আপাতত পশ্চাদপসরণ
Narendra Modi

গণতন্ত্রের মান রাখতে আইন বাতিল, এমন ভাবলে ভুল হবে

কৃষি আইন ভুল ছিল কি না, তার চেয়ে অনেক বড় সত্য হল, যে ভঙ্গিতে তাঁরা এই আইনগুলি চালু করেছিলেন, তা ভুল ছিল।

Advertisement
অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২১ ০৬:০৭
কৌশলী? গুরু নানক জয়ন্তীর দিন দূরদর্শনের বক্তৃতায় কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করছেন প্রধানমন্ত্রী।

কৌশলী? গুরু নানক জয়ন্তীর দিন দূরদর্শনের বক্তৃতায় কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করছেন প্রধানমন্ত্রী। পিটিআই।

সর্বভারতীয় টেলিভিশনের পর্দায় ডিজ়াইনার শালের দ্যুতিতেও ঢাকা পড়ছে না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্বেগ, এমন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য বড় একটা হয় না ঠিকই— কিন্তু দোহাই, সেই মুহূর্তটির মাথায় গণতন্ত্রের কাছে নরেন্দ্র মোদীর পরাজয় স্বীকারের অনর্জিত শিরোপা পরিয়ে দেবেন না। পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের কথা ভেবে প্রধানমন্ত্রী এক পা পিছিয়ে এসেছেন। ভোটের কথা ভেবে পিছু হটাকেই ‘গণতন্ত্রের জয়’ বলে দাবি করতে চাইলে অন্য কথা— কিন্তু, গণতন্ত্র বললে যদি আলোচনার মাধ্যমে শাসন বোঝায়, যদি বিরোধীদের কথা শোনার সু-অভ্যাস বোঝায়, যদি মানুষকে ‘প্রজা’ না ভেবে শাসনের অংশীদার নাগরিক ভাবার মানসিকতা বোঝায়, তা অন্য সাধনার ফল। সেই সাধনায় প্রধানমন্ত্রীর রুচি ছিল না। কৃষক আন্দোলন তাঁর রুচিকে আমূল পাল্টে দিয়েছে, এতখানি দাবি করা মুশকিল।

তিনি যে পাল্টাননি, সে দিনের টেলিভিশন-ভাষণেই তার সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছিলেন মোদী। বলেছিলেন, প্রদীপের আলোর মতো সত্যও দেশের কৃষকদের এক অংশকে তিনি বোঝাতে পারেননি। অর্থাৎ, ভুল তাঁর নয়— তিনি কৃষকদের মঙ্গলই করতে চেয়েছিলেন— কিন্তু, কৃষকদেরই একটা অংশের নির্বুদ্ধিতায়, অথবা ইচ্ছাকৃত শয়তানিতে, তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না সেই মঙ্গলসাধন। তারা কারা, সে দিন আর তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেননি প্রধানমন্ত্রী। তবে, বুঝে নিতে অসুবিধা নেই, তাঁর ইঙ্গিত সেই ‘আন্দোলনজীবী’দের দিকেই, অজিত ডোভাল সরাসরি যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছেন। নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধে ডোভালরা রথী-মহারথী হতে পারেন, কিন্তু সেনাপতি স্বয়ং মোদী। তিনি সেই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাচ্ছেন না। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তাঁর শেষ হয়নি।

Advertisement

তাঁর এই ‘স্ট্র্যাটেজিক রিট্রিট’-এর চরিত্রটা ঠিক কেমন? ঘটনা হল, এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের পালে হাওয়া ক্রমশ কমছিল— স্পষ্ট হচ্ছিল যে, পঞ্জাব-হরিয়ানা-পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বাইরে এই আগুন ছড়াবে না। অতএব, দেশ জুড়ে আন্দোলনের তীব্রতা আরও বাড়বে, কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও নাজেহাল হতে হবে, ২০২১ সালের নভেম্বরে অন্তত তেমন আশঙ্কা ছিল না। অন্য দিকে, জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের পর আইন তিনটি এমনিতেও হিমঘরে চলে গিয়েছিল— সেগুলোকে বাঁচিয়ে তোলার কোনও উদ্যোগ গত দশ মাসে দেখা যায়নি। নরেন্দ্র মোদীরা জানতেন, কেন্দ্রীয় আইন যদি ফিরিয়ে নিতেও হয়, তবুও কর্পোরেট সংস্থাগুলোর স্বার্থরক্ষা করতে সমস্যা হবে না— দেশের কুড়িটি রাজ্যে ইতিমধ্যেই চুক্তিচাষ আইনসিদ্ধ; ২৩টি রাজ্যে কৃষকদের থেকে সরাসরি ফসল কেনার ছাড়পত্র রয়েছে; ২২টি রাজ্যে রয়েছে বেসরকারি মান্ডি; ২১টি রাজ্যে কৃষিপণ্যে ই-ট্রেডিং হয়। কর্পোরেট স্বার্থ তাঁর কাছে যা চায়, ইতিমধ্যেই তার ব্যবস্থা করা রয়েছে। আইন প্রত্যাহার করায় আসলে খুব কিছু পাল্টাল না।

মরে যাওয়া, এবং বহুলাংশে অবান্তর, কৃষি আইনকে তিনি এত দিন জিইয়ে রেখেছিলেন কেন, এই মুহূর্তে সেটাই বরং গুরুতর প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর বিলক্ষণ রয়েছে নির্বাচনী রাজনীতিতে। তিনি জানতেন, উত্তরপ্রদেশ আর পঞ্জাবের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো এই একটা প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই প্রচারে যাবে, সর্বশক্তিতে লড়বে। এবং, তিনি এটাও জানতেন, নির্বাচনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এই আইন প্রত্যাহার করে নিলে বিরোধীদের সবেধন অস্ত্রটি ভোঁতা হয়ে যাবে। রাহুল গাঁধী থেকে অখিলেশ যাদব, কারও দাবি করার উপায় নেই যে, তাঁদের চাপেই প্রধানমন্ত্রী পিছু হটলেন— আন্দোলনকারী কৃষকরা বিরোধী নেতাদের কখনও ততখানি জায়গা ছাড়েননি। কাজেই, এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, বিধানসভা নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়লে বলি দেবেন বলেই তিনি এত দিন আইন তিনটে জিইয়ে রেখেছিলেন। সাতশতাধিক মৃত্যুর মূল্যে; এক বছর ধরে প্রবল শীত, প্রবলতর গ্রীষ্মে খোলা আকাশের নীচে এত মানুষ আন্দোলন করছেন দেখেও; রাজধানীর প্রান্তে দেশের নাগরিকদের আটকাতে অলঙ্ঘ্য সীমান্ত রচনা করেও। গণ-আন্দোলনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আইন প্রত্যাহার করতে হলে এত দিন অপেক্ষা করার কোনও কারণ ছিল না।

এই কথাটা মেনে নিলেও অবশ্য অন্তত দুটো প্রশ্ন থেকে যায়। এক, এত দিন আন্দোলন চলার পর, এত প্রাণহানির পর আইন প্রত্যাহার করে কি হারানো ভোট পুনরুদ্ধার করা সম্ভব? এবং দুই, কোনও অস্ত্রেই তাঁকে পরাজিত করা যায় না, এমন একটা সযত্নলালিত অতিমানবিক ভাবমূর্তির গায়ে যে ধাক্কা এই পশ্চাদপসরণে লাগল, সেই ক্ষতির হিসাব কি তিনি করেননি? দুটো প্রশ্নের উত্তরই আসলে সহজ। আইনগুলো যে প্রত্যাহার করতে হবে, এবং তাতে যে কর্পোরেট স্বার্থের ক্ষতি হবে না, এই কথাটা সম্ভবত বেশ কিছু দিন আগেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফলে প্রশ্ন ছিল, কখন এই আইন প্রত্যাহার করলে বিজেপির রাজনৈতিক লাভ সবচেয়ে বেশি? অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই সময়টা এখনই। শুধু যে বিরোধীদের অস্ত্র ভোঁতা করে দেওয়া গেল, তা-ই নয়, কেন্দ্রীয় সরকার এখন যতখানি শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে, গত দেড় বছরে তা কখনও ছিল না। অর্থনীতির হাল খানিক হলেও শুধরোচ্ছে, কোভিড অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে, টিকাকরণ চলছে। এক পা পিছিয়ে আসার রাজনৈতিক ক্ষতি সামাল দেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভাল সময় পাওয়া মুশকিল ছিল। এবং, প্রধানমন্ত্রী জানেন, পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশে যত ভোট তাঁরা হারিয়েছেন, তার একটা অংশ ফিরিয়ে আনতে পারলেও লাভ।

‘অপরাজেয়’ ভাবমূর্তিতে ধাক্কা লাগার প্রশ্নটা অবশ্য পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশের গণ্ডিতে আটকে থাকার নয়। এই প্রশ্নের একটা ছোট উত্তর আছে, আর একটা বড় উত্তর। ছোট উত্তরটা হল, যাঁদের কাছে মোদীর মূল আকর্ষণ তাঁর ‘লৌহমানব’ ভাবমূর্তি, অন্তত এই মুহূর্তে তাঁদের কাছে মোদীর কোনও বিকল্প নেই। রাহুল গাঁধী বা অরবিন্দ কেজরীবাল তো ননই, এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নন। কৃষি আইনের প্রশ্নে মোদী পিছু হটায় তাঁরা দুঃখিত হতে পারেন, চটেও যেতে পারেন, কিন্তু এখনই তাঁদের পক্ষে বিকল্প লৌহমানব খুঁজে নেওয়া কঠিন। বড় উত্তরটা হল, মোদী জানেন যে লৌহমানবের ভাবমূর্তি তৈরি হয় গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা করতে পারার পৌনঃপুনিক অভ্যাসের জোরে— এবং, সেই অভ্যাস তিনি ত্যাগ করছেন না। ফলে, আজ যাঁরা দুঃখ পাচ্ছেন, ফের তাঁদের মন জিতে নেওয়ার সুযোগ অদূর ভবিষ্যতেই তিনি নিজের জন্য তৈরি করে নেবেন। ‘আন্দোলনজীবী’দের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে তিনি সরেননি।

তবে হ্যাঁ, অতঃপর শত্রুপক্ষ চয়নে তিনি আরও সতর্ক হবেন। কৃষি আইন প্রত্যাহারের মহালগনে অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ২০১৫ সালেও এক বার পিছু হটতে হয়েছিল তাঁদের— সে বার জমি অধিগ্রহণ আইনের প্রশ্নে। কৃষককে চটানোর পথে প্রধানমন্ত্রী আর হাঁটবেন বলে মনে হয় না। তার অন্তত দুটো কারণ আছে। এক, দেশের অন্তত অর্ধেক ভোটার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত; এবং দুই, এই দফার অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, কৃষক আন্দোলনকারীদের ‘বৈধতা’-কে প্রশ্নের মুখে ফেলা সহজ কাজ নয়। গত সাত বছরে বিজেপির রাজনীতি মূলত যে খাতে বয়েছে, অর্থাৎ তাদের বিরোধিতা করলেই বিরোধীকে দেগে দেওয়া হয়েছে ‘দেশদ্রোহী’ বলে, কৃষকদের ক্ষেত্রে সেটা করা কঠিন।

কিন্তু, মানুষের চোখে যাঁদের সহজেই ‘অ-বৈধ’ প্রতিপন্ন করা যায়, তাঁদের ক্ষেত্রে কৌশল বদলানোর কোনও কারণ প্রধানমন্ত্রীর নেই। আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে নাগরিকত্ব আইনকে তাঁরা ধামাচাপা দিতে পারেন, কিন্তু সংখ্যালঘুর প্রতি গণতান্ত্রিক হবেন, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কৃষি আইনের চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতিকারক শ্রম বিধি প্রত্যাহার করবেন, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণতর। সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহঙ্কার ছেড়ে সংসদকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেবেন, বিরোধী মতকে গুরুত্ব দেবেন, এমনটা সম্ভবত ঘোর আশাবাদীরাও ভাবছেন না।

কৃষি আইন ভুল ছিল কি না, তার চেয়ে অনেক বড় সত্য হল, যে ভঙ্গিতে তাঁরা এই আইনগুলি চালু করেছিলেন, তা ভুল ছিল। কারণ, তা অগণতান্ত্রিক ছিল। এই কথাটি স্বীকার করা নরেন্দ্র মোদীদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ এই অগণতান্ত্রিকতাই তাঁদের রাজনীতি, তাঁদের শাসনভঙ্গি। ধাক্কা খেয়ে তিনি এক পা পিছোতে পারেন, কিন্তু স্বধর্মচ্যুত হয়ে গণতান্ত্রিকতায় উত্তীর্ণ হবেন না।

হলে, ২০০২ সালেই হতেন।

আরও পড়ুন
Advertisement