Kolkata Doctor Rape and Murder

সম্পাদক সমীপেষু: দেরি হল দু’বছর

রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা সন্দীপ ঘোষ-বিরূপাক্ষদের দুর্নীতি ও হাসপাতালের হুমকি-প্রথার বিষয়টি জানতেন, এবং কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা করতে পারেননি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৩১

দেবাশিস ভট্টাচার্য তাঁর ‘কেন এত দেরি’ (২৬-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, আর জি করের ঘটনার পরেই যদি মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন তা হলে হয়তো এই আন্দোলন এত দিন চলত না। এখানে মনে হওয়া স্বাভাবিক, যদি আর জি করের প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলির অভিযোগগুলি তদন্ত করে স্বাস্থ্য দফতর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ করত, তা হলে হয়তো তিলোত্তমাকে মরতে হত না, আর ডাক্তারদেরও আন্দোলনে বসতে হত না। আখতার আলি প্রায় দু’বছর আগে হাসপাতালে চূড়ান্ত দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট ভাবে স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ স্তর, এমনকি নবান্নেও জানিয়েছিলেন। কোনও বিহিত না হওয়ার ফলে বাধ্য হয়ে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তৃণমূলের এক চিকিৎসক সাংসদ ওই নারকীয় ঘটনা ঘটার অনেক আগেই আর জি কর হাসপাতালের দুর্নীতির নিয়ে প্রভূত অভিযোগ জানিয়েছিলেন।

Advertisement

সুতরাং, রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা সন্দীপ ঘোষ-বিরূপাক্ষদের দুর্নীতি ও হাসপাতালের হুমকি-প্রথার বিষয়টি জানতেন, এবং কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা করতে পারেননি। ৯ অগস্ট পড়ুয়া চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। এর পর থেকে জুনিয়র ডাক্তারদের দু’মাসেরও অধিক সময় ধরে চলা আপসহীন আন্দোলন, এবং এই আন্দোলনের সমর্থনে রাজ্য এবং দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের দাবি সরকারকে অনেকটাই পিছু হটতে বাধ্য করেছে। আসলে ২০১৩ সালে সারদা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে ২০২৩ সালের রেশন দুর্নীতি অবধি রাজ্য প্রশাসন যে ভাবে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করেছিল, আর জি করের ঘটনাকেও সেই ভাবেই সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।

শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায় ভদ্রেশ্বর, হুগলি

চিকিৎসার দায়

দেবাশিস ভট্টাচার্যের সঙ্গে কয়েকটি বিষয়ে একমত হতে পারলাম না। প্রথমত, তিনি লিখেছেন যে, জুনিয়র ডাক্তারদের লাগাতার আন্দোলনে অসংখ্য রোগী নাকাল হয়েছেন, এবং কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ রাজ্যে সব মিলে প্রায় ৯৩,০০০ ডাক্তার আছেন, যার মধ্যে মাত্র ৭,৫০০ জন জুনিয়র ডাক্তার আর জি কর হাসপাতালের কাণ্ডের প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করছিলেন। বাকি ডাক্তার তো এ রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে তাঁদের পরিষেবা চালিয়ে গিয়েছেন। প্রায় ৪১ দিনের আন্দোলনের সময় সিনিয়র ডাক্তাররা নিজেদের কর্তব্য করার পরেও জুনিয়র ডাক্তারদের অনুপস্থিতির জন্য পরিষেবার ফাঁকফোকরগুলি ভরাট করতে হাসিমুখে দিনরাত অতিরিক্ত পরিশ্রম করেছেন। আবার গত ৯ সেপ্টেম্বর মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে আন্দোলনকারীদের তরফে এ-ও জানানো হয় যে, এ রাজ্যের ১৭৩৭টি হাসপাতালের মধ্যে ১৫০০টি হাসপাতালে পুরো ডিউটি করছেন সিনিয়র ডাক্তাররা। আর জুনিয়র ডাক্তাররা হাসপাতালের বাইরে ক্যাম্প করে ডিউটি করছেন। ওই দিনই রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে মহামান্য আদালতকে জানানো হয় যে, এই কর্মবিরতি চলাকালীন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। কয়েক দিন পরে সরকার ২৯ জনের তালিকা প্রকাশ করে। কর্মরত ডাক্তারদের সময় এবং সংখ্যা বিচার করলে রাজ্য সরকারের দাবিটির যথার্থতা সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। প্রকৃত তথ্য যা-ই হোক, বিভিন্ন প্রজন্মের, বিভিন্ন পেশার নাগরিক যে ভাবে দিনের পর দিন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে সমর্থন করেছেন, সেটা এক কথায় অভূতপূর্ব।

দ্বিতীয়ত, প্রবন্ধকার এ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারী ডাক্তারদের পেটানো, বা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ‘এসমা’ জারি করে চিকিৎসকদের উপর চাপ সৃষ্টির ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ সব পথে যাননি। জুনিয়র ডাক্তাররা কিন্তু সরকারি কর্মচারী নন। ফলে, তাঁদের উপর এসমা প্রয়োগ করা যায় না। আর এই মুহূর্তে জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে আছেন সিনিয়র ডাক্তাররাও, যাঁরা জুনিয়র ডাক্তারদের উপর সরকারের পক্ষ থেকে কোনও রকম দমন-পীড়ন দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে পথে নামতে প্রস্তুত। আর সবার উপরে আছে এই আন্দোলনের অন্যতম শক্তি নাগরিক সমাজ, যাঁরা দিন-রাত উপেক্ষা করে এই আন্দোলনের শিকড়ে জলসিঞ্চন করছেন। যাঁরা লক্ষ করেছেন, কী ভাবে এ রাজ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অপরাপর প্রশাসনিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রগুলিতে দুর্নীতির শিকড় ছড়িয়ে পড়েছে। সুতরাং, জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে সামান্যতম পদক্ষেপ করলে সেটা যে ভিমরুলের চাকে ঘা দেওয়ার শামিল হবে, তা মুখ্যমন্ত্রী ভাল ভাবেই জানেন। কোনও পদক্ষেপ না করে তিনি এটাই প্রমাণ করলেন যে, তিনি এক জন বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ।

তৃতীয়ত, প্রবন্ধকার কোনও এক সূত্র থেকে শুনেছেন যে, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, সুপার, বিভাগীয় প্রধানের ভূমিকা, এক্তিয়ার ইত্যাদি বিষয়ে ‘নির্ভরযোগ্য’ মহল থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের বিচারবুদ্ধিতে চললে সম্মান ও সঙ্কট দুটোই সামলানো সহজ হত। কথাটা হাস্যকর। পাঁচ দশকেরও বেশি যিনি সক্রিয় রাজনীতি করছেন, তাঁকে এই বিষয়গুলি সম্বন্ধে পরামর্শ দিতে বা অবহিত করতে হবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। বিশেষ করে সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! যে দু’টি দফতরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, সেই স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র দফতর দু’টিই মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে। সুতরাং, তিনি কোনও মতেই নিজেকে এর দায় থেকে সরিয়ে রাখতে পারেন না। তিনি স্বাস্থ্য দফতরের দুই অধিকর্তা এবং কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে পদ থেকে সরিয়ে কোনও মতে অবস্থা সামলে নিলেন।

এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, আমাদের দেশের আইএএস বা আইপিএস অফিসারেরা কিন্তু মেধার দিক থেকে যে কোনও দেশের সমতুল্য। তাঁদের সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে যত কম ব্যবহার করা যায় ততই রাজ্যের ও দেশের মঙ্গল। বিরোধী-দলনী নয়, দুর্নীতি-দলনী রূপে এ রাজ্যের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখতে চান। দুর্নীতি মুক্ত, হিংসাবিহীন, শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজই এই মুহূর্তের দাবি।

অমিত কুমার চৌধুরী কলকাতা-৭৫

সর্ষের মধ্যে

জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে রাজনীতির রং লাগেনি, তা সত্যি কথা। কিন্তু সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষেত্রে যে পারদর্শিতা তাঁরা দেখালেন, তা যে-কোনও ঝানু রাজনীতিকের ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠতে পারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দুঁদে রাজনীতিকের সঙ্গে এমন লড়াইয়ের মানসিকতা, শর্ত আরোপ করার বিচক্ষণতা সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। রাজ্যের মানুষের চিকিৎসা না-পাওয়া এবং কিছু রোগীর মৃত্যু নিয়ে সরকারি প্রচার ডাক্তারবাবুদের প্রায় ‘গণশত্রু’ করে তুলেছিল। তবে মহিলা চিকিৎসক-পড়ুয়ার মৃত্যুর প্রতিবাদে আন্দোলন অনন্য এক মাত্রায় পৌঁছনোয়, আন্দোলনের অনেক দোষত্রুটিও ধামাচাপা পড়েছে।

এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, ডাক্তার সমাজের একটি অংশ স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্নীতির অঙ্গ। কাক যেমন কাকের মাংস খায় না, তেমনই কোনও ডাক্তারবাবু ভুল করলে অন্য এক ডাক্তারবাবু তাঁকে কিছুতেই দোষী সাব্যস্ত করেন না। আর জি কর কাণ্ডের তদন্তের জেরে এক দল প্রবীণ ডাক্তার ‘গণশত্রু’ বলে চিহ্নিত হতে চলেছেন। অভিযোগ, তাঁরা রাজনীতিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অপরাধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এমন তমসাচ্ছন্ন রাজনীতির হাত ধরেই উঠে আসছেন সন্দীপ ঘোষের মতো ব্যক্তিরা। এখনও এই মহৎ পেশায় কত দুর্নীতিগ্রস্ত ডাক্তার লুকিয়ে আছেন, ভবিষ্যৎই তা বলবে!

সঞ্জয় রায় দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

আরও পড়ুন
Advertisement