‘লড়াই’ নিজের সঙ্গেও
TMC

এ বারের পুরভোট তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে কেন বড় চ্যালেঞ্জ

একটি লড়াই আছে। যা বস্তুত তৃণমূলের একার। তৃণমূলকে সেটা লড়তে হবে নিজের সঙ্গে। প্রয়োজনে নিতে হবে কঠোর সিদ্ধান্ত।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২১ ০৫:১১
জয়ী: শান্তিপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর জয়ের পর সমর্থকদের উচ্ছ্বাস।

জয়ী: শান্তিপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর জয়ের পর সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। পিটিআই

পুরভোটের ঢাকে কাঠি পড়েছে। শতাধিক পুরসভায় ভোট হলে তা কার্যত মিনি বিধানসভা নির্বাচনের আকার পায়। আর কলকাতার গুরুত্ব তো বলা বাহুল্য। অতএব রাজ্য-রাজনীতি পুরভোট নিয়ে সরগরম হয়ে উঠছে। শুরু হয়ে গিয়েছে আলোচনা, গুঞ্জন।

পুর-নির্বাচনগুলি দীর্ঘ দিন বকেয়া ছিল। এক-একটি পুরসভায় তা এক-এক রকম। হাওড়া, বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, ঝাড়গ্রামের মতো কয়েকটির মেয়াদ ফুরিয়েছে ২০১৮-তে। পরের বছর আরও কিছু। কলকাতা, বিধাননগর ইত্যাদিতে ভোটের সঠিক সময়কাল ছিল ২০২০।

Advertisement

বিবিধ কারণে কোথাও যথাসময়ে ভোট হয়নি। সর্বশেষ পর পর দু’টি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াল করোনা এবং বিধানসভা নির্বাচন। সরকার জানিয়ে রেখেছিল, বড় ভোট মিটলে ছোট ভোট করাতে বিলম্ব হবে না। এ বার সেই সময় এসেছে।

তৃণমূলের দিক থেকে সময়টি ‘প্রশস্ত’ ভাবার যুক্তি যথেষ্ট। বিধানসভা নির্বাচনে তাদের বিপুল জয়, বিজেপির কোণঠাসা অবস্থা, সিপিএম এবং কংগ্রেসের কার্যত মুছে যাওয়া, এ সবই তৃণমূলের স্বস্তি বাড়ানোর পক্ষে কাজ করছে। পর পর উপনির্বাচনে বিজেপির ছন্নছাড়া হাল আরও স্পষ্ট। ফলে এখন পুরভোট হলে তৃণমূলের খুব চাপ হবে না, এটাই অধিকাংশের ধারণা।

তবে তার আগে আরও একটি লড়াই আছে। যা বস্তুত তৃণমূলের একার। তৃণমূলকে সেটা লড়তে হবে নিজের সঙ্গে। প্রয়োজনে নিতে হবে কঠোর সিদ্ধান্ত। সেখানে তারা কতটা শক্ত, নির্মোহ ও বাস্তববাদী হতে পারে, তার উপর দলের ভাবমূর্তি এবং ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করতে পারে।

একতলার গাঁথনি মজবুত করা না-হলে দোতলা, তিনতলায় ওঠা কঠিন হয়। পুরসভা, পঞ্চায়েত ও নিচুতলায় দলীয় সংগঠন হল সেই একতলা। তাদের উপর বহুলাংশে ভর করে থাকে বিধানসভা এবং লোকসভার জনসমর্থন। একতলা নড়বড়ে হলে উপরটাও নড়ে যেতে পারে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি ১৮টি আসন পেয়ে যাওয়ার পরে তৃণমূল সেটা সম্যক টের পেয়েছিল।

বিজেপি বড় জোর দশ-বারোটা আসন পেতে পারে, এটাই ওই ভোটের আগে ছিল বেশির ভাগের অনুমান। প্রকৃত ফল তাকে ছাপিয়ে যায়। ঠিক যেমন, ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোর যতই ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকুন, সাধারণ ভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, বিধানসভায় তৃণমূল জিতলে সর্বোচ্চ ১৬৫/১৭০ পেতে পারে। সেটা বাস্তবে ২১৩-তে পৌঁছয়।

এ সবই পুরনো কাসুন্দি। তবু ফের একটু ঘাঁটার প্রয়োজন। কেন, এ বার তা বলি।

লোকসভা নির্বাচনের ফল পর্যালোচনা করতে গিয়ে তৃণমূল হাড়ে হাড়ে মালুম করতে পারে যে, দলের নীচের তলায় হালটি কেমন। নেতৃত্ব তখন বুঝেছিলেন, রাজ্যে ওই ‘বিজেপি-প্রীতি’র পিছনে শাসক দলের তৃণমূল স্তরে, অর্থাৎ পুরসভা, পঞ্চায়েত এবং সাংগঠনিক কমিটির মতো জায়গায় গজিয়ে ওঠা ‘হিটলার’-দের বড় অবদান আছে। সঙ্গে আছে বহুবিধ দুর্নীতির অভিযোগও। সবই যে অসার, তা বলা যাবে না। মানুষের পুঞ্জীভূত বিরাগ ভোটে অনেকটা প্রতিফলিত। যে হেতু সিপিএম, কংগ্রেসকে প্রান্তিক করে দিয়ে বিজেপি প্রধান বিরোধী দল, তাই তার থেকে লাভবান হয়েছে তারাই।

তৃণমূলের সামনে তখন দু’টি পথ ছিল। এক, বৃহত্তর রাজনীতির দিকে নজর ঘুরিয়ে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিচ্যুতি ও ঘাটতিকে প্রকাশ্যে গুরুত্ব না দেওয়া। দুই, মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এবং কিছু ‘করে’ দেখানো।

সবাই জানি, কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয় পথটি নিয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিধানসভা ভোটের আগে ওই গহ্বরগুলি মেরামত করা না হলে সমস্যা গভীরতর হবে। মমতার ‘নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত’ করার কাজটি এক দিকে ছিল প্রশাসনিক, এবং অন্য দিকে সাংগঠনিক। তাঁর লক্ষ্য ছিল মানুষের ‘বিশ্বাস’ ফেরানো।

ক্ষোভের বাষ্প বার করার জন্য ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গিয়েছিল অভিযোগের স্রোত। গুচ্ছ গুচ্ছ নালিশ জমা পড়তে লাগল অনেক কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত প্রতিনিধি ও এলাকাভিত্তিক নেতার বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলের সংশ্লিষ্ট নেতা-জনপ্রতিনিধিদের ঘুষ, তোলাবাজির টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পরে কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা-ও সবার মনে আছে।

শেষ পর্যন্ত কে কত টাকা ফেরত দিয়েছেন, দিতে চেয়েছেন বা আদৌ দেননি, সে সব মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠ হল ‘সুযোগ’ পাওয়ামাত্র মানুষের ক্ষোভের প্রকাশ্য উদ্গিরণ। সেটাই আসল কাহিনি।

ঠিক ভাবে বললে, এর পর থেকে একটু একটু করে প্রশাসনকে সরাসরি উপভোক্তার কাছে নিয়ে আসার ভাবনা দানা বাঁধে। আজকের ‘দুয়ারে সরকার’ থেকে ‘দুয়ারে রেশন’, সব তারই সংগঠিত ও সম্প্রসারিত অবয়ব। যার বড় লক্ষ্য, সরকার এবং উপভোক্তার মাঝখানে শাসক দলের ‘দাদা’-দের ভূমিকা না রাখা। যাতে অভিযোগের পরিসর কমে আসে। শহর, গ্রাম সর্বত্রই এটা প্রযোজ্য।

আসন্ন পুর নির্বাচনগুলির ক্ষেত্রে এই প্রেক্ষাপট স্মরণে রাখা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তার কারণ বিবিধ। প্রথমত, ভোটে জিতে এখন যাঁরা পদে বসবেন, তাঁদের ২০২৪-এর লোকসভা এবং ২০২৬-এর বিধানসভা, দু’টি ভোটই পার করতে হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। অর্থাৎ, যে কথা আগেই বলেছি, তাঁরা হবেন একতলার গাঁথনি। তাই এর সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে মনোনয়নের বিষয়।

এটিই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খাস কলকাতা পুরসভাই হোক বা জেলাগুলির মিউনিসিপ্যালিটি— সব জায়গাতেই এমন অনেক পুর-প্রতিনিধি (এখন কো-অর্ডিনেটর) আছেন, যাঁদের স্বচ্ছতা, যোগ্যতা কোনও কিছুই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। পাঁচ-দশ বছর কাউন্সিলর হয়ে ‘ক্ষমতা’ ভোগ করার সঙ্গেই তাঁরা আড়ে-বহরে স্ফীত হয়েছেন। নিজের পরিবার ও ঘনিষ্ঠদের ফুলে-ফেঁপে উঠতে সাহায্য করেছেন।

এঁদের কারও ছেলে, কারও ভাই, ভাইপো, কারও স্বামী বা দেওর এলাকায় জমি-মাফিয়া, ‘ডন’ ইত্যাদি অভিধায় পরিচিত। তাঁদের চোখের ইশারায় বাড়ির মালিককে নিমেষে পথে নেমে যেতে হয়। প্রোমোটারের হাসি চওড়া হয়। বিনা রোজগারে গাড়ি-বাড়ি হাঁকানো এঁদের কাছে জলভাত। তাঁদের এলাকাগুলিতে লোকেরা এ সব জানেন।

তৃণমূলের লোকসভা ফলের ময়নাতদন্তে এঁদের অনেকের মুখোশ খুলেও গিয়েছিল। অনেকে আবার অভিযোগের উৎসমুখ চেপে রাখতে পেরেছিলেন। যদিও সেই সময় ভর্ৎসনা ছাড়া বড় কোনও সাজা কারও হয়েছে বলে জানা নেই।

এখন প্রশ্ন, এ বার প্রার্থী করার ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতৃত্ব কাদের রাখবে, কাদের ফেলবে? ওঁদের একাংশ অবশ্য ইতিমধ্যেই নানা স্তরে ‘খুঁটি’ ধরার কাজে নেমে পড়েছেন। যদি ‘জোর যার মুলুক তার’ হয়, তা হলে ‘মজবুত’ খুঁটি ধরে টিকিট মিলবে না, সে কথাই বা হলফ করে বলবে কে?

তবে এটা বলা যায় যে, কারও পকেটে কোনও দলের টিকিট থাকলেই তাঁর সম্পর্কে মানুষের মধ্যে পারসেপশন অর্থাৎ গড়ে ওঠা ধারণা রাতারাতি বদলে যেতে পারে না। কারণ, তা তৈরি হয় নিত্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। পুরসভার গণ্ডি ছোট। তাই সাধারণ ভাবে জনমত এই ধরনের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। আর সেই দাম চোকাতে হয় দলকেই।

এই জন্যই প্রার্থী বাছাই আসন্ন পুর-ভোটে তৃণমূলের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। যত দূর জানা যাচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, উভয়েই চান দক্ষ ও কর্মঠদের অধিক সংখ্যায় পুর-প্রশাসনে এগিয়ে আনতে।

কিন্তু সেই কাজ করতে গেলে সর্ব স্তরে আগাছা সাফ করার মানসিক দৃঢ়তাই হওয়া উচিত প্রথম শর্ত। কোথাও কোনও ভাবে স্বার্থের গণিত গুরুত্ব পেলে কাজটি শক্ত হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন
Advertisement