরও একই হাল। জমি ব্যবহার না করার জন্য টাটা সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিকে কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে, বা আদৌ দিচ্ছে কি না, তা অবশ্য পর্দার পিছনেই রয়ে গেল।

Advertisement

সিঙ্গুরের জমি দেওয়া নিয়ে একটা সমস্যা প্রথম থেকেই ছিল। আমলা ও পুলিশের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা বস্তুত ছিল বামফ্রন্টের নীতির বিরোধী। তা ছাড়া ভাগচাষি ও খেতমজুরদের কথাও ভাবা হয়নি। যা বামফ্রন্টের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। কৃষকসভা, খেতমজুর ও ভাগচাষিদের মধ্যে প্রচার চালানো হয়নি। জমি দিতে ইচ্ছুক কৃষকদের মধ্যে অনেকেই ‘অনুপস্থিত জমির মালিক’ ছিলেন, যাঁদের জমি থেকে আয় ছিল না। সিঙ্গুরের এই ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক বিতর্কের জন্য বেশ কিছুটা দায়ী অসমাপ্ত ভূমি সংস্কার; ফলে পশ্চিমবঙ্গের গ্ৰামাঞ্চলে ক্রমাগত চাষের জোত ভাগ হয়েছে (আজ এ রাজ্যে কৃষিজমির মোট পরিমাণের উল্লেখযোগ্য অংশ জমির আল)।

আমূল ভূমি সংস্কারের পরের ধাপে সমবায় প্রথায় চাষের প্রচলন না করার ফলে কৃষি অধিকাংশ মানুষের কাছেই লাভজনক জীবিকা হয়নি। ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে সমস্যা, ফড়ের উপদ্রব, সর্বোপরি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারি অনীহা, সার, বীজ ও বিদ্যুতের মাসুল বৃদ্ধি— সবই সমস্যাকে গভীরতর করেছে। সিঙ্গুরের চাষিদের জমি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা আসলে জমির কেন্দ্রীকরণ ও গ্ৰামাঞ্চলে নতুন জোতদার শ্রেণির উদ্ভবকেই সূচিত করছে, যা বামফ্রন্টের ভূমি সংস্কারের দাবিকে ব্যর্থ করছে।

টাটার গাড়ি কারখানা মূলত একটি মূলধন-নির্ভর প্রকল্প, শ্রমনির্ভর নয়। অনুসারী শিল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা। ফলে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হত না। গ্ৰামীণ স্বল্পশিক্ষিত মানুষদের অধিকাংশকেই ঠিকা শ্রমিক, ছোট দোকানদার বা গৃহস্থালি সহায়ক হিসাবে জীবিকা নির্ভর করতে হত।

ট্রাইবুনালের রায় পর্যালোচনার ক্ষেত্রে টাটার সঙ্গে রাজ্যের কী চুক্তি হয়েছিল, দেখা প্রয়োজন। এটি জনসমক্ষে প্রকাশিত নয়। কিন্তু এই রায়ের একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিহিতার্থ আছে। ক্ষতিপূরণ না দেওয়া হলে শিল্পপতিদের কাছে ভুল বার্তা যাবে, ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্ৰস্ত হবে।

শুভাশিস ঘোষ, কলকাতা-৫৬

আধারের ঝুঁকি

ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন সম্প্রতি সব মেডিক্যাল কলেজে (সরকারি এবং বেসরকারি) আধার-ভিত্তিক বায়োমেট্রিক অ্যাটেন্ডেন্স সিস্টেম চালু করতে বলেছে। এ দিকে পুজোর ঠিক আগেই নানা রাজ্য থেকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা গায়েব করার খবর বেরিয়েছে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, গ্রাহকদের আধার বায়োমেট্রিক ডেটা হ্যাক করে দুষ্কৃতীরা এই কাজ করেছে। প্রশাসন ও ব্যাঙ্কের তরফে আধার বায়োমেট্রিক সিস্টেম লক করে রাখার সুপরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু আধার বায়োমেট্রিক লক করে রাখলে আধার-ভিত্তিক বায়োমেট্রিক অ্যাটেন্ডেন্স সিস্টেম কাজ করবে না। এই সিস্টেমে রেজিস্টার করার সময়ই বিভিন্ন স্তরে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আধার বায়োমেট্রিক ইনফরমেশন শেয়ার হবে, যার যে কোনও একটি স্তর থেকেই হ্যাক করা সম্ভব। পরে এই আধার-ভিত্তিক বায়োমেট্রিক অ্যাটেন্ডেন্স সিস্টেম যদি প্রত্যাহৃতও হয়, তা হলেও হ্যাকারদের হাতে সেই তথ্য রয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে। এমন ব্যবস্থা চালু হলে, বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক-অধ্যাপকদের ব্যক্তিগত তথ্য তথা ব্যাঙ্কে সঞ্চিত অর্থ গায়েব হওয়ার ঝুঁকি থাকছে। এই গোলমেলে নতুন সিস্টেম চালু করার কারণ কী?

বিষাণ বসু, কলকাতা-৭৮

মুদ্রার সাক্ষ্য

আমার ‘দুই সময়ের সন্ধি’ (১-১০) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ‘একই ব্যক্তি’ (১১-১০) চিঠিটির জন্য শুভশ্রী বণিককে ধন্যবাদ। ১৭৮৩ সালে কালীঘাটের গুপ্ত মুদ্রাভান্ডার আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে ১৮৩০-এর দশকে জেমস প্রিন্সেপ ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধার করা পর্যন্ত এই মুদ্রায় উৎকীর্ণ লিপির গুরুত্ব কেউ বোঝেনি— এই মন্তব্যকে খণ্ডন করতে তিনি জানিয়েছেন, ১৮২৫-এ উইলিয়াম মার্সডেন হিন্দুরাজাদের এই স্বর্ণমুদ্রায় চন্দ্র, লক্ষ্মী এবং ‘শ্রী বিক্রমঃ’ উৎকীর্ণ থাকতে দেখেছেন। ঐতিহাসিক ভাবে গুপ্তমুদ্রার গুরুত্ব অনুধাবন করা বলতে অবশ্যই বোঝায় মুদ্রাগুলিকে গুপ্ত রাজবংশের মুদ্রা হিসাবে চিহ্নিত করতে পারা, যা ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধারের আগে সম্ভব ছিল না। মার্সডেন তা পারেননি।

শুভশ্রী লিখেছেন, রিচার্ড সলোমনের বিখ্যাত গ্রন্থে সাঁচির ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধারের সাল ১৮৩৭, প্রবন্ধে উল্লিখিত ১৮৩৬ নয়। সাধারণত ১৮৩৭-কেই ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধারের সাল বলে উল্লেখ করা হয় এ কথা ঠিক। কিন্তু এ প্রসঙ্গে প্রিন্সেপের মূল কাজগুলি পড়লে বোঝা যায়, প্রিন্সেপের ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধার ছিল একটি প্রক্রিয়া, যার ক্রমবিকাশ ধরা পড়ে ১৮৩৬-৩৮ সালের মধ্যে, এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত প্রিন্সেপের অনেক প্রবন্ধে। এই সিরিজ়ের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘ফ্যাক্সিমিলিজ় অব ভেরিয়াস এনশিয়েন্ট ইনস্ক্রিপশনস’ (জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, খণ্ড ৫) প্রকাশিত হয় ১৮৩৬ সালে।

আমার প্রবন্ধে পৌরাণিক বৈষ্ণবধর্মের উত্থানের সঙ্গে গুপ্ত রাজশক্তির সম্পর্কের কথা আলোচিত হয়েছে। গুপ্তরাজারা বৈষ্ণবধর্মের থেকেই রাজশক্তির অনুমোদন পেতেন, তাই গুপ্ত চক্রধ্বজ মুদ্রার চক্র যে বিষ্ণুর চক্র (বৌদ্ধ ধর্মচক্র নয়), পত্রলেখিকার উল্লেখ করা এই তথ্য মূল প্রবন্ধের মতেরই অনুসারী। তবে পৌরাণিক বৈষ্ণবধর্মের এই চক্রকে বৈদিক ধর্মানুসারী অশ্বমেধ যজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা কষ্টকল্পনা মনে হয়, কারণ গুপ্তরাজাদের অশ্বমেধ-মুদ্রায় স্পষ্টতই অশ্ব-প্রতিকৃতি পাওয়া যায়।

যে প্রসঙ্গটি একটু বিশদ আলোচনার দাবি রাখে তা হল, সঞ্জীব কুমার শিবলী-র সাম্প্রতিক বইয়ের ভিত্তিতে পত্রলেখিকার দাবি যে, রামগুপ্ত ও কাচ একই ব্যক্তি। উল্লেখ্য, শিবলীর বইটি তাঁরই স্বনামাঙ্কিত শিবলী ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত, যা গবেষণাক্ষেত্রে প্রচলিত ‘পিয়ার রিভিউ’ পদ্ধতির অনুকূল নয়। যে তর্কযোগ্য মুদ্রার ভিত্তিতে শিবলী এই দাবি করেছেন, সেটিও শুধুমাত্র তাঁরই শিবলী ট্রাস্টের সংগ্রহে রয়েছে বলে দাবি। এই দাবিকে সত্য ধরলেও বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ে। প্রথমত, তাঁর ব্যবহৃত কাচগুপ্ত নামটি কোনও গুপ্ত উপাদানে পাওয়া যায় না। নামটি আসলে পদবি-বিহীন ‘কাচ’। দ্বিতীয়ত, শিবলীর দাবি এই ‘কাচ’ শব্দটি রামগুপ্তের অশ্বমেধ মুদ্রার গৌণ দিকে পাওয়া যায়। কিন্তু, তিনি আরও দাবি করেছেন যে, একই শব্দ সমুদ্রগুপ্তের অশ্বমেধ মুদ্রা ও ধনুর্ধর মুদ্রাতেও পাওয়া যায়। সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় প্রাপ্ত শব্দটি যে ‘কাচ’ নয়, এ কথা মুদ্রাতত্ত্ববিদদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। তা ছাড়া একই শব্দ দুই রাজার মুদ্রায় পাওয়া গেলে তা ব্যক্তিনাম না হওয়াই স্বাভাবিক। যদি সমুদ্রগুপ্ত ও রামগুপ্ত উভয়ের মুদ্রাতেই ‘কাচ’ শব্দটি থেকেও থাকে, তা কেন রামগুপ্তের সঙ্গে কাচের সাযুজ্য প্রমাণ করবে, সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে বা কোনও বংশনামের কথা নয়, তা স্পষ্ট নয়। পরিশেষে, ঘটোৎকচগুপ্ত রামগুপ্তের ‘পূর্বপুরুষ’ নন, রামগুপ্তের ভাই ও উত্তরসূরি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অন্যতম সন্তান।

কণাদ সিংহ, কলকাতা-৮৪

আরও পড়ুন
Advertisement