ICC ODI World Cup 2023

এই ক্রিকেট বিশ্বকাপে মালুম হচ্ছে, আমরা কেমন যেন ‘ধর্মচ্যুত’ হয়ে পড়ছি

এখনও কোনও চ্যানেল খুললে লাইভে অসংখ্য দর্শক দেখছে দেখালেও আসলে সিংহ ভাগেরই মন অন্যত্র। মন দিয়ে কিছু দেখার চোখ কি প্রযুক্তি, মোবাইলের প্রবল স্রোতে বদলে গেল?

Advertisement
ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:০২
An image of social media

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

একটা টিভির সামনে জটলা। যে যেখানে যে ভাবে দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন ঠিক সে ভাবেই থাকার নির্দেশ। এক বার করে বোলার রান আপে যাচ্ছে আর হৃদ্‌স্পন্দন যেন মুঠোর মধ্যে ধরে বসে থাকা। ওভার শেষের বিজ্ঞাপনী বিরতির সময়টুকুও পেরিয়ে যেত চোখের পলকে। খেলা শুরু হওয়ার আগে টসের মুহূর্ত থেকে একটা বলও মিস না করে পুরো খেলা গোগ্রাসে দেখে নেওয়া আমাদের পরিচিত ছবি। এমন কোনও কিছুই ছিল না যা খেলা দেখা থেকে মনঃসংযোগ সরিয়ে নিতে পারে। বছর কুড়ি আগেও এই ছবি পাড়া-মহল্লায় দেখতে পাওয়া যেত। আজও অনেকে অনায়াসে বলে দেবেন ২০-২৫ বছর আগের কোনও ম্যাচের প্রতি বলের কভারেজ। তাঁরা জীবনের মূল্যবান সময় এই প্যাশন বা উন্মাদনাতে দিয়ে সফল হয়েছেন না বোকা, সে প্রশ্ন থাকলেও আন্তরিকতায় বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিল না।

Advertisement

ভারতের মাটিতে এ বার বিশ্বকাপের আসর। সময় বদলে বেতার, টিভি পার করে হাতে হাতে মোবাইলে খেলার পূর্ণ প্রচার। গোটা পাড়ায় একটা টিভির সেই দিন থেকে একই ছাদের তলায় একাধিক খেলা দেখার মাধ্যম। তা-ও ছুটির দিন একসঙ্গে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার খেলা দেখতে কয়েক জন বন্ধু এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল। অনেক দিন একসঙ্গে খেলা দেখা হয় না, আড্ডাও হয় না। হোয়াট্‌সঅ্যাপ গ্রুপে সবাই দেখা হওয়া নিয়ে উদগ্রীব ছিল। খেলা যখন শুরু হল, আড্ডা তো দূর, টানা খেলা দেখাও যেন কষ্টকর মনে হচ্ছে। খেলা চলছে বড় টিভিতে। এত দিন যাদের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা ছিল, তারা সবাই একই জায়গায় বসে। কিন্তু সকলের চোখ এবং হাত মোবাইলে। অন্য জায়গায় থাকার সময় যারা এই বন্ধুদের গ্রুপে সারা দিন পারলে কথা বলে যায়, তারাই যখন সামনে আসে, তখন খেলা নিয়ে আলোচনায় তারা ব্যস্ত অন্যান্য গ্রুপে। টানা খেলা দেখার সেই ধৈর্যটুকু আর অবশিষ্ট নেই আমাদের। যা সামনে আছে তার থেকেও অন্য যা নেই তার প্রতি কি ভীষণ টান! কিন্তু সেই টানও সাময়িক। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে চাওয়ার ইচ্ছের মতনই। সামনে এসে গেলে সবাই অন্য গ্রুপে ব্যস্ত হয়ে যায়। তাই খুঁজে দেখলে কেবল ক্রিকেট তার ধ্রুপদী ঘরানা বা খেলার চরিত্র বদল করে নিয়েছে তা নয়, দর্শকদের মধ্যেও এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। সময় কম, চাই চটজলদি তথ্য। খেলার শিল্পের থেকেও কে ভাল করে এডিট করে হাইলাইট্স দিতে পারে আইকন বেলে তাকে সাবস্ক্রাইব করে রাখা।

ক্রিকেটকে উপমহাদেশে ধর্মের সঙ্গে তুলনা করা হত। ফুটবল বিশ্বকাপে ঝগড়ার রসদ বেশি থাকে নিশ্চয়ই, কারণ, নিজেদের দেশ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ না করায় বিভিন্ন পক্ষে ভাগ হয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু ক্রিকেটের ক্ষেত্রে নিজেদের দেশ যে হেতু খেলে, তাই অচিরেই মিশে গিয়েছিল জাতীয়তাবোধ। সাহেবদের নিজেদের বানানো খেলায় অংশ নিয়ে তাদের হারানো— সিনেমায় ‘লগান’ থেকে বাস্তবে ন্যাটওয়েস্টে লর্ডসের ব্যালকনিতে সৌরভের জামা ঘোরানোর ছবিতে ধরা পড়ে আছে। সেই ধর্ম হয়ে যাওয়া ক্রিকেটের আবেগে সাফল্যের সময় দেশবাসী বরণ করে নিয়েছে খেলোয়াড়দের। আবার ব্যর্থতার সময় জুটেছে প্রবল গঞ্জনাও। এই সব কিছুর মূলেই ছিল মন দিয়ে ধারাবাহিক ভাবে খেলা দেখার অভ্যাস। এত জনপ্রিয় খেলা, এখনও কোনও চ্যানেল খুললে লাইভে অসংখ্য দর্শক দেখছে দেখালেও আসলে সিংহ ভাগেরই মন অন্যত্র। মন দিয়ে কিছু দেখার চোখ কি প্রযুক্তি, মোবাইলের প্রবল স্রোতে বদলে গেল?

দর্শন চর্চার এক গুরুতর তত্ত্ব বলে, মানুষের অস্তিত্বের সংকট থেকে বিচ্ছিন্নতা বোধের জন্ম হয়। আঙুলের ডগা দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া অসংখ্য টাইমলাইনের ভিড় আর কয়েক সেকেন্ডের রিলে ডুবে থাকার মধ্যে আসলে বিচ্ছিন্নতাই আছে। অজস্র টাইমলাইনে এক জনের সঙ্গে আর এক জনের আপডেটের মিল দূরের কথা, কোথাও শোক আবার তার ঠিক পরেই অন্য জনের পোস্টে বেড়াতে যাওয়ার বিবরণ। রিলে কোথাও রাস্তায় কলার খোসায় পড়ে যাওয়া থেকে পুরনো কোনও ক্রিকেট ম্যাচের ইয়র্কার। একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখতে পাওয়া যায়, পর পর পেরিয়ে যাওয়া পোস্ট বা রিলের প্রায় কোনওটাতেই মানসিক ভাবে একাত্ম হওয়ার সুযোগ নেই।

এক দিনের ক্রিকেট মানে প্রায় সারা দিন। অনেকেই বলেন এত ক্ষণ ধরে খেলা দেখে সময় হেলায় হারানোর মানে নেই। কিন্ত খেলা না দেখে একটার পর একটা কয়েক সেকেন্ডের রিল দেখে যাওয়ার মধ্যে আলাদা কোনও সার্থকতা আছে কি না তা সময় বলবে। তবে মন দিয়ে খেলা দেখার জন্য আর কিছু না হোক, সময় এবং মানসিক ভাবে একাত্ম হয়ে যাওয়া দুইই লাগে। এই একাত্মতাতেই আপত্তি সিংহ ভাগ দর্শকের। ঠিক সেই কারণেই কোনও খেলোয়াড়ের অন্ধ ভক্ত এখন যেমন বিরল, ঠিক তেমনই সাফল্য বা ব্যর্থতায় আনন্দ বা বিরাগ সব কিছুই মাপা। খেলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আবেগ হারিয়ে যেতেই পারে সময়ের নিয়মে, কিন্তু অন্য কিছু নিয়ে কি আবেগ সেই তীব্রতায় আছে? খেলা দেখাতে তো ‘ইমোশনাল ইনভেস্টমেন্ট’ ব্যক্তি মাফিক কম হতেই পারে। কিন্তু সম্পর্কে? সেখানেও কি পূর্ণ অবস্থান আছে? সম্পর্কের নূন্যতম দায়িত্ব পালনেও কি সেই মনোযোগ দেখতে পাওয়া যায় সর্বাত্মক ভাবে?

আসলে প্রশ্নটা দায়বদ্ধতার। অনেকেই গাছ ভালবাসেন বলে দাবি করে সারা জীবনে একটিও চারাগাছ রোপণ করে উঠতে পারেননি। তেমনই খেলা মন দিয়ে দেখার জন্য যে মনঃসংযোগ লাগে, যে একাগ্রতা লাগে তা দিতে বড় আপত্তি। বিশ্বকাপের আয়নায় ক্রিকেট নিয়ে দর্শকদের এই দৃষ্টিকোণ কেবলমাত্র খেলা থেকে মনোযোগ কমে গিয়েছে বললে ঠিক বলা হয় না। শোক থেকে উচ্ছ্বাস— সব কিছুর স্থায়িত্বই বড় সাময়িক। মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে তাই বদলে যায় প্রেক্ষাপট। হেরে যাওয়া দলের হয়ে একযোগে কান্নার দিন শেষ। প্রিয় খেলোয়াড়কে কাছ থেকে দেখার জন্য সারা রাত লাইন দিয়ে থাকা বা হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ছবিও ক্রমে অতীত। স্বপ্নভঙ্গ আর সমষ্টির হয় না, গুরুতর ট্র্যাজেডির দিনও ফুরিয়েছে। এখন কেবল একলা বিষাদ ভেসে আসে। ৯৬-এর ইডেন বা ২০০৩ সালের ফাইনালের রাতে অচেনা মানুষও একাকার হয়ে গিয়েছিল হার ভাগ করে নিতে। এখন বিষাদ পেরিয়ে পেরিয়ে রিল থেকে রিলে চলে যাওয়ার মাঝে ফিকে হতে থাকে স্মৃতি।

(লেখক গবেষক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
Advertisement