দু’বছর পর স্কুল খুলেই আবার ছুটি: এই শিক্ষাবঞ্চনার প্রতিকার কী
school

ওদের স্কুল ওদের অধিকার

গরম প্রচণ্ড বাড়লে স্কুল-কলেজ কিছু দিনের জন্য সরকার বন্ধের ঘোষণা করবে, এ হয়তো আগেও হয়েছে। কিন্তু অন্য বার এ বার তো এক নয়।

Advertisement
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২২ ০৪:৪৩

নতুন ক্লাস শুরুর পর মাসখানেকের স্কুল। নতুন ক্লাসরুম, বেঞ্চ, নতুন পাওয়া বই-খাতার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে পাতাতেই হুশ করে গরমের ছুটিটা এসে পড়ত আমাদের ছোটবেলায়। সে ছুটি ছিল বড় প্রিয়, মায়াময়। সারা দুপুর গল্পের বই, ছবি আঁকা, বেলের পানা, টিভি-তে ছোটদের অনুষ্ঠান। তা সত্ত্বেও শেষের দিকে মন ছটফট করত ক্লাসরুমটার জন্য। এরই মাঝে গরম কখনও চোখ রাঙাত, কখনও কালবৈশাখী এসে একপশলা ঠান্ডা ছড়িয়ে যেত। গ্রীষ্মে গরম পড়বে, বর্ষায় বৃষ্টি, রোদে পুড়ে, জলে ভিজে অসুখ বাঁধবে, সেরেও যাবে, এ সবই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। ছুটি শেষ হলেই যে ক্লাসঘরে ফিরতে হবে, পরীক্ষা দিতে হবে— এ নিয়ে কারও সংশয়, দ্বিধার জায়গা ছিল না।

এখন মনে হয়, ‘নিয়মিত’ স্কুল চলা বিষয়টিই যেন অতীত হতে বসছে। এবং এই ঘটনা ঘটছে মূলত সরকারি উদ্যোগেই। গরম প্রচণ্ড বাড়লে স্কুল-কলেজ কিছু দিনের জন্য সরকার বন্ধের ঘোষণা করবে, এ হয়তো আগেও হয়েছে। কিন্তু অন্য বার এ বার তো এক নয়। গরমের তীব্রতা নিয়েও মতভেদ প্রবল। অতিমারি পরিস্থিতিতে, প্রায় দু’বছর যখন শিশুরা স্কুলের মুখ দেখেনি, সবেমাত্র যখন তারা সেই অভ্যাসে ফিরছিল, এমন সময় ফের একটা বাড়িয়ে দেওয়া ‘গরমের ছুটি’র খুব প্রয়োজন ছিল কি? এতে কি লাভ হল, না ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ল? এখন তো পূর্ণোদ্যমে প্রয়োজন পড়ুয়াদের বিদ্যালয়মুখী করা। দরকার হলে শিক্ষাদিবস বাড়িয়ে এত দিনের ফাঁকগুলো ভরাট করা। যে করে হোক, অতিমারির পর স্কুল করতে-না-চাওয়া শিশুদের ক্লাসঘরে ফেরত আনা। তার পরিবর্তে ফের দীর্ঘ ছুটির ঘোষণা করে কী বার্তা দিচ্ছে সরকার?

Advertisement

বার্তাটি স্পষ্ট। অতিমারি-পরবর্তী সময়ে এই রাজ্যে শিক্ষার ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তার সদিচ্ছা রাজ্য সরকারের নেই। নেই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাও। এর পর যদি ফের অতিমারির চতুর্থ ঢেউ আসে, এবং স্কুল বন্ধ করতে হয়, সেই ফাঁক ভরাট হবে কী করে? সিলেবাসই বা শেষ হবে কী করে? শিশু তো যন্ত্র নয় যে, তিন দিনে সে তিরিশ দিনের পাঠ অনায়াসে রপ্ত করে নিতে পারবে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, তাপপ্রবাহের পরিস্থিতিতেও অন্য অনেক রাজ্য স্কুল খুলে রেখেছে, অথচ এই রাজ্যে তেমন না ঘটলেও স্কুল বন্ধ। কথায় কথায় কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথে অভ্যস্ত এই আমাদের চোখেও কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর উদ্বেগটি অহেতুক ঠেকছে না। অন্য সময় দিন-পনেরো ছুটি বেশি দিলে এত প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু এ বার উঠছে। উঠবে। কারণ, দেশের এবং রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার যা অবস্থা, তাতে এই মুহূর্তের কোনও হঠকারী সিদ্ধান্তের মাসুল সরাসরি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের উপর পড়তে চলেছে। পড়াশোনার অভ্যাস থেকে এক শ্রেণির পড়ুয়া যে ইতিমধ্যেই অনেকাংশে ছিটকে গিয়েছে, তার বহু চিহ্ন চোখের সামনে। লকডাউনের পর যে ছাত্রটি পরিবারের আর্থিক সুরাহার জন্য টোটো চালানোর কাজ ধরেছে, বা যে নাবালিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তারা আর কোনও দিন বিদ্যালয়ে ফিরবে কি? খাতায়-কলমে স্কুলছুটের যে হার দেখানো হচ্ছে, বাস্তব চিত্র যে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভয়ঙ্কর, ক্লাসরুমের ফাঁকা বেঞ্চগুলোই তার প্রমাণ।

এক সময় পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করতে মিড-ডে মিল প্রকল্প শুরু হয়েছিল। তাতে কাজও হয়েছিল। কিন্তু লকডাউনে স্কুল বন্ধের সময় বিলি করা শুকনো খাবার রান্না করা খাবারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। অপুষ্টি তো স্কুল খোলা অবধি অপেক্ষা করে না। ফলে স্কুল বন্ধের সুযোগে শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি বেড়েছে বহু গুণ। সম্প্রতি স্কুল খোলার পর ফের এক বেলা নিশ্চিত খাবারের আশ্রয়ে ফিরছিল দরিদ্র ঘরের সন্তান। মিড-ডে মিলের সামান্য বরাদ্দে অগ্নিমূল্যের বাজারে তার পাতে রোজ ডিম না পড়ুক, পেটভরা ডাল-ভাতটুকু জুটছিল। লম্বা ছুটিতে ফের অপুষ্টির থাবা চওড়া হওয়ার সম্ভাবনা। মা-বাবার কাছেও স্কুলের খাবারের অনিশ্চয়তার চেয়ে নিশ্চিত উপার্জনের পথে সন্তানকে ঠেলে দেওয়া বেশি লাভজনক মনে হয়েছে। কী হবে এই শিশুদের ভবিষ্যৎ? এদের নিয়ে কিছু ভাবছে কি সরকার?

স্কুলশিক্ষার বিকল্প হিসেবে অনলাইন শিক্ষার প্রসঙ্গ বার বারই উঠছে। ভবিষ্যৎ শিক্ষায় অনলাইন ভরসা— সন্দেহ নেই। কিন্তু স্কুলের দরজা বন্ধ করে শিক্ষাব্যবস্থা রাতারাতি ডিজিটাল হয়ে যাবে, এমন বৈপ্লবিক ভাবনা বিশ্বের অনেক প্রথম সারির দেশও ভাবতে পারেনি। তারা অতিমারি উপদ্রব সামলে আগে স্কুল-কলেজ খোলার বন্দোবস্ত করেছে, পুরোদমে পার্টি, রেস্তরাঁয় হুল্লোড়, বর্ষবরণের অনুমতি মিলেছে ঢের পরে। পরিকাঠামোগত দিক থেকে দেখলে তারা এ দেশের তুলনায় আলোকবর্ষ এগিয়ে। বিপরীতে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্রুতগতি ইন্টারনেট দূরস্থান, বিদ্যুৎ সংযোগটুকুও ঠিক ভাবে পৌঁছয়নি। অথচ, সেই নড়বড়ে পরিকাঠামো হাতে নিয়েই প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল শিক্ষার স্বপ্ন দেখিয়ে গিয়েছেন, যেখানে অগণিত ছাত্রছাত্রী শুধুমাত্র একটা স্মার্টফোনের অভাবে দু’বছর পড়াশোনা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। রাজ্যের পরিস্থিতিও এর বাইরে নয়। বার বার স্কুল বন্ধ করে অনলাইন শিক্ষার দিকে ঠেলে দেওয়া হলে ভবিষ্যতে দু’দিনের বৃষ্টি, জমা জল, জ্বরের প্রকোপ ইত্যাদি নানা অজুহাতে অনলাইন ক্লাসই ভবিতব্য হবে। সুতরাং, ‘ডিজিটাল ডিভাইড’, অর্থাৎ শিক্ষায় শ্রেণি-বৈষম্য আরও চওড়া হতেই থাকবে। প্রহসনে পরিণত হবে ‘সকলের জন্য শিক্ষা’র অধিকার।

আর ‘লার্নিং-গ্যাপ’? দু’বছর পরে স্কুল খুলতে গিয়ে দেখা গিয়েছে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ইংরেজিতে নামটুকুও লিখতে পারছে না। বেসরকারি স্কুলগুলোতে অনলাইনে পড়াশোনা তুলনায় কিছুটা ভাল অবস্থায় ছিল। বহু স্কুলে নিয়মিত ক্লাসও হয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও স্কুল খোলার পর প্রাথমিকের পড়ুয়ারা শিক্ষকের নির্দেশ মানতে হিমশিম। সাত বছরের যে মেয়েটি ল্যাপটপে ক্লাস চলাকালীন তুখোড় আত্মবিশ্বাসে উত্তর দিয়েছে, অফলাইন ক্লাসে এত পড়ুয়ার মাঝে সে-ও শিক্ষকের নির্দেশমতো উত্তর করতে পারেনি। বহু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও স্বীকার করে নিয়েছেন, অনলাইন ক্লাস নেওয়ার সময় যা আশা করা হয়েছিল, অফলাইন ক্লাসের মূল্যায়ন তার ধারেকাছে পৌঁছচ্ছে না। তা হলে যে সব স্কুলে পরিকাঠামোর অভাবে নিয়মিত ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয়নি, বা যারা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া, তাদের অবস্থা সহজে অনুমেয়। অনলাইন শিক্ষা ভবিষ্যৎ হতে পারে, কিন্তু এই মুহূর্তে পুরোদমে অনলাইন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাজ্য, তথা দেশ একেবারেই প্রস্তুত নয়। পরিকাঠামোর দিক থেকে নয়, মানসিক দিক থেকেও নয়।

অথচ, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাজকর্ম দেখে মনে হয় না, বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষা আদৌ তার অগ্রাধিকারের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে বলে। কী ভাবে দু’বছরের ক্ষতি মেরামত করা হবে, তার রূপরেখা এখনও স্পষ্ট নয়। বরং জনমোহিনী রাজনীতির চক্করে ছুটির পর ছুটি দিয়ে পড়াশোনা শিকেয় তোলার বন্দোবস্তটি পাকা হয়েছে। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা, রোগব্যাধির হাত থেকে শিশুকে বাঁচাতে হবে, ঠিকই। কিন্তু তাকে পড়াশোনার নিয়মিত অভ্যাসেও ফেরাতে হবে। আর এই দেশে সকলের জন্য শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে স্কুলের উপযুক্ত বিকল্প এখনও তৈরি হয়নি। সুতরাং, অতিমারি যখন সব কিছুকেই নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে, তখন ছুটি নিয়ে আগের ভাবনা আঁকড়ে ধরে রাখলে চলবে কেন? ছুটি কেন প্রয়োজনভিত্তিক হবে না? তীব্র গরমে নিশ্চয়ই স্কুল বন্ধ রাখা হবে। কিন্তু গরম কমলে পরিস্থিতির উন্নতি হলে ফের স্বাভাবিক পঠনপাঠন শুরু হবে না কেন?

এখানে নাগরিকেরও কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। বহু জায়গায় অতিমারি কালে শিক্ষকরা নিজ উদ্যোগে ছোট ছোট পরিসরে জনাকয়েক ছাত্র নিয়ে পাঠদানের অভ্যাসটি বজায় রেখেছিলেন। সেই দায়িত্ববোধ কিন্তু ব্যতিক্রমী হয়েই রইল। অনুসরণের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠল না। অথচ সরকার যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, নাগরিককেই দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসতে হবে। নাগরিকের সেই দায়িত্বের ঘরে এখনও পর্যন্ত কেবল ফাঁকি। যে শিশুদের ‘সুরক্ষা’র কথা ভেবে এত ভাবনাচিন্তা, তারাও কিন্তু স্কুলেই ফিরতে চায়। বাড়ির বদ্ধ জীবন আর মোবাইলের স্ক্রিনে ঘাড় গুঁজে-থাকা জীবন তারাও চায় না।

আরও পড়ুন
Advertisement