Human Identity

সম্পাদক সমীপেষু: শ্রেষ্ঠ সে পরিচয়

তাই পারস্পরিক সৌহার্দ বজায় রাখতে এক দিকে যেমন প্রয়োজন প্রতীকের ঠিক ব্যবহার, অন্য দিকে মানুষের বহুধা পরিচয় থেকে সেই পরিচয়গুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত যে পরিচয়ের মাধ্যমে ধর্মীয়, ভাষাগত বা গোষ্ঠীগত বিভেদ কখনও প্রকট হয়ে ওঠে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:৩৮

অনুরাধা রায় ‘চেতনা বনাম চৈতন্য’ প্রবন্ধে (১১-১২) যথার্থই উল্লেখ করেছেন,“ প্রতিটি মানুষ একাধিক ‘আমরা’র সদস্য। এক-এক সময়ে এক-একটা আত্মপরিচয় অগ্রাধিকার পায় মাথার মধ্যে। কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে এক শত্রু আর এক শত্রুর পরিবর্ত হয়ে উঠতে পারে।” তাঁর এই বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পাই আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স: দি ইলিউশন অব ডেস্টিনি গ্রন্থে বর্ণিত অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণে।

Advertisement

তখন তিনি ১১ বছরের এক বালক। ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ছুরিকাহত হয়ে রক্তস্নাত অবস্থায় তাঁদের বাড়ির সদর দরজার কাছে এসে একটু জল ও সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করলে তাঁর পিতৃদেব তাঁকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ছুটে গেলেন। কিন্তু, ভদ্রলোককে বাঁচানো গেল না। তবে মৃত্যুর আগে তিনি এটুকু জানাতে পেরেছিলেন যে তাঁর নাম কাদের মিয়া এবং তিনি এক দিনমজুর। তাঁর স্ত্রী তাঁকে অবিভক্ত বাংলার শত্রুপ্রবণ এলাকায় যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু, উপবাসে থাকা পরিবারের ক্ষুন্নিবৃত্তির স্বার্থে তাঁকে রাস্তায় বেরোতে হয়েছিল। ঘটনাটা বৰ্ণনা করার পর অধ্যাপক সেন নিজেকেই প্রশ্ন করেছেন, জানুয়ারিতে যারা ব্যাপকার্থে ‘মানুষ’ ছিল, জুলাইতে কী ভাবে হঠাৎ করেই তারা নির্দয় ‘হিন্দু’ ও হিংস্র ‘মুসলমান’-এ পরিণত হয়ে গেল? সেই নিহতের তো আরও পরিচয় ছিল। তিনি তো বুভুক্ষু ‘হিন্দু’দের মতোই কাজের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন, তবে কেন তাঁর ‘মুসলমান’ পরিচয়টাই একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠল? তিনি লিখেছেন, হতভম্ব হয়ে যাওয়া একটা শিশুর পক্ষে (ধর্মীয়) পরিচয়জনিত কারণে এই হিংসাটা বুঝে ওঠা অত্যন্তই কঠিন ছিল। এমনকি, এখনও হতভম্ব হয়ে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক ও পরিণত মানুষটির পক্ষে তা বোঝা সহজ নয়।

তাই পারস্পরিক সৌহার্দ বজায় রাখতে এক দিকে যেমন প্রয়োজন প্রতীকের ঠিক ব্যবহার, অন্য দিকে মানুষের বহুধা পরিচয় থেকে সেই পরিচয়গুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত যে পরিচয়ের মাধ্যমে ধর্মীয়, ভাষাগত বা গোষ্ঠীগত বিভেদ কখনও প্রকট হয়ে ওঠে না।

গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪

মিলনের পথ

‘চেতনা বনাম চৈতন্য’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। এই একুশ শতকেও বিপন্ন মানবতাবাদ। আমদের জীবন এখন খুব সহজেই প্রতীকায়িত। তাই মানবজমিনের আধিপত্যবাদে ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে একে অপরের বিরুদ্ধে হিংস্র হয়ে উঠি। রামকৃষ্ণ কথিত গল্পে আছে একটি পুকুরের কথা। তার এক-এক ঘাটে জল খেতে নেমেছে এক-এক জন। কেউ বলছে জল, কেউ বলছে পানি, আবার কেউ বা বলছে ওয়াটার।

তার পর কত বছর অতিক্রান্ত হল, কিন্তু মানুষ আজও সেই ধ্বনির ভিন্নতারই প্রতিধ্বনি করে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোনো বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটি সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটিকেই সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি। যে দেশে ধর্মই সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি কি দেশকে বাঁচাতে পারে?”

আজ সমস্ত দিকে ধর্মীয় উত্তেজনা স্পষ্ট। মানুষ পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বিদ্বেষ-বিষ উগরে দিচ্ছে। বিভাজনের উন্মত্ততায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, অযৌক্তিক কথাবার্তার ফুলঝুরি ছুটেছে দুই দেশের উগ্র রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে।

‘সমাজতাত্ত্বিক ধূর্জটিপ্রসাদ’ প্রবন্ধে স্বপন কুমার ভট্টাচার্য ও গায়ত্রী ভট্টাচার্য লিখেছেন: “ধূর্জটিপ্রসাদের মূল বক্তব্য এই যে কোনও সমাজের প্রকৃতি বুঝতে গেলে, তাকে বদলাতে গেলে, অন্য আর একটি সমাজ (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ বা অধুনালুপ্ত সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজ)-এর মডেল অথবা মানব সমাজ সমূহ সম্পর্কে সামাণ্যীকরণের (যথা মার্ক্সীয় তত্ত্বে বা টলকট পারসনস্-এর জেনারেল থিওরি অভ অ্যাকশনে) প্রচেষ্টালব্ধ কোনও অবিশেষ নিয়মের অন্ধ অনুকরণ বা যান্ত্রিক অনুসরণের চেয়ে সেই বিশেষ সমাজের আপন ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্যের পর্যালোচনা অনেক বেশি কার্যকরী। শেষোক্ত উপায়েই সমাজ বদলের সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া সহজতর। সমাজের পরম্পরার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বা পরম্পরাগত মূল্যবোধে বাঞ্ছিত পরিবর্তন সাধিত হলেই সামাজিক পরিবর্তনের প্রচেষ্টা বুদবুদের মত ক্ষণস্থায়ী না হয়ে সমাজের আপামর মানুষের কাছে গ্রহণীয় ও আচরণীয় হয়।” ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভাবনাচিন্তা-সমন্বিত সামাজিক পরিবর্তনের পাঠ বর্তমান সময়ের আদর্শ নীতিবোধ রহিত মূল্যবোধহীন সমাজের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। মেলবন্ধনের গভীরতম তাগিদেই মনুষ্যত্বের মুক্তি।

এই শান্তিসূচক মৈত্রী প্রসঙ্গে ‘ধর্মসমন্বয় চিন্তা’ প্রবন্ধে অম্লান দত্ত লিখেছেন, “সমস্ত মহৎ ধর্মের যেখানে মিল সেইটুকুই যদি রক্ষনীয় হয় ধর্মসমন্বয়ী বিচারে, তবে কতটা রক্ষা করা সম্ভব সে কথা আকবর অথবা রামমোহন কেউই হয়তো শেষ অবধি ভেবে দেখতে আগ্রহ বোধ করেননি। সেটাই স্বাভাবিকও বটে। শ্রীকৃষ্ণ যাই বলুন না কেন, যিশু খ্রীষ্ট কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে সমর্থন করতেন বলে মনে হয় না। যিশু যাই বলুন না কেন, গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বর বিশ্বাসকে ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ বলতে উৎসাহী হতেন না। ...চার্বাক ছিলেন নাস্তিক। গৌতম বুদ্ধকে নাস্তিক বলা যাবে না, ঈশ্বরবাদীও নন তিনি। নাস্তিক্য ও নিরীশ্বরবাদ এখানে সমার্থক নয়। ধর্মের সারবস্তু যদি খুঁজতে হয় সকল ধর্মের ঐক্যের সীমার ভিতর তবে ঈশ্বর বিশ্বাসকে আবশ্যিক বলে ধরা যাবে না।

“...রামমোহন পরিচিত ছিলেন কিন্তু চতুর ধর্মজীবীর প্রতারণা প্রবণতার সঙ্গে। তবু তিনি অনুভব করেছিলেন— অন্তর্নিহিত এক ‘বৃত্তি’র অস্তিত্ব, যেটা ‘ধর্মের সারবস্তু’র সঙ্গে যুক্ত, যার সঞ্চারে সম্ভব হয় পবিত্রতা বোধ, অবিকৃত রূপে যেটা ‘ভগবানের গ্রহণযোগ্য’। শুদ্ধ ধর্মের জন্য এই যথেষ্ট।

“এই সেই বৃত্তি যা মানুষের অন্তরকে বাসনার চাঞ্চল্য থেকে মৈত্রী ও শান্তির পথে নিয়ে যায়, মূল্যবোধের স্তরান্তরে চেতনাকে চালিত করে। একে মান্যতা দিয়ে অহংকে অতিক্রম করতে হয়।”

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

চৈতন্য হোক

‘চেতনা বনাম চৈতন্য’ শীর্ষক অনুরাধা রায়ের প্রবন্ধ অত্যন্ত সময়োচিত। সভ্য সমাজে সকল জাতি ও প্রজাতি এক সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করে। কিন্তু সংখ্যাগুরুরা যদি সংখ্যালঘুদের লঘু চোখে দেখেন, ধর্মের দোহাই পেড়ে মানবধর্মকে জলাঞ্জলি দিয়ে একটা জাতিকে তার স্বদেশ থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করেন এবং হিংসা ছড়ান, উপাসনালয় বাড়িঘর ব্যবসা-বাণিজ্য অফিস আদালতের উপর আক্রমণ হানেন, তা হলে সেই জাতিটিকে বুদ্ধিমান বলা যায় না। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক আগুন ও ধোঁয়া প্রমাণ করে দিল বাঙালি সত্যিই আত্মঘাতী। আমাদের দেশেও সংখ্যালঘু আছেন। তাঁরা খুবই সুরক্ষিত এবং নির্ভাবনায় থাকেন বলেই আমার মত। গৌরবের সঙ্গে ‘এ জন্মভূমি আমাদের’— বলতে পারেন!

বাংলাদেশিদের এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। কারণ, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা আজ যে সেই উচ্চারণের স্বাধীনতাটুকুও পাচ্ছেন না। সেটুকু মৌলিক অধিকারকেও সহিংস ভাবে কাড়তে চায় মৌলবাদী, সন্ত্রাসবাদী এবং প্রশাসন। এতে দেশটির ঐতিহাসিক ভাবে আরও একশো বছর পিছিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

এর থেকে মুক্তি পেতে চেতনা যেমন দরকার, তেমনই চৈতন্য স্থায়ী হওয়াও জরুরি। কিন্তু আত্মঘাতী বাঙালির কবে সেই হুঁশ হবে সেটাই ভাবছি, ভেবে আশঙ্কিত হচ্ছি!

বিবেকানন্দ চৌধুরী, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান

Advertisement
আরও পড়ুন