হঠাৎই ২০১৭-র ডিসেম্বরে, খবরের শিরোনামে উঠে আসে আপাত-শান্ত সীমান্ত রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ। এইরাজ্যের মুখ্য নদী সিয়াং-এর স্ফটিক জল পাসিঘাট শহরের কাছে যেন কৃষ্ণবর্ণ! কেন এমন হল? আঙুল ওঠে চিনের দিকে। উত্তরের শুষ্ক টাকলামাকান মরুভূমি অঞ্চলে জল সরবরাহের জন্য উচ্চ অববাহিকায় সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কারণেই কি নদীটির এই হাল?
অনেকে অবশ্য দাবি করেন, এর মাসখানেক আগে তিব্বতে ভূমিকম্পের জেরে যে ব্যাপক ভূমিধস হয় তার ফলেই নাকি বদলে গিয়েছিল নদীর জলের রং। এর পরে আরও একাধিক বার হয় সিয়াং-এর জলের রং বদলেছে, নয়তো জলে ‘টোটাল ডিসলভ্ড সলিডস’ (টিডিএস) বা মোট দ্রবীভূত পর্দাথের বৃদ্ধির জেরে মৃত্যু হয়েছে শয়ে শয়ে মাছের, যা চিনের বিরুদ্ধে উষ্মা বাড়িয়েছে স্থানীয় মানুষের।
সিয়াং নদীটি আসছে দক্ষিণ তিব্বত থেকে, যেখানে সে পরিচিত ইয়ার্লুং সাংপো নামে। তিব্বতে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ভারত সীমান্তের আগেই সটান একটি বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়েছে অরুণাচল প্রদেশে। এর পরে অসমে ব্রহ্মপুত্র এবং আরও নিম্ন অববাহিকায় বাংলাদেশে পদ্মা নামে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে সে মিশছে বঙ্গোপসাগরে। অরুণাচলের নদী-তীরবর্তী জনজাতি সম্প্রদায়ের কাছে সিয়াং শুধু পবিত্রই নয়, তাঁদের জীবনজীবিকার অন্যতম উৎসও বটে। তবে এই অঞ্চলের বিপুল জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা সীমান্তের দু’তরফের সরকারকেই এই নদীতে আগ্রহী করে তুলেছে। এতে অবশ্য মোটেই সায় নেই স্থানীয়দের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে গত বছরের শেষে পড়শি রাষ্ট্রটি ঘোষণা করে, ইয়ার্লুং সাংপো নদের নিম্ন উপত্যকায় বিশ্বের বৃহত্তম নদীবাঁধ তৈরির ছাড়পত্র দিয়েছে শি জিনপিং সরকার। বর্তমানে চিনের ইয়াংজ়ে নদীর উপরে ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’ নামে বিশ্বের বৃহত্তম যে বাঁধটি রয়েছে, আকারে প্রকারে এটি হবে তার তিন গুণ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারত-চিন বিতর্কিত সীমান্তের কাছাকাছি যেখানে ইয়ার্লুং সাংপো বাঁক নিয়ে অরুণাচল প্রদেশে ঢুকছে, সেই মুখেই তৈরি হওয়ার কথা বাঁধটি। আমরা স্কুলবেলায় পড়েছি, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন মূলত নির্ভর করে নদী-ঢালের উচ্চতার উপরে। নদীর ঢাল যত উঁচু হবে, তত শক্তি উৎপাদনে সুবিধা হয়।
এ দিকে বাঁধ তৈরির ক্ষেত্রে চিনের তরফে সীমান্তবর্তী এমন কৌশলগত স্থান বাছাই-ই দিল্লির চিন্তার কারণ। পানীয় জল, সেচের কাজকর্ম এবং তাপবিদ্যুৎ শক্তির উৎসের কারণে এই ব্রহ্মপুত্র হল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘জীবনরেখা’। ভারতের মিষ্টি জলের ৩০ শতাংশ আসে ব্রহ্মপুত্র থেকে, যা এই অববাহিকা অঞ্চলের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। এমন বাঁধ তৈরি হলে তাই সমস্যা বাড়বে ভারতেরই।
এমনিতেই বর্ষার মরসুমে এই অঞ্চলের বন্যা সমস্যার মূলেও রয়েছে এই নদী। বর্ষার সময়ে চিন বাড়তি জল ছাড়লে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে বন্যার সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠবে। উল্টো দিকে, শুষ্ক মরসুমে চিন নদীর জল আটকে রাখলে তার কু-প্রভাব পড়বে এই অঞ্চলের কৃষি, পানীয় জল সরবরাহ এবং জলবিদ্যুৎ শক্তির উপর। পাশাপাশি জলের প্রবাহ কমে গেলে নদীতে জমবে পলি, হ্রাস পাবে প্লাবনভূমির মাটির উর্বরতা, ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র।
দিল্লির আশঙ্কা, আগামী দিনে নতুন করে দু’দেশের মধ্যে বিবাদ শুরু হলে এই নদীর জলকে ‘হাতিয়ার’ করতে পিছপা হবে না বেজিং। নদীর জল বণ্টন নিয়ে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সঙ্গেও বিবাদ রয়েছে ভারতের। কিন্তু সেই বিবাদ তত্ত্বগত ভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে, যে-হেতু দুই দেশের সঙ্গে এই বিষয়ে চুক্তি (ইন্দাস ওয়াটারস ট্রিটি, গঙ্গা ওয়াটার ট্রিটি) রয়েছে ভারতের। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রে তেমন কিছু নেই!
সুতরাং? বাঁধের উত্তর বাঁধ দিয়ে দিতেই চাইছে ভারত। সিয়াং-এর উপর তৈরি করতে চাইছে সিয়াং আপার মাল্টিপারপাস প্রোজেক্ট। তাদের দাবি, প্রকল্পটি শুধু বন্যা রোধে সাহায্য করবে না, জলাধারে বাড়তি জল ধরে শুখা মরসুমে জলের সমস্যাও মেটাবে। অবশ্য স্থানীয়দের দাবি, এই বাঁধ তৈরি হলে ভেসে যাবে বহু গ্রাম। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কাজের সুযোগ কম থাকায়, এখানে জমির গুরুত্ব মানুষের কাছে বেশি। ২০২২ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে সিয়াং নদীর উপরে ৪৪টি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয় সরকার। কিন্তু এ বার আর এই পরিকল্পনা থেকে পিছু হটতে রাজি নয় কেন্দ্র তথা রাজ্য। অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু-র দাবি, এটা শুধু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নয়, সরকার চায় সিয়াং নদীটাকে বাঁচাতে!
অন্য দিকে, চিনে এই বাঁধের সমালোচকদের দাবি, ‘থ্রি গর্জেস’ বাঁধ নির্মাণের জেরে যেখানে একাধিক শহর গিয়েছিল ডুবে, বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ এবং ভয়ানক প্রভাব পড়েছিল আঞ্চলিক পরিবেশের উপরে, সেখানে নতুন বাঁধ নির্মাণে এই অঞ্চলে কী প্রভাব পড়তে চলেছে তা সহজেই অনুমেয়। ভঙ্গুর প্রকৃতির কথাও ভাবতে হবে। বিশ্বের বড় ভূমিকম্পগুলির প্রায় ১৫ শতাংশ ঘটেছে এখানেই। জানুয়ারিতে তিব্বতের ভূমিকম্প, সম্প্রতি মায়ানমারের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প মনে করা যেতে পারে। মায়ানমারে তিন হাজার ছাড়িয়েছে মৃতের সংখ্যা, সরকারি ভাবেই।
দু’তরফেই সরকার যে ‘সাফাই’-ই দিক না কেন, সাধারণ মানুষ বিলক্ষণ জানে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে উলু-খাগড়াদেরই ঘোর বিপদ। সিয়াং প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদের স্বর বাড়তে দেখে বিজেপি সরকার তড়িঘড়ি আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছে। আর চিনে যে প্রতিবাদের কী হয়, তা তো বহুচর্চিত। ভারত-চিন কূটনীতি কি তবে ‘লাদাখ’ পেরিয়ে এ বার ‘সিয়াং’ পর্বে পৌঁছল?