নিজেদের পরিচয় জানেন না
Tribes

অরুণাচল প্রদেশে উদ্বাস্তু ও আদিবাসীরা আজ ‘রাষ্ট্রহীন’

চাকমাদের পক্ষ থেকে ক্ষুব্ধ মন্তব্য শোনা যায় যে, ৫৭ বছর ধরে তাঁরা অরুণাচলের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের উদ্বাস্তু বলে সম্বোধন করেন

Advertisement
অনিন্দিতা ঘোষাল
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২২ ০৪:৩৩
প্রান্তিক? নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। অরুণাচল প্রদেশ, ১৪ অক্টোবর, ২০১৫।

প্রান্তিক? নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। অরুণাচল প্রদেশ, ১৪ অক্টোবর, ২০১৫।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রান্তিক রাজ্যগুলিরও ‘প্রান্তে’ অরুণাচল প্রদেশ। সেই রাজ্যে আবার প্রান্তবাসী বিরাট সংখ্যক রাষ্ট্রহীন চাকমা ও হাজং জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগত, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জনজাতি সম্প্রদায়কে সভ্য সমাজ ‘ট্রাইবাল’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে অভ্যস্ত। তাঁদের নিয়ে তথাকথিত ‘মেনল্যান্ড’-এর মানুষের কখনও মাথাব্যথা ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু রাষ্ট্রহীন চাকমা ও হাজং জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে অরুণাচল প্রদেশের রাজ্য-রাজনীতি বেশ কয়েক দশক ধরে সরগরম। গত ৪ ডিসেম্বর চাকমাদের জন্য এক বিশেষ জনগণনা করা হবে শুনে এমন আতঙ্ক ছড়িয়েছিল যে, ‘দ্য চাকমা ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’ নামে এক সংগঠন প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান ভাগবতকে হস্তক্ষেপের দাবি জানায়।

ইতিহাস বলছে, দেশভাগ-পরবর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থা, উদ্বাস্তু সম্পর্কে রাষ্ট্রনেতাদের মনোভাব এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ঘিরে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি এই সমস্যার উৎস। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৯৮ শতাংশ বৌদ্ধ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর মতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে, র‌্যাডক্লিফ লাইনের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে জুড়ে দেওয়া হয় ‘পাকিস্তান’-এর সঙ্গে। ১৯৫০-এর দশক থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল হিসাবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করলে অঞ্চলের আদিবাসীরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়তে শুরু করেন। চট্টগ্রামকে শিল্পনগরী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য ১৯৫৩ সালে চন্দ্রগোলাতে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের সহায়তায় কর্ণফুলি পেপার মিল এবং ১৯৫৯-৬৩ সালের মধ্যে পাকিস্তান আমলের সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা, কাপতাই হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্ট গড়ে তোলা হয়। কাপতাই প্রজেক্টের সার্থক রূপায়ণের জন্য ৫২,০০০ একর চাষযোগ্য জমি, যা চট্টগ্রামের মোট আবাদ করা জমির ৪০ শতাংশ নিয়ে নেওয়া হয়। প্রায় লক্ষাধিক আদিবাসী জমি থেকে বিচ্ছিন্ন হন। পাকিস্তান সরকার তাঁদের ক্ষতিপূরণ অবধি দিতে অস্বীকার করলে, তাঁরা অন্যত্র জুম চাষের জমি ও বাসস্থান খুঁজতে শুরু করেন।

Advertisement

এই ভাবে ১৯৬০-এর দশকে প্রায় ১৪,০০০-এর বেশি চাকমা ও হাজং জনজাতির মানুষ আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য, নেফা (অরুণাচল প্রদেশ), মিজোরাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয়ের দাবি জানান। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার নেফা অঞ্চলের টিরাপ ও চাংলাং জেলার এজেন্সি এলাকায়, লোহিত ও সুবলসিঁড়ি জেলায় মোট ১০,৭৯৯ একর জমিতে এঁদের চিরস্থায়ী ভাবে পুনর্বাসন দেয়। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে এই অসহায়, প্রান্তিক, ছিন্নমূল আদিবাসী মানুষদের ‘হিউম্যান ওয়াল’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্য উদ্দেশ্য ছিল, এই অনাবাদি জমিতে এঁদের পুনর্বাসন দিলে, এই অঞ্চলের পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। তবে ভারত সরকার এঁদের বৈধ আশ্রয় দিলেও ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্বের আইনে এঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হল না।

অরুণাচল প্রদেশ নামে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পাওয়ার পর থেকে পিপলস পার্টি অব অরুণাচল ও অল অরুণাচল প্রদেশ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আপসু) চাকমা ও হাজং উদ্বাস্তুদের অবস্থানের বিরোধিতা করতে শুরু করে। ১৯৮০ সাল থেকে রাজ্য সরকার এঁদের চাকরি, সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করে দেয়। যুক্তি ছিল, কম জনসংখ্যার কারণে অরুণাচল প্রদেশ ক্রমে উদ্বাস্তুদের ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’-এ পরিণত হয়েছে। ১৯৮৫ সালের নাগরিকত্ব আইনেও এঁদের কথা বলা হয়নি। ১৯৯৪ সাল থেকে এঁদের অবস্থা আরও সমস্যাসঙ্কুল হয়ে ওঠে। হোম ডিপার্টমেন্ট জানায়, কেন্দ্রীয় সরকারের মতে ১৯৭২ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি (যাতে বলা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে যে শরণার্থীরা পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে এসেছিলেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দেবে ভারত সরকার) এই উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ, ১৯৭১ সালের পরে এলে তা আইনসিদ্ধ নয়। প্রতিবাদ শুরু হয়। রাজ্য সরকার এই উদ্বাস্তু অধিকৃত অঞ্চলের স্কুল বন্ধ করে দেয়, কিছু স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই উদ্বাস্তুরা যতটুকু স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতেন, তাও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়। এমনকি যে সব আদিবাসী জন্মসূত্রে অরুণাচলের বাসিন্দা, তাঁদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকারও অস্বীকার করা হয়।

‘পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ়’ নামে এক সংগঠন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করেছিল, এই আদিবাসীদের ভোটাধিকারের জন্য আইনি পদক্ষেপের। কিছুই হয়নি। ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ৪,৬৩৭ জন চাকমা ও হাজং উদ্বাস্তু নাগরিকত্ব, নাগরিক অধিকার এবং ভোটাধিকারের দাবিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা করলেও, রাজ্যস্তরে চরম নেতিবাচক মনোভাব ও প্রবল বিরোধিতার কারণে কাজের কাজ হয়নি। এই শতকের শুরু থেকে অবস্থা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। ‘রাইট টু ইনফরমেশন’ আইনের মাধ্যমে তাঁদের অধিকার আদায়ে ব্রাত্য করে রাখা নিয়ে তথ্য জানতে চাইলে জানানো হয় যে, চাংলাং ও লোহিত জেলায় অন্তত ২২০ জন চাকমা ও হাজং উদ্বাস্তুর নামে ‘ক্রিমিনাল কেস’ আছে, এবং তাঁরা জোর করে বিরাট পরিমাণ রাজ্যের জমি নিজের অধিকারে অধিগ্রহণ করে রেখে আইনের চোখে ‘অপরাধী’।

এ সব সত্ত্বেও ২০০৪ সালে, জন্মসূত্রে অরুণাচলের বাসিন্দাদের ভোটাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। ২০১৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয় এঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের। ২০১৬ সালে সিটিজ়েনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিলের উপর ভিত্তি করে ভারতের প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত হিন্দু, শিখ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা ভারত সরকার ঘোষণা করলে, গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ রাজ্যে এই বিল নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, মতভেদ, এমনকি হিংসা ঘটে। কিন্তু জন্মসূত্রে বৌদ্ধ এবং হিন্দু হওয়ার কারণে চাকমা ও হাজং শরণার্থীদের মনে স্বভাবত আশার আলো জাগে। কিন্তু, এই সময়ে অরুণাচলে আইন বিরোধিতার যুক্তি হিসাবে তুলে ধরা হয়: এঁদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হলে যে আদিবাসীরা আইনি ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পান, এই উদ্বাস্তুরাও তা দাবি করতে শুরু করবেন। শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে তাঁরা স্থানীয় আদিবাসীদের প্রতিযোগী হয়ে উঠবেন। সুতরাং, নাগরিকত্ব প্রদান করতে হলে তাঁদের ‘লিমিটেড সিটিজ়েনশিপ’ দেওয়া হোক, চাকরি বা জীবিকার ক্ষেত্রে ‘ইনার লাইন পারমিট’ প্রদান করা হোক। এতে তাঁদের জমি এবং সম্পত্তির উপর কোনও অধিকার থাকবে না, বিশেষ সুযোগ-সুবিধেও দেওয়া হবে না।

কোভিডকালে ন্যূনতম খাদ্যের জোগানটুকুও পাননি এঁরা। ন্যাশনাল পিপলস পার্টি এবং আপসু-র মত হল, এঁদের যদি নাগরিকত্ব দিতেই হয়, তা হলে অরুণাচল থেকে সরিয়ে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হোক। চাকমাদের পক্ষ থেকে ক্ষুব্ধ মন্তব্য শোনা যায় যে, ৫৭ বছর ধরে তাঁরা অরুণাচলের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের উদ্বাস্তু বলে সম্বোধন করেন, কেন্দ্র তাঁদের অন্যত্র সরিয়ে দিতে চায়। ৬৫,৮৫১ জনের মধ্যে ভোটাধিকার আছে মাত্র ৪,২৯৩ জনের। তাঁরা নিজেরাও জানেন না, তাঁরা কে। রাষ্ট্রহীন মানুষ? না কি সীমিত অর্থে নাগরিক? দশকের পর দশক ধরে এই ভাবেই রাষ্ট্রীয় প্রতারণার শিকার চাকমা ও হাজং সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তু মানুষেরা।

ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার
মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
Advertisement