দিল্লির দূষণের জন্য দায়ী তবে পাকিস্তান। উত্তরপ্রদেশ সরকারের আইনজীবী রীতিমতো সুপ্রিম কোর্টে জানিয়ে দিয়েছেন, অন্য কিছু নয়, সিধে পাকিস্তান থেকে পশ্চিমি হাওয়া এসে দিল্লির বায়ুমণ্ডলের সর্বনাশ করে দিচ্ছে। হাসির কথা নয়, কারণ, গত পঞ্চাশ বছর ধরেই আমরা জানি যে, ভারতের সব অনিষ্টের মূল হল পাকিস্তান। সীমান্তের ওই দিকে মূলত নরখাদক আর সন্ত্রাসবাদীদের বাস, যারা ভারতীয় দেখলেই মুন্ডু চিবিয়ে খায়, কিংবা গুলি করে মেরে ফেলে। ও দিকে থাকার মধ্যে আছে আইএসআই, যাদের কাজ বলতে একমাত্র ভারতের দিকে মিসাইল তাক করে বসে থাকা; শিল্প বলতে কেবল একে সাতচল্লিশের কারখানা; আর চাষবাস হয় একমাত্র উচ্চফলনশীল সন্ত্রাসের।
পূর্ব দিকে অন্য গল্প। তাদের অস্ত্র অনুপ্রবেশ। সীমান্তের ও পার থেকে কোটি-কোটি লোক সমস্ত কাজকর্ম ছেড়ে, এক দৃষ্টিতে তাক করে আছে কখন পবিত্র ভারতভূমে ঢুকে সমস্ত সম্পদ খেয়ে নেওয়া যায়। এই অনুপ্রবেশকারীদের আগুন পোড়াতে পারে না, কাঁটাতার ঠেকাতে পারে না, বিএসএফ এদের সামনে অসহায়। কত জন ‘উইপোকা’ ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছে, কেউ জানে না— পঞ্চাশ লক্ষ থেকে দু’কোটি, নানা রোমহর্ষক সংখ্যা হাওয়ায় ওড়ে। কে না জানে, এদের লক্ষ্য। উপকথার উটের মতো একটু একটু করে ঢুকে পড়া, তার পর ক্রমশ সংখ্যায় বেড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গিয়ে ভারত দখল করে নেওয়া।
নিঃসন্দেহে এগুলো গল্পই। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের প্রশ্নই নেই, আমাদের একশো জনের মধ্যে নিরানব্বই জনই কখনও সীমান্ত টপকাইনি। ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ করলেই বোঝা যায় যে, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ভারতের পশ্চিম দিকের মানুষের থেকে খুব আলাদা কিছু নয়। যে গুটিকয় মানুষ ভিসা পেয়ে পাকিস্তান গিয়েছেন, তাঁরা কেউই বলেননি যে, ওখানে পরিচয় লুকিয়ে ঘুরতে হয়েছে, না হলেই ‘ওই ভারতীয় এসেছে রে’ বলে ঘাড় মটকে দেওয়া হত। যাঁরা বাংলাদেশে গিয়েছেন, তাঁরা আতিথেয়তার গল্প বলেছেন, সৌজন্যের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এমনিতেও বিদেশের মাটিতে দেখা হলে দুই পারের বাঙালিরাই আহ্লাদিত হন, ভাগাভাগি না হলে কী ভাল হত, এই নিয়ে গল্পগাছা করেন। ফলে, এই বৈর-টৈর, এগুলো আসলে তৈরি করা গল্প।
এর মানে অবশ্যই এই নয় যে, ভারত খুব খারাপ জায়গা, আর পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ফুলে ফলে পল্লবিত হওয়ার জন্য আদর্শ। সে রকম একেবারেই নয়, বরং উল্টোটাই— এই তিন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার তফাত বেশি কিছু নয়। হ্যাঁ, ওই দুই প্রতিবেশী দেশে মৌলবাদের দাপাদাপি। কিন্তু সে ভাবে দেখলে ভারতেই মৌলবাদের কমতি কী। বাংলাদেশে নাস্তিক ব্লগারদের চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়, আর ভারতে হিন্দুত্ববাদবিরোধী বুদ্ধিজীবীরা একের পর এক খুন হয়ে যান অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীদের হাতে। তসলিমা নাসরিনকে যেমন বাংলাদেশ ছাড়তে হয়, তেমনই মুম্বই ছাড়তে হয় ফিদা হুসেনকে। প্রতিটি সন্ত্রাসবাদী হামলার পর এ দিকে যেমন শোনা যায় আইএসআই-এর নাম, পাকিস্তানেও একই ভাবে কামান দাগা হয় র-এর বিরুদ্ধে। এ পারে যেমন ‘পাকিস্তান কাশ্মীর ছিনিয়ে নিতে চায়’ বলে গণউন্মাদনা তৈরি করা হয়, ও পারেও ‘কাশ্মীরের দমনপীড়ন’, বা ‘বালুচিস্তানে র-এর ষড়যন্ত্র’ নিয়ে একই রকম হট্টগোল।
অনস্বীকার্য কথাটা হল— ভারত এখনও সাংবিধানিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রশ্নে, এই কারণেই, এখনও সে প্রতিবেশীদের থেকে এগিয়ে, বলতেই হবে। কিন্তু এইটুকু বাদ দিলে, আম-পাকিস্তানির ভারতের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র বাগিয়ে বসে থাকার কোনও কারণ নেই, তা এমনিই বোঝা যায়। যেমন বোঝা যায়, বাংলাদেশ মানবসম্পদ উন্নয়নের কিছু কিছু মাপকাঠিতে ইদানীং ভারতের থেকে এগিয়ে, ফলে শহর-টহরে কাজের খোঁজে কিছু গরিব মানুষ এসে থাকতেই পারেন, কিন্তু কোটি-কোটি লোক নাওয়া-খাওয়া ভুলে অনুপ্রবেশের জন্য তাক করে বসে আছেন, এমনটা হওয়া আজ সম্ভবই না।
ফলে আবহমান বৈরের আখ্যানগুলো, নিঃসন্দেহে গল্পই। কিন্তু তার পরও ‘দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু কে?’ জিজ্ঞাসা করলে ভারতের একটা বড় সংখ্যার মানুষই বলবেন, পাকিস্তান। এর সবচেয়ে বড় কারণটা নিশ্চয়ই রাজনৈতিক। দেশভাগ হয়েছিল ধর্মীয় কারণে। দুই দিকের নেতারা বিস্তর ঘাম ঝরিয়ে, বক্তৃতাবাজি করে, আপাতদৃষ্টিতে সব দিক খতিয়ে দেখে, ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ বার যদি দেখা যায় যে, শত্রুতাটাই আসলে নেই, সীমান্ত-টিমান্ত সব খোলা (যেমন ছিল স্বাধীনতার পরের ক’বছর), চতুর্দিকে ভাই-বেরাদর বা সুখী-সুখী ভাব, তা হলে তো দেশনেতাদের প্রজ্ঞা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়। প্রশ্ন উঠে যায়, কেন ভাগাভাগি? কেন উদ্বাস্তুর স্রোত? কেন রক্তক্ষয়? সে সব প্রশ্ন এড়ানোর জন্যই রাজনৈতিক ভারত আর রাজনৈতিক পাকিস্তানের দরকার পরস্পরের সঙ্গে শত্রুতা। চিরশত্রু মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের যেমন পরস্পরকে দরকার, না হলে মজাটাই মাটি— এটাও সে রকম, কেবল মাপে অনেক বড়। এ ক্ষেত্রে ডার্বি মানে হাতে-কলমে সীমান্ত সংঘর্ষ। মাঝেমধ্যে যুদ্ধ হবে, উত্তেজনা এবং শত্রুতার আবহ বজায় থাকবে, তবেই না দেশভাগের সার্থকতা, সঙ্গে রাজনীতিরও সুবিধা। এক-একটা যুদ্ধ বা সংঘর্ষ বা বিপদ— মানে এক-একটা নির্বাচনী সাফল্য। লোকজন দেশপ্রেমে উন্মত্ত হয়ে এককাট্টা হবে, আর নেতা বা নেত্রী ফোকটে জনপ্রিয় হবেন। সব দিকেই লাভ।
ফলত, রাজনৈতিক সুবিধার্থেই এই বৈর চারিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পদ্ধতির অবশ্য সমস্যা একটাই যে, ডার্বির মতো অত ঘনঘন যুদ্ধ করা যায় না। জনমানসে দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতার চাষবাস করতে হলে স্রেফ যুদ্ধ দিয়ে হয় না। ফলে শক্তপোক্ত চিরস্থায়ী বৈরের ধারণা তৈরিতে সানাইয়ের পোঁর মতো রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে— বা, জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে— ক্রিকেট আর বলিউডকে। ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান খেলা হল যুদ্ধের প্রক্সি। যুদ্ধ বছর-বছর হয় না, কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচ বছরে পাঁচ বার হতেই পারে। সঙ্গে যুদ্ধোন্মাদনা ফাউ। “খুঁজে দেখ, কোন ব্যাটারা পাকিস্তান জিতলে বাজি ফাটায়”— এই হল ভারতের মাটিতে পাকিস্তানি এজেন্ট খুঁজে বার করার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ভারতের মাটিতে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার পতাকা তোলা যায়, ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা ভারতীয় দল জিতলে দিব্যি ফুর্তি করে, পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের দেখে মেয়েরা প্রেমেও পড়তেই পারে, কিন্তু ক্রিকেটে পাকিস্তানের দল জিতলে রাষ্ট্রীয় শোকপালন আবশ্যক। অন্যথায় দেশদ্রোহ। বাজি অবশ্য সত্যি সত্যিই বিশেষ কেউ ফাটায় না— ইচ্ছে থাকলেও অত বুকের পাটা কারই বা আছে? কিন্তু তাতে কী? হাওয়া গরম করতে বছরের পর বছর ঘুরে বেড়ায় বাজি-পোড়ানো, থুড়ি, দেশদ্রোহের গল্প।
এর সঙ্গে ঢাকের বাঁয়া হল মুম্বই-এর সিনেমা। সিনে-যুদ্ধের হিরোরা খালি গায়ে সীমান্তে ফাইট করেন, হাতে টিউবওয়েল নিয়ে শত্রুসৈন্য বধ করেন। স্পাই থ্রিলারের নায়করা সিঙ্গাপুর থেকে দুবাই, সর্বত্র ঘুরে বেড়ালেও, পাকিস্তান ছাড়া আর কারও গায়ে আঁচড়ও কাটেন না। এ অবশ্য একেবারেই বাস্তবানুগ। চিনের সৈন্যরা কাশ্মীরে হাতাহাতি করে ভারতীয় সৈন্য বধ করলে, কিংবা অরুণাচলে আস্ত গ্রাম বানিয়ে ফেললেও, লৌহকঠিন ভারতীয় নেতা ‘তা বলে কি প্রেম দেব না?’ ভেবে চেপে যান; কিন্তু পাকিস্তানের ছায়ামাত্র দেখলেই বিমান বাগিয়ে ও পারে বোমা ফেলে আসেন। তাতে ক’টা পাইন গাছ আর একটা কাক মরলেও সই।
বৈরের বার্তা এই ভাবেই দশকের পর দশক ধরে চারিয়ে দেওয়া হয়েছে। শয়নে-স্বপনে, ক্রিকেটে-বলিউডে, পাকিস্তান আমাদের জীবনে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে, আমরা ‘শত্রুরূপেণ সংস্থিতা’ বলে তার ভজনা করেই চলেছি। সীমান্ত সংঘর্ষ এতাবৎ কাল বহু দেশ করেছে। কিন্তু এমন দশকের পর দশক সেই বিবাদ প্রলম্বিত করার উদাহরণ বেশি নেই। ফ্রান্স আর জার্মানি তো এখন একই সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের যৌথ কেষ্টবিষ্টু। অথচ ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাপারই আলাদা। সেখানে যুক্তি বা বোধবুদ্ধি নয়, ক্রমাগত উন্মাদনার চাষবাসই রাজনীতির মোক্ষ। যে উপমহাদেশে গত দুই হাজার বছরে কেউ ‘অনুপ্রবেশ’ নামক ভাবনার সঙ্গেই পরিচিত নয়, সেখানে আজ একটা কনফেডারেশন বানানোর প্রস্তাবকে পাগলামি ভাবা হয়, আর বন্ধ করা হয় সীমান্ত পেরিয়ে আমজনতার চলাচল। অবস্থা এমন যে, নোটবন্দির মতো সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে হলেও বলতে হয়, হুঁঁঁ হুঁ বাবা কেমন দিলাম, নতুন নোটে জিপিএস লাগানো আছে, পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নিলেও সন্ত্রাসবাদীরা ধরা পড়ে যাবে।
উত্তরপ্রদেশ সরকার স্রেফ এক ধাপ এগিয়ে এসেছে। এমন আর কী?