‘বৈষম্য আজও’ (২০-৩) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পটি। কাঙালির মা মৃত্যুর পর ছেলের হাতে আগুন পেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। গরিব এবং দুলে বলে মাকে দাহ করার জন্য কেউ তাকে কাঠ দেয়নি। তাই খড়ের আঁটি জ্বেলে মায়ের মুখে ছুঁইয়ে ফেলে দিয়ে নদীর চরে গর্ত খুঁড়ে মাকে মাটি চাপা দিতে বাধ্য হয় কাঙালি। এ ভাবেই সে মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছিল।
হায় রে! আমাদের দেশে আজও অবাধে চলে সেই একই জাত-ধর্ম-বর্ণ নিয়ে অবর্ণনীয় বজ্জাতির খেলা। অস্পৃশ্যতা আইনত নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে তার কোনও ছাপ নেই। তার জ্বলন্ত প্রমাণ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার গীধগ্রামের ঘটনা। গীধগ্রামের বহু প্রাচীন শিবমন্দিরে দাসপাড়ার শতাধিক দলিত পরিবারের কোনও প্রবেশাধিকার নেই। মানুষের সমাজে প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দিরে সব মানুষের পুজো দেওয়ার অধিকার নেই! শুধু কাটোয়ার গীধগ্রাম নয়, নদিয়ার কালীগঞ্জের দলিত সম্প্রদায়ের মানুষেরও অধিকার ছিল না শিবমন্দিরে প্রবেশ করার। আন্দোলন করে শিবমন্দিরে পুজো দেওয়ার অধিকার আদায় করেছেন গীধগ্রাম ও কালীগঞ্জের দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। আশার কথা, প্রশাসন এলাকার মানুষের সঙ্গে ছিল। প্রশ্ন, এ সব বিষয়ে প্রশাসনিক সাহায্যের দরকার হবে কেন? ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও অস্পৃশ্যতার অমানবিক ঘটনার কথা অজানা নয়। এখানে উচ্চবর্ণের পাত্র থেকে জলপানের অপরাধে প্রাণ দিতে হয় এক নয় বছরের বালককে। নিম্নবর্ণের প্রতি অবহেলা, অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, অনাচারের ঘটনাগুলির বিবরণের ক্ষেত্রে শুধু রাজ্যের নাম পাল্টায়, অবস্থা পাল্টায় না। স্বাধীনতা লাভের বয়স বাড়ে কিন্তু কমে না জাত-যন্ত্রণা, ধর্মের নামে বিদ্বেষ।
সত্যকিঙ্কর প্রতিহার, যমুনা, বাঁকুড়া
কালিমা ঘুচবে?
‘বৈষম্য আজও’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে কিছু কথা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর সাত দশক অতিক্রান্ত। কিন্তু এখনও ভারতের সমাজজীবন থেকে জাতিগত বৈষম্য দূর হয়নি। সম্প্রতি পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার ঘটনাটি সেই সত্যকে আবার এক বার স্পষ্ট করে দিয়েছে। হিন্দু ধর্মের মানুষের মধ্যে তথাকথিত উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের বিভেদ আজও এই রাজ্যে বহাল তবিয়তে টিকে আছে। যদিও সৌভাগ্যের বিষয়, দেশের অন্য আরও কিছু রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলো এখনও নির্বাচনী লড়াইয়ে জাতপাতকে টেনে আনেনি।
স্বাধীনতার পরে সংবিধান প্রণেতারা সাম্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বর্ণভেদ প্রথা বিলোপের চেষ্টা করেছিলেন। শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে নিম্নবর্ণের নাগরিকদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাও চালু হয়েছিল। তা আজও নানা বিরুদ্ধ-সমালোচনা সত্ত্বেও চালু আছে। সংবিধানের ১৭ নম্বর ধারায় সব রকম অস্পৃশ্যতার চর্চাকে নিষিদ্ধও বলা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে দলিতদের বৈষম্য ও অত্যাচারের শিকার হতে দেখা যায়। আর আইনমতে শাস্তির ব্যবস্থা করা তো দূর, অনেক সময় এই সমস্ত ঘটনায় প্রশাসন থাকে নির্বিকার। ফলে নিম্নবর্ণের নাগরিকদের সামাজিক পরিসরে বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পাশাপাশি আজগুবি অজুহাত তৈরি করে দলিত শিশুকে পিটিয়ে মারা, দলিত নারীকে ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধ চলতেই থাকে।
সংবাদে প্রকাশ, বহু বছর ধরে উচ্চবর্ণের মানুষদের বাধায় কাটোয়ার গীধগ্রামের দাসপাড়ার দলিত সম্প্রদায়ের মানুষেরা শিবমন্দিরে প্রবেশ করতে পারতেন না। এ বারে তাঁরা বিষয়টি নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের দ্বারস্থ হন। শেষ পর্যন্ত দাসপাড়ার মানুষ মন্দিরে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন। কিন্তু কেবল দলিতরা মন্দিরে প্রবেশাধিকার পেলেই তো হল না, দেশ তথা রাজ্যের তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষের মন থেকে কি জাতের ভিত্তিতে অন্যকে হীন ভাবে দেখার শতাব্দীপ্রাচীন এই কুপ্রথা কখনও দূর হবে?
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
জাতির লজ্জা
‘বৈষম্য আজও’ সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে আমার কিছু বক্তব্য রয়েছে। আমরা তো শুনি পশ্চিমবঙ্গ নাকি ভারতের অন্য কিছু রাজ্যের চেয়ে বেশি সচেতন এবং সামাজিক দিক থেকে অনেক এগিয়ে। এখানে জাতিগত ভেদাভেদ তথা অস্পৃশ্যতার কোনও স্থান নেই। তবে কাটোয়ার গীধগ্রামে এত বছর ধরে স্থানীয় দাস সম্প্রদায়ের মানুষদের শিবমন্দিরে ঢুকতে বা পুজো দিতে দেওয়া হয়নি কেন? অবাক লাগে, ২০২৫ সালে আধুনিক ভারতে, তাও আবার প্রগতিশীল বলে গর্বিত বাংলায় কিছু মানুষের পরিচয় দেওয়া হচ্ছে ‘মুচি’ বলে! তাঁরা মানুষ, এটাই কি যথেষ্ট নয়? মন্দিরে পুজো দিতে গেলে তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে!
অথচ ১৯৫৫ সালে পাশ হয়েছে অস্পৃশ্যতা নিরোধক আইন। অস্পৃশ্যতা থেকে উদ্ভূত কোনও রকম বাধাপ্রদানকারী কাজই আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অবাক লাগে, অস্পৃশ্যতা নিরোধক আইন থাকা সত্ত্বেও উচ্চবর্ণের একচেটিয়া আধিপত্য তথা নিম্নবর্ণের উপর অত্যাচার আজও চলছে কী ভাবে? আর এ বিষয়ে পুলিশের কাছে দরবার করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাহায্য মেলে না। এ কেমন আধুনিকতা?
তা ছাড়া প্রশ্ন জাগে, দেশের আইন তথা সংবিধানের ১৭ নম্বর ধারাকে উপেক্ষা করে যারা আজও এ ভাবে অস্পৃশ্যতাকে মদত দিচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত করছে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসন নীরব কেন? কেন কিছু মানুষকে মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য আদালতে যেতে হবে, পুলিশের সাহায্য নিয়ে মন্দিরে পুজো দিতে হবে? ওই বাধা প্রদানকারীরা এত সাহসই বা পায় কোথা থেকে? আসলে এই ঘটনাকে শুধুমাত্র পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা বা বৈষম্য বলে উপেক্ষা করলে চলবে না, সামগ্রিক ভাবে এটা এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি, সমগ্র ভারতীয় সমাজের লজ্জা! ভাবলে মাথা নত হয়ে যায়, এই ব্যাধি তথা লজ্জায় বাংলাও আক্রান্ত! রামমোহন বিদ্যাসাগর বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথের বাংলার এ কী দুর্দশা! তারা আজও অস্পৃশ্যতাকে আঁকড়ে থাকবে? ভাবা যায় না!
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
প্রতিকার চাই
‘বৈষম্য আজও’ সম্পাদকীয়টি নিয়ে কিছু কথা। স্বামী বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন কোনও জাতি ভেদাভেদ থাকবে না। মহাত্মা গান্ধীর ভাবনায় ছিল, দেশে জাতিভেদ থাকবে না। অস্পৃশ্যতা নিরোধক আইন পাশ হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। বলা হয়েছিল, অস্পৃশ্যতার চৰ্চা এক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ভারতীয় সংবিধানও ১৭ নম্বর ধারায় অস্পৃশ্যতার অনুশীলন নিষিদ্ধ করেছে। তা সত্ত্বেও, বিভিন্ন রাজ্যে অস্পৃশ্যতার ভয়ঙ্কর রূপ আমাদের ত্রস্ত, সন্ত্রস্ত, আতঙ্কিত করে। এ বিষয়ে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে নেই। তবে, মনে করা হত এ রাজ্যে এই সমস্যার অভিঘাত অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় কম।
কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা আমাদের সেই ধারণাকে টলিয়ে দিয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার গীধগ্রামে বহু প্রাচীন এক শিবমন্দিরে প্রবেশের ন্যায্য দাবি নিয়ে দাসপাড়ার বহু দলিত পরিবার আন্দোলন করে শেষে অধিকার অর্জন করেছেন। তাঁদের প্রতি এত অবহেলা যে মন্দিরের সিঁড়িতে পা পর্যন্ত ফেলতে দেওয়া হত না। জাতিগত কারণ থেকে উদ্ভূত এমন বহু অন্যায় এই রাজ্যে আড়ালে-আবডালে বা প্রকাশ্যে ঘটেই চলেছে, অবিলম্বে এগুলিকে রুখে দেওয়া উচিত। নয়তো দেহের একটি অংশে পচন ধরলে যেমন সমগ্র দেহ শেষ হয়ে যায়, রাজ্যও অনুরূপ ধ্বংসের পরোয়ানার মুখোমুখি দাঁড়াবে।
প্রশাসনের এ বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করা উচিত।
মানিক কুমার বসু, কলকাতা-১০৮