বিজয়ী: কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণার পর নয়া দিল্লির টিকরি সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষকদের উচ্ছ্বাস। ১৯ নভেম্বর। পিটিআই।
অবশেষে, টানা এক বছর নিরবচ্ছিন্ন কৃষক অন্দোলনের চাপে এবং পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশের আসন্ন নির্বাচনের তাগিদে, বিতর্কিত কৃষি আইন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পিছিয়ে আসতে হল। এটা এক দিকে যেমন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক স্খলন, তেমনই অন্য দিকে বিরোধীদের রাজনৈতিক সাফল্য; সবার উপরে গণতন্ত্র নামক প্রতিষ্ঠানটির বিজয়-সঙ্কেত। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক নয়, এই ঘোষণার একাধিক অর্থনৈতিক তাৎপর্য আছে। মূল প্রশ্ন, কৃষি আইন প্রত্যাহারের ফলে কৃষক এবং সাধারণ দেশবাসীর আর্থিক লাভ হল, না কি ক্ষতি?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে বিতর্কিত আইন তিনটি ঠিক কী ছিল, এক বার স্মরণ করে নেওয়া যাক। প্রথম আইন বলছে, শুধু নির্দিষ্ট কিছু মান্ডি নয়, তাদের বাইরেও অবাধে কৃষিপণ্যের বেচা-কেনা চলতে পারে। দ্বিতীয় আইন বলছে, কৃষক যে কোনও সংস্থা বা ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে চাষ করতে পারবেন। তৃতীয় আইন কৃষিপণ্য মজুত করার উপরে নিষেধাজ্ঞা প্রায় তুলে দিচ্ছে— বলছে, যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষের মতো অস্বাভাবিক অবস্থা বাদ দিয়ে অন্য সময় যে কেউ যে কোনও পরিমাণ কৃষিপণ্য মজুত করতে পারবেন। আইনগুলি বলবৎ হলে যে দৈত্যাকার দেশি ও বিদেশি কর্পোরেটগুলির ভারতীয় কৃষির বাজারে প্রবেশ করা সহজ হয়ে যাবে, এ নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। বস্তুত, এটাও সব পক্ষই মেনে নিচ্ছে যে, কর্পোরেটদের ভারতীয় কৃষির বাজারে আকর্ষণ করাটাই এই আইন প্রণয়নের আসল উদ্দেশ্য। তা হলে প্রশ্নটা দাঁড়াচ্ছে, কৃষির বাজারে কর্পোরেটদের প্রবেশ ঘটানোটা কি কৃষক এবং সাধারণ দেশবাসীর পক্ষে মঙ্গলজনক?
যাঁরা কর্পোরেট পুঁজিকে, বিশেষত বিদেশি কর্পোরেটদের বিষবৎ পরিত্যাজ্য মনে করেন, এই প্রতিবেদক তাঁদের দলে নেই। আধুনিক যুগের অর্থনীতিতে কর্পোরেট এবং বহুজাতিক সংস্থার ভূমিকা অনস্বীকার্য; খোলা বাজারের ভূমিকাও। কিন্তু, যাঁরা মনে করেন যে, বাজার খুলে দিয়ে কর্পোরেট পুঁজির প্রবেশ ঘটাতে পারলেই যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তাঁদের চিন্তা অতিসরলীকরণের দোষে দুষ্ট। বস্তুত, উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনীতির কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে দৃঢ় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে, ইতিহাস আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশের কৃষিও তেমনই একটা ক্ষেত্র। এখানে এই মুহূর্তে কর্পোরেট সংস্থাগুলি বাধাহীন ভাবে ঢুকতে শুরু করলে লাভের থেকে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।
প্রথমে লাভের দিকটা দেখা যাক। আইন প্রণয়নের সময় কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিল যে, নতুন আইন বলবৎ হলে, কর্পোরেট সংস্থাগুলি দেশের কৃষি বাজারে ঢুকে গ্রামাঞ্চল থেকে কৃষিপণ্য কিনে দেশের শহরাঞ্চলে, বা বিদেশে বিক্রি করবে। এর ফলে যে হেতু গ্রামের বাজারে ক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে, তাই পণ্যের দামও বাড়বে। বিশেষ করে ছোট কৃষকরা লাভবান হবেন। আবার শহরে যখন কর্পোরেটরা পণ্য বিক্রি করবে, তখন সেখানে বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে, ফলে লাভ হবে শহরের ক্রেতাদের। এ ছাড়া, ধরে নেওয়া হয়েছিল, মাল মজুত রাখার জন্য সংস্থাগুলি তৈরি করবে বড় বড় গুদামঘর। এর ফলে পণ্য নষ্ট হবে অনেক কম। অপচয় কমলে দামও কমবে।
কিন্তু, কৃষকরা যদি লাভবানই হবেন, তা হলে তাঁরা অন্দোলন করবেন কেন? নতুন আইনের ফলে কেউ কেউ নিশ্চয় ক্ষতির আশঙ্কাও করছিলেন। প্রথমত, কর্পোরেট সংস্থা এই বাজারে ঢুকলে বড় কৃষকরা— যাঁরা একই সঙ্গে বড় আড়তদার এবং শহরে পণ্যের মূল জোগানদার— ক্ষতিগ্রস্ত হতেন, কারণ মাল কেনার সময় এবং মাল বিক্রি করার সময় অধিকতর প্রতিযোগিতা তাঁদের একচেটিয়া আধিপত্যকে খর্ব করত। এতে অবশ্য আপত্তির কিছু নেই। বড় কৃষকদের একচেটিয়া ব্যবসা ব্যাহত হওয়াটা ‘অনভিপ্রেত’ বলা যাবে না। দুর্ভাগ্যবশত, কর্পোরেট প্রবেশের প্রতিকূল প্রভাব শুধুমাত্র বড় কৃষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। যাঁদের নিজস্ব জমি নেই— ভূমিহীন চাষি, কৃষি-শ্রমিক, গ্রামের ছোটখাটো দোকানদার, ব্যবসায়ী বা কারিগর— তাঁদের তো বাজার থেকে চাল-গম কিনেই খেতে হয়। গ্রামের বাজারে কৃষিপণ্যের দাম বাড়লে তাঁদের অবশ্যই ক্ষতি। মনে রাখতে হবে, গ্রামের মানুষদের মধ্যে এঁরাই দরিদ্রতম, আর্থিক ভাবে দুর্বলতম, এবং সংখ্যায় সর্বাধিক। কর্পোরেট গ্রামের বাজারে ঢুকে চাল-গম কিনতে আরম্ভ করলে এঁদের বেঁচে থাকাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
এই দরিদ্র, আর্থিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণির বড় অবলম্বন গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাপ্ত রেশনের চাল-গম। কর্পোরেট সংস্থা বাজার থেকে বেশি পরিমাণে কৃষিপণ্য কিনে নিলে সরকারি বণ্টনের জন্য খুব একটা অবশিষ্ট থাকবে না, ফলে রেশন ব্যবস্থাটাই অসুবিধের মধ্যে পড়তে পারে। উল্টো দিকে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে, রেশনে যে মানের চাল-গম দেওয়া হয়, আর কর্পোরেটরা বাজার থেকে যে মানের শস্য কিনতে উৎসাহী হবে, এই দুইয়ের মধ্যে অনেক তফাত। তাই কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে সরকারি বণ্টন ব্যবস্থার কোনও বিরোধ নেই। এর উত্তরে বলা যায় যে, কর্পোরেটরা বেশি দাম দিয়ে বাজার থেকে উন্নত মানের শস্য কিনতে শুরু করলে, তার দাম বাড়বে। তার ফলে সব গোত্রের চালেরই দাম বাড়বে; টান পড়বে সরকারি বণ্টনের জোগানে।
কৃষির বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপের সঙ্গে কৃষিপণ্যে ব্যবসা করতে আসা কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থের সংঘাতটা মৌলিক। বণ্টন ব্যবস্থা চালানোর জন্য সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি-তে কৃষকদের থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে। এমএসপি বাড়লে খোলা বাজারে জোগান কমে, ফলে যে দামে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে শস্য কিনতে হবে, তা-ও বাড়ে। এতে, বলা বাহুল্য, কর্পোরেট সংস্থাগুলির অসুবিধে। বস্তত, এমএসপি বেশি হলে কর্পোরেটরা বাজারেই ঢুকতে চাইবে না— তাদের প্রবেশ নিশ্চিত করতে হলে এমএসপি কম রাখা দরকার। কিন্তু এমএসপি কম রাখা হলে এক দিকে বড় কৃষক-ব্যবসায়ীদের ক্ষতি, কারণ মূলত তাঁরাই সরকারকে শস্য বিক্রি করেন; অন্য দিকে বণ্টন ব্যবস্থার সঙ্কট, কারণ এমএসপি কম হলে কম শস্য সরকারের ঘরে জমা পড়বে। কৃষকরা এমএসপি নিয়ে তাঁদের দুশ্চিন্তার কথা বার বার সরকারকে জানিয়েছেন।
কর্পোরেট সংস্থার কাছে সরাসরি ফসল বিক্রি করতে পারলে ছোট কৃষকদের খানিকটা লাভ হতে পারত। এই লাভের আশায় তাঁরা বড় কৃষক-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁদের সনাতন সম্পর্কটা ভেঙে দিয়ে কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে চুক্তিচাষের মাধ্যমে নতুন সম্পর্ক গড়তে পারেন, বড় কৃষকদের এই ভয় ছিলই। কিন্তু, বড় কৃষকরা ছোটদের কাছ থেকে মাল কেনার সময় দাম কিছুটা কম দেন বটে, কিন্তু বিপদে-আপদে তাঁদের সাহায্যও করেন। সনাতন সম্পর্কটা ভেঙে গেলে ছোটরা সেই নিরাপত্তা কোথায় পাবেন? তা ছাড়া, কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে চুক্তি করার জন্যে যে আইনের জ্ঞান দরকার, ছোট কৃষকদের তা নেই। এই অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে কর্পোরেটরা তাঁদের ঠকাবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? তা ছাড়া সনাতন সম্পর্ক ভেঙে কর্পোরেটদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে আন্তর্জাতিক বাজারের অনিশ্চয়তা ছোট কৃষকদের ঘাড়ে এসে পড়বে, কারণ কর্পোরেটরা শুধু দেশের বাজারে নয়, বিদেশেও কেনাবেচা করে। সেই অনিশ্চয়তা ছোট কৃষকরা সামলাতে পারবেন কি?
প্রশ্নগুলোর কোনও নির্দিষ্ট উত্তর নেই। তাই মনে হয়, কৃষি আইন রদ হয়ে ভালই হল। ভারতীয় কৃষিতে বড় কৃষক-ব্যবসায়ীদের যে কর্তৃত্ব বহু কাল ধরে চলছে, তাকে কেউ আদর্শ ব্যবস্থা বলবে না। কিন্তু এটা ভেঙে ফেলে কৃষির বাজারে মুক্ত অর্থনীতির জোয়ার আনতে গেলে কিছু আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা থাকা চাই— যেমন, কৃষকদের জন্য বিমা, আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা ইত্যাদি। এই সব সুবিধে দিতে পারে, সে রকম প্রতিষ্ঠান এখনও তেমন নেই। একই সঙ্গে দেশে রেশন-নির্ভর দরিদ্র মানুষের সংখ্যাটাও কমানো দরকার। যত দিন না এই কাজগুলি হয়, তত দিন সংস্কারের পথে হাঁটার ব্যাপারে সাবধান।