‘কালো যদি মন্দ হবে...’ (১৫-৩) শীর্ষক শ্রীদীপের প্রবন্ধটি সাদার প্রতি ভালবাসা আর কালোর প্রতি অবহেলার জ্বলন্ত শব্দচিত্র। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সাদা-প্রীতির অজস্র নমুনা আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। যেমন— জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নবাণ ছুটে আসে— কী হল, ছেলে না মেয়ে? এর ঠিক পরের প্রশ্ন— গায়ের রং কেমন, ফরসা না কালো? ছেলের গায়ের রং নিয়ে তেমন প্রশ্ন না উঠলেও মেয়ের গায়ের রং কালো হলেই পরিজনদের গালে হাত আর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। একটি ঘটনা উল্লেখ করি— রামনাথ রায়ের (নাম পরিবর্তিত) একমাত্র মেয়ে কাকলি (নাম পরিবর্তিত)। খুব ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবার আদরযত্নেই বড় হয়। সামনেই তার আবার বিয়ের দেখাশোনা পরীক্ষা। ‘আবার’ বলার কারণ হল, এর আগে তিন বার দেখাশোনার পরীক্ষায় বসেছে। কিন্তু পাশ করতে পারেনি। এটি চতুর্থ বার। পাশ করতে পারবে তো? গায়ের রং নিয়ে পাত্রপক্ষ প্রশ্ন তুলবে না তো— মনের মধ্যে এমনই সব দুশ্চিন্তা ঘোরাফেরা করে। এখনও আমাদের সমাজে নারীদের নানা ভাবে অপমানিত হতে হয়, মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
কাকলির গায়ের রং শ্যামবর্ণ বলে পাত্রপক্ষের অপছন্দ। তবে কাকলি শুধু একা নয়, আমাদের সমাজে কাকলির মতো অনেক মেয়ের জীবনেই এ রকম অসম্মানজনক ঘটনা ঘটে, যা খুবই দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। প্রথাগত শিক্ষার পরীক্ষায় ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করলেও দেখাশোনার পরীক্ষায় কাকলি তিন বারই পাশ করতে পারেনি। তবে আনন্দের কথা, চতুর্থ বারের দেখাশোনার পরীক্ষায় সে সসম্মানে পাশ করেছে। পাত্রপক্ষ কাকলির শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকটিই গুরুত্ব সহকারে দেখেছে, পাত্রীর গায়ের রঙের দিকটি নয়।
আবার একটি অন্য দিকও আছে। বিয়ের পণ দেওয়া ও নেওয়া দুই-ই অপরাধ জেনেও কন্যাপক্ষ অনেক সময়ই নিরুপায় হয়ে পণ দিতে বাধ্য হয়, বিশেষত পাত্রীর গায়ের রং কালো হলে। কালো মেয়েদের নিয়ে এ রকম অসংখ্য উপাখ্যান আমাদের এই তথাকথিত সভ্যসমাজে ছড়িয়ে আছে। কালো হলেও তারা যে মানুষ, অন্যরা তা মনে করে না। সমাজে কান পাতলে আজও শোনা যায় কতশত কালো মেয়ের কান্না। এটা আমাদের চরম লজ্জার।
সত্যকিঙ্কর প্রতিহার, দেশড়া, বাঁকুড়া
কালো ও আলো
শ্রীদীপের ‘কালো যদি মন্দ হবে...’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। বিশ্বকবি লিখেছেন, “...অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো/ সেই তো তোমার আলো!” অন্ধকার না থাকলে আলোর প্রকাশ অন্তরে প্রেরণা জাগাত না। কবি বুদ্ধদেব বসু ‘বর্ষার দিন’ কবিতায় লিখেছেন, “পৃথিবীতে যেন দিন নেই, রাত নেই;/ স্তম্ভিত কাল মেঘ-মায়ালোকে লীন।” আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো কবেই বলেছেন— “রাতের সব তারাই আছে/ দিনের আলোর গভীরে।”
অর্থাৎ, আলো অন্ধকারকে মুষ্টিবদ্ধ রেখে প্রকৃতিতে আধিপত্যবাদ বিস্তার করতে চায়। আলোর প্রগতিশীল ব্যঞ্জনা অন্ধকারকে শুধুই পরিহাস করে। মৃত্যুর রং কি কালো? না কি জীবনের দৃষ্টিতে নেমে আসা আঁধারের রূপেই শোকের মুহূর্ত-রং সব কিছুই আমাদের কাছে কালো হয়ে যায়! ঈশান কোণে মেঘ দেখলে মাঝি-মাল্লারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়, আবার শ্বাপদসঙ্কুল পথে একাকী রমণীর অন্ধকার পথটিকে কখনও বা ‘দুস্তর পারাবার’ মনে হয়। তবুও শক্তির সাধনায় সমাজে কালোরূপেই মাতৃমূর্তি অনন্যা হয়ে ওঠে। কাজী নজরুল ইসলাম যখন লেখেন “(আর) লুকাবি কোথায়, মা কালী” কিংবা ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়’; তখন ‘পাত্র চাই পাত্রী চাই’-এর বিজ্ঞাপনে ফরসা, সুশ্রী ইত্যাকার বিশেষণগুলি নারীর রূপ সম্বন্ধে আমাদের সমাজের ইন্দ্রিয়গুলিকে কি সচেতন করে? শিল্পে এক্সপ্রেশনিজ়ম-ইমপ্রেশনিজ়ম’এর হাত ধরে আলোর পাশে ছায়াঘন ‘কালো’-র ব্যবহার মানবিক মনে অনুভবের জন্ম দেয়।
প্রবন্ধকার বলেছেন, সাদা তথা ফরসা হওয়ার স্বপ্ন আমাদের যেন মজ্জাগত, আর তার অফুরন্ত জোগাড় ও আহ্বানও বাজারের প্রতি কোণে। সাদা-প্রীতি নিয়ে আমাদের কোনও রাখঢাক নেই। শ্বেত-লালসা এমনই চরম মাত্রায় বিরাজমান যে, তা নিয়ে বিব্রত হওয়ার দায় একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গের— এই কথাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক চেতনার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দেশ আমেরিকাতেও কয়েক বছর পূর্বে এক জন কালো মানুষের প্রতি এক পুলিশের অমানুষিক অত্যাচারে সমগ্র বিশ্ব গর্জে উঠেছিল। অর্থাৎ, শিক্ষা চেতনার তুঙ্গ স্তরেও ‘কালো’ সম্পর্কে মানুষের বিদ্বেষ অমলিন।
তবে, “কালোরূপে দিগম্বরী হৃদিপদ্ম করে মোর আলো রে...” বলে যখন আমরা শ্যামা মায়ের আরাধনায় নিজেদের হৃদয়পদ্মকে মেলে ধরি; তখন ‘কালো’ রঙের ‘ভয়ঙ্কর রূপ’ আমাদের মনকে এতটুকু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে না! সাদা প্রীতি নিয়ে যতই আমরা উদ্বেলিত হয়ে উঠি, ‘রৌদ্র স্নানে’ ত্বকটুকু সেঁকে নেওয়ার বাসনা থেকেই তো পাশ্চাত্যের মানুষ এখনও সমুদ্রতটে ভিড় করেন। নবদ্বীপে শচীমাতার কোলে মাটির আঁতুড় ঘরে, গোধূলি মুহূর্তে অসাধারণ রূপমণ্ডিত যে শিশুটি জন্ম নিল, তাকে দেখে আত্মীয়স্বজনের মনে হয়েছিল, সে এক স্বর্গভ্রষ্ট নবজাতক। চেহারায় শুধু বড়সড় নয়, পাকা সোনার মতো তার গায়ের রং। সারা শরীর থেকে দুধ-হলুদ যেন গড়িয়ে পড়ছে। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে বাংলার অন্ধকারকে আলোয় নিয়ে আসা মানুষটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় ‘পাকা সোনার মতো তার গায়ের রং’ বলেই বর্ণিত হয়েছিলেন। তাই বঙ্গদর্শনে পাকা সোনার মতো রং, কিংবা পাকা ধানের সোনালি রং— সব কিছুই আমাদের কাছে বড় আদরের। নবদ্বীপের গৌরবর্ণের দৃপ্ত যুবক যখন এত দিনের অবহেলার অন্ধকারে বসবাসকারী মনগুলিকে কাছে টেনে নেন; তখন সমাজের অন্ধকার দিকগুলোও আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। খনির কালো প্রস্তুরখণ্ডকে ঘষে-মেজে শ্রমজীবীদের দীর্ঘ পরিশ্রম যখন ‘হীরক দ্যুতি’র উজ্জ্বলতায় রূপান্তরিত হয়, কিংবা খনিগর্ভ থেকে শ্রমিকদের তুলে আনা ‘কালো হিরে’ যখন সভ্যতার বুকে উত্তাপ ছড়িয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়; সেও তো এক কালো রঙের উত্তরণ হিসেবেই সমাজে মান্যতা পায়।
সঞ্জয় রায়, হাওড়া
জাল ওষুধ
‘জাল ওষুধের রমরমা বাড়ছে, মানছে ব্যবসায়ী সংগঠনই’ (৮-৩) শীর্ষক সংবাদে প্রকাশ, সম্প্রতি ‘সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজ়েশন’ (সিডিএসসিও) সূত্রে জানা গিয়েছে যে, গত তিন মাসে প্রায় ৩০০টি ওষুধ গুণমানের পরীক্ষায় ফেল করেছে। অধিকাংশ ওষুধই খুব প্রয়োজনীয়। যার মধ্যে এই রাজ্যে একাধিক সংস্থার তৈরি বেশ কিছু ওষুধও আছে। মানুষ ওষুধ খান রোগ নিরাময়ের জন্য। কিন্তু নিম্নমানের, জাল ওষুধ খেলে তাঁরা কী করে রোগমুক্ত হবেন? চিকিৎসকদের কথা অনুযায়ী, নিম্নমানের ওষুধ খেলে রোগীর রোগ তো সারবেই না, উপরন্তু বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। মৃত্যুও ঘটতে পারে। ওষুধ গরিব, বড়লোক সবাই সেবন করে থাকেন। বিশেষত গরিব মানুষ অনেক কষ্টে অর্থ জোগাড় করে ওষুধ খান। কিন্তু তাঁরা ওষুধে রোগমুক্ত না হলে চিন্তার বিষয়।
সাধারণ মানুষ জানেন না কোন ওষুধ নিম্নমানের, কোনটি জাল। তাই ওষুধের উপর সরকারের ১০০ শতাংশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত। ওষুধের কারখানা থেকেই সরকারি নজরদারির মাধ্যমে ওষুধে ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর জাল ওষুধ বা নিম্নমানের ওষুধের প্রস্তুতকারক, বিক্রেতা সবাইকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। জাল ওষুধ খেয়ে যদি রোগীর মৃত্যু ঘটে, অথবা রোগ না সারে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কেন খুনের মামলা রুজু করা হবে না?
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি