নীলোভা রায়চৌধুরীর লেখা “কাকে বলে ‘নেগেটিভ’ খবর” (২৫-১১) প্রসঙ্গে এই চিঠি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা যে জায়গায় পৌঁছেছে, তেমন পরিস্থিতি সম্ভবত পরাধীন দেশেও ছিল না। ব্রিটিশ শাসনকালে যুগান্তর, অমৃতবাজার-এর এমন করুণ অবস্থা হয়নি। বেঙ্গল গেজেট-এরও এমন প্রাণান্তকর পরিস্থিতি হয়নি।
হিকি সাহেবের বেঙ্গল গেজেট-এর উপর ব্রিটিশের অত্যাচারের কথা আমরা জানি। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি মাথা নোয়াননি। কিন্তু বর্তমানে গণতন্ত্রের এমনই পরিণতি যে, সংবাদ-স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২তম স্থান ভারতের— বোঝা যাচ্ছে বর্তমান শাসকরা গণতন্ত্রের কী হাল করেছেন! সাংবাদিকদের পজ়িটিভ খবর শাসকের কাছে নেগেটিভ হয়, মানুষের কাছে নেগেটিভ খবর শাসকদের কাছে পজ়িটিভ হয়। সংবাদ-স্বাধীনতার কথা এখন ইতিহাস। বর্তমানে সংবাদ-স্বাধীনতা হল কিছুটা শাসকের চোখরাঙানি ও কিছুটা বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভরশীল। কেন্দ্রের বিচারে সংবাদ-স্বাধীনতা হল সরকারের প্রচারের গল্পগাথা। রাজ্যের বেলায় আবার একটু অন্য রকম। সেখানে বাইরে স্বাধীনতার মেকি বহর। এরই প্রতিচ্ছবি প্রতি বছর ধরা পড়ছে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার’-এ। তাই সমানে চলছে সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনা। পর পর সেই তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন প্রকৃত সংবাদদাতারা, যাঁরা বিক্রি হন না, সাহসিকতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশনের মূলমন্ত্রে যাঁরা বিশ্বাসী। সর্বশেষ সেই প্রমাণ রাখলেন বুদ্ধিনাথ ঝা। এর আগে গৌরী লঙ্কেশ, সন্দীপ শর্মা, নবীন-বিজয়, সুদীপ দত্ত ভৌমিক, জে দে প্রমুখ। এঁদের আমরা ভুলে যাইনি।
দেবাশীষ দত্ত, কলকাতা-৬৩
নাগরিকের দায়িত্ব
“কাকে বলে ‘নেগেটিভ’ খবর” শীর্ষক প্রবন্ধে বর্তমানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কী ভাবে হরণ করা হচ্ছে, তা সুস্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক। একমাত্র গণতন্ত্রেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা স্বীকৃত। আবার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে মানেই সেই শাসনব্যবস্থা কিন্তু জনগণের শাসনব্যবস্থা। এখন প্রশ্ন হল সংবাদ ঠিক কী রকম হবে? সংবাদ হবে নিরপেক্ষ, নির্মোহ। তা শুধুমাত্র সংবাদ বা ঘটনাটি প্রকাশ করবে। সেটি ভাল না মন্দ, নৈতিক না অনৈতিক, তা মূল্যায়ন করা সাংবাদিকের কাজ নয়। শুধুমাত্র তথ্য প্রকাশ করাই তাঁর কাজ।
কিন্তু অনেক সময়ই সংবাদমাধ্যমের গলা চেপে ধরা হয়। স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিকই সরকারের চক্ষুশূল হন। জরুরি অবস্থায় (কংগ্রেস আমলে) সাংবাদিক নিগ্রহ একটা সাধারণ ঘটনাতে পরিণত হয়েছিল। কুলদীপ নায়ারের লেখা বই দ্য জাজমেন্ট-এ লিপিবদ্ধ রয়েছে কী ভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। স্বৈরতন্ত্র কখনও চায় না সংবাদমাধ্যম স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশ করুক। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হয় যে, বর্তমানে এক শ্রেণির সাংবাদিক সৃষ্টি হয়েছেন, যাঁরা পক্ষপাতদুষ্ট। এঁরা মিথ্যা সংবাদ, গুজবকে সংবাদ বলে চালানোর চেষ্টা করেন। সংবাদ হবে সত্য, কোনও চমক দেওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র প্রথাগত মাধ্যম নয়, বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে এক ধরনের বিকৃত রুচির সংবাদ বা সংবাদের নামে মনগড়া তথ্য পেশ করা হয়, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সংবাদমাধ্যমগুলি সমাজের আয়না। এটি তুলে ধরে সমাজের প্রকৃত অবস্থা, যা জনসাধারণকে সত্যিকারের খবর দিয়ে থাকে। তাই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের অর্থ গণতন্ত্রের ধ্বংসসাধন। নাগরিকেরই দায়িত্ব তা রক্ষা করার।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া
দুর্ভাগ্যজনক
গত ১৯ নভেম্বর ‘সংবাদের শক্তি’ শীর্ষক সম্পাদকীয়ের সঙ্গেই নজরে এল ‘পজ়িটিভ খবর ও সরকারি বিজ্ঞাপন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি। হয়তো এক সমাপতন। স্বাধীন বিচারব্যবস্থার মতো সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও না-পসন্দ ক্ষমতাসীন, ক্ষমতার অলিন্দে বিচরণকারী শক্তির এবং তা রাজনৈতিক রং-নির্বিশেষে। সাংবাদিকরা আজ বিশ্বের সর্বত্রই ‘সফট টার্গেট’, তা সে সন্ত্রাসবাদীদেরই হোক বা আধিপত্যবাদীদের। সাংবাদিকদের পরিকল্পিত হননের দীর্ঘ তালিকায় আপাতত সর্বশেষ নামটি বিহারের বুদ্ধিনাথ ঝা-র। তা সত্ত্বেও সাংবাদিকদের সত্যপ্রকাশের মহান দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হলে চলে না। সম্প্রতি সে কথাই যেন আরও এক বার মনে করিয়ে দিল রাশিয়া ও ফিলিপিন্সের দুই সাংবাদিকের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি। সাংবাদিকের একমাত্র পুঁজি মানুষের মনে তাঁদের নিরপেক্ষতার প্রতি বিশ্বাস। তাই সংবাদপত্রের বা সংবাদমাধ্যমের মূল আদর্শ হওয়া উচিত নিরপেক্ষতা ও সত্য প্রকাশের দায়বদ্ধতা।
কিন্তু বাস্তবে এ দেশের সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটছে অনেক ক্ষেত্রে। অপছন্দ বলেই জোর করে সাদাকে কালো ও কালোকে সাদা বলার প্রবণতা সচেতন পাঠকের নজর এড়ায় না। সংবাদমাধ্যম তার বৈধতা ও বিশ্বাসের স্থান হারালে সবচেয়ে বেশি লাভ হয় ক্ষমতাসীনদেরই। কারণ, সব ক্ষমতাই দর্পণে নিজের আসল মুখটি দেখতে অনিচ্ছুক। আসলে ক্ষমতা যে রূপে যে আধারেই থাক না কেন, এর স্বাভাবিক প্রবণতাই হল প্রতিস্পর্ধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করা। এ-ও লক্ষণীয় যে, ক্ষমতায় না-থাকাকালীন যে রাজনৈতিক শক্তি বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতায় কোনও রকম হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে গলা ফাটায়, ক্ষমতাসীন হতে পারলে তাদের রূপ পাল্টাতে সময় বেশি লাগে না।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন হয় সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নহীন সমর্থন, নিজেদের আধিপত্য মসৃণ রাখতে। তাই ক্ষমতায় আরোহণ করেই নিরলস চেষ্টা চলে এক অনুগত সংবাদপত্র বা সাংবাদিক গোষ্ঠী গড়ে তোলার। আনুকূল্য বিতরণের মাধ্যমে— সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে সরকারি বিজ্ঞাপনের গাজর ঝুলিয়ে দেওয়া এমনই এক পন্থা। প্রলোভনে রাজি না হলে রক্তচক্ষু প্রদর্শন, হেনস্থা তো আছেই। এর পরে সরকারি বিজ্ঞাপনের বিনিময়ে জেলার ছোট ছোট সংবাদপত্রে ‘পজ়িটিভ’ খবর প্রকাশের জন্য সরকারের শীর্ষ মহলের ‘অফার’ নিশ্চয়ই সাংবাদিক মহলের পেশাগত ভূমিকা পালন আরও কঠিন করে তুলবে।
আসলে যাঁরা সত্য প্রকাশের দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের কোনও রকম বিচ্যুতি ঘটলে মূল লড়াইটাই বিপথগামী হতে পারে। প্রসঙ্গত, বিখ্যাত আমেরিকান বেতার-টেলিভিশন সাংবাদিক ওয়াল্টার ক্রনকাইট একদা বলেছিলেন, “সাংবাদিকতার প্রাথমিক শর্তই হল নিরপেক্ষতা। আমাদের প্রত্যেকের পছন্দ, অপছন্দ রয়েছে। কিন্তু সাংবাদিক হিসাবে আমাদের প্রধান কর্তব্য হল, কোনও পূর্ববর্তী ধারণার প্রভাব যেন সংবাদ পরিবেশনে না পড়ে।”
কিন্তু বর্তমানে নিরপেক্ষ আলোচনা-সমালোচনা, একদেশদর্শিতা মুক্ত সাংবাদিকতা যেন ক্রমহ্রাসমান। এতে সুবিধা হয় অসহিষ্ণু ক্ষমতার। ‘সংবাদের শক্তি’ সম্পাদকীয়তে উদ্ধৃত ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় মহাত্মা গাঁধীর বক্তব্য “সংবাদের স্বাধীনতার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার পরিচয় তখনই মিলিবে, যখন সংবাদমাধ্যম কোনও বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় মন্তব্য করিতে পারে, এমনকি তাহার ভ্রান্ত প্রতিফলনও করিতে পারে।” নিছক উদ্ধৃতির জন্য ‘ইতিহাসের পাতায় বন্দি’ না থেকে গাঁধীর এই বক্তব্যের যথার্থ অনুসরণ সম্ভব হলে তখনই ভিন্ন মতামত সংবাদপত্রে সমগুরুত্বে স্থান পায়। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা আদর্শ গণতন্ত্রের অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু আধিপত্যকামী রাষ্ট্রশক্তির বিভিন্ন প্রলোভন ও চাপের মুখে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের পক্ষপাতহীন নির্ভীক অবস্থানের বিস্মৃতি ও বিচ্যুতি দুর্ভাগ্যজনক।
শান্তনু রায়, কলকাতা-৪৭