privatization

ভারতে সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণের চরিত্রটি কি আদৌ স্বচ্ছ?

ভারতে সরকারি সংস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হলে দেখা যায় অসঙ্গতি। দেউলিয়া সরকারি সংস্থা কি বেসরকারি হাতে পড়ে লাভজনক হয়ে উঠতে পারে?

Advertisement
টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২২ ১০:২১
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

ভারত সরকারের তরফে দু'টি সাম্প্রতিক বিক্রয়ের কথা ভাবুন— একটি টাটা গোষ্ঠীর কাছে এয়ার ইন্ডিয়ার যাবতীয় কিছু বিক্রয় এবং অন্যটি জীবনবিমা নিগমের (এলআইসি) শেয়ার তার খুচরো লগ্নিকারীদের কাছে বিক্রয়। এলআইসি-র যে প্রস্তাবিত মূল্য রাখা হয়, তা তার প্রতিযোগী সংস্থাগুলির ‘মেট্রিক্স’ (পরিষেবা বা পণ্য উৎপাদনের খতিয়ান নিয়ে পরিমাণগত পরিমাপ) -এর খণ্ডিতাংশ মাত্র। অন্তত পক্ষে ‘এমবেডেড ভ্যালু’ (কোনও বিমা সংস্থার ভবিষ্যৎ লভ্যাংশের হিসাবে সাম্প্রতিক মূল্য এবং তার স্থাবর সম্পত্তির মোট মূল্যের যোগফল)-র সাপেক্ষে তো বটেই।

যদিও এলআইসি-র শেয়ারের দাম তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকেই তা পড়তির দিকে ছিল, কিন্তু তেমন বিপর্যয়ের উদাহরণ সরকারি সংস্থার ইতিহাসে (উদাহরণ কোল ইন্ডিয়া) আগেও দেখা গিয়েছে। এলআইসি-র সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সংস্থার ৯৬.৫ শতাংশ সরকারি অধিকারে ছিল। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়ার সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ করা হয়। প্রাথমিক পর্বে সরকারের হাতে কিছু শেয়ার রেখে সংস্থাটির বেসরকারিকরণের প্রস্তাব আনা হয়েছিল। কিন্তু কোনও ক্রেতা না পাওয়ায় সংস্থাটির যাবতীয় শেয়ার বিক্রয়ের প্রস্তাব আনা হয়। সংস্থাটি সম্পূর্ণ বিক্রয়ের কথা তখনই ওঠে, যখন দেখা যায় যে সরকার কম-বেশি ৫০,০০০ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে (এখন আবার বেশির ভাগ মানুষ আশা করছেন যে, বিমান পরিবহণ সংস্থাটি আগের চেয়ে ভাল পরিষেবা দেবে)।

Advertisement

এ ধরনের বৈপরীত্য নতুন কিছু নয়। বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া সংস্থাগুলি (বিশেষত বাজপেয়ী জমানায় অরুণ শৌরি দস্তা ও তামা শিল্পের মতো যেগুলি বিক্রয় করেছিলেন) বিক্রয়ের পর সরকারি মালিকানাধীন অবস্থার (ব্যক্তিগত অংশীদারদের সংখ্যা সীমিত থাকার পরিস্থিতিতে) থেকে অধিকতর ভাল ফল দেবে বলে মনে হয়েছিল। এমন বহু ‘বিলগ্নীকৃত’ সংস্থাকে তাদের সর্বোচ্চ মূল্যের অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ দামে বিক্রয়ের জন্য উপস্থাপন করা হয়। যদিও সেই সময় শেয়ার বাজারের সূচক তাদের সর্বোচ্চ মূল্যের চেয়ে বড় জোর ১০ শতাংশ কম দেখাচ্ছিল।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি থেকে লক্ষ কোটি টাকা ‘ফ্রেশ ক্যাপিটাল’ (কোনও পণ্য বা পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাকে নজরে রেখে উপস্থাপিত ‘গ্রোথ ফান্ড’) হিসেবে যখন সরকার তুলে নেয়, তখনও কিন্তু এই ছবিটি বদলায়নি। অথবা যখন বিএসএনএল এবং এমটিএনএল-এর মতো টেলিকম সংস্থার যৌথ বিপর্যয়কালে পরোক্ষ ভাবে হাত তুলে নেয়, তখনও বিষয়টি একই চরিত্রের ছিল।

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন।

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। ফাইল চিত্র।

‘বিলগ্নীকরণ’-এর (‘বেসরকারিকরণ’-এর সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেললে চলবে না) যুক্তি ছিল এই যে, যত কম সংখ্যাতেই হোক না কেন, ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের চাপে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি অধিক দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবে এবং সরকার নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবে। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, সরকারি হস্তক্ষেপের বাইরে বেরিয়ে এসে এই সব সংস্থার পরিচালকবর্গ আরও খানিক বেশি দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পাবেন।

এ সব যুক্তি কয়েকটি ক্ষেত্রে খেটে গিয়েছিল। কিন্তু সর্বত্র খাটেনি। ‘হিন্দুস্তান এরোনটিক্‌স’-এর মতো প্রতিরক্ষা দফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা এবং ভারত টেলিকমের মতো সংস্থা পরিচালনগত স্বাধীনতা ভোগ করে এবং তাদের শেয়ারের দামও চড়তে শুরু করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই সব সংস্থা ‘প্রায় একচেটিয়া’ চরিত্রের। প্রতিযোগিতার বাজারে দাঁড়ালে দেখা যাবে, ‘লারসেন অ্যান্ড টুব্রো’-র জাহাজ নির্মাণ সংস্থা নির্ধারিত দামে এবং নির্ধারিত সময়ে বরাতপ্রাপ্ত উৎপাদন সরবরাহ করতে সমর্থ। এই কাজটিই প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীন ম্যাজাগন শিপইয়ার্ডের একটি সংস্থা কোনও দিনই করে উঠতে পারেনি।

আসলে ঘটনাটি এই যে, সরকারি মালিকানাধীন ক্ষেত্রগুলিতে পরিচালনগত সিদ্ধান্তগ্রহণের পরিসরটি সংকীর্ণ। সেই কারণেই জীবনবিমা নিগম এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি বেসরকারি মালিকানাধীন প্রতিযোগীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর পাশাপাশি যে সমস্যাটিকে উপস্থাপন করা হয় সেটি এই যে, সরকারি মালিকানাধীন সংস্থার পরিচালকবর্গ নয়, স্বয়ং সরকারই সরকারি সংস্থাগুলির তালিকা প্রস্তুতের সময় দফতরগত খামখেয়ালে অনেক সংস্থার অন্তর্ভুক্তিকে নাকচ করে দেয়। তখনই আগাপাশতলা বেসরকারিকরণের পক্ষে যুক্তি খাড়া করা হতে থাকে। যেমন করা হয়েছে এয়ার ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রে। যার পিছনে মন্ত্রক-ঘটিত হস্তক্ষেপ ছিল সব চেয়ে বেশি মাত্রায় দায়ী।

সরকারি ক্ষেত্রের সমর্থকরা বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে ব্যর্থতার উদাহরণ দিতেই পারেন। কিন্তু তেমন উদাহরণ সরকারি ক্ষেত্রেও প্রচুর রয়েছে। যেমন বেশ কিছু লাইসেন্স প্রাপ্ত বেসরকারি ব্যাঙ্ক (গ্লোবাল ট্রাস্ট, সেঞ্চুরিয়ন ইত্যাদি) বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আবার অন্য অনেক ব্যাঙ্ক (যেমন ইয়েস ব্যাঙ্ক) কেলেঙ্কারিতে ডুবেছে। টেলিকম ক্ষেত্র ও বেসরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ সব মেনে নিয়ে বলা যায়, প্রতিযোগিতার যে সব ক্ষেত্রে পরাজিতরা তাদের কারবার চালিয়ে যেতে ব্যর্থ, সেখানে সরকারি ক্ষেত্রে করদাতাদের টাকা পরাজিত পক্ষের তহবিলে ঢুকিয়ে সেগুলিকে কোনও মতে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।

ভারতের প্রেক্ষিতে বেসরকারিকরণের বিপক্ষে প্রকৃত যুক্তিটি হল, কোনও বৃহৎ সংস্থা বিক্রি হলে তা গিয়ে পড়ে এ দেশের এক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীভুক্ত পুঁজিপতিদের হাতে। ইতিমধ্যেই ক্ষমতাবান সেই সব ‘গোষ্ঠীপতি’-দের আরও বেশিমাত্রায় ক্ষমতায়িত হতে দেখতে কোনও অনুভূতিসম্পন্ন মানুষই চান না। সেই কারণেই ভারতে ‘বাজার’ (বিমান পরিবহণ, টেলিকম, ব্যাঙ্কিং, বিমা)-এর বেসরকারিকরণ হয়। সেই বাজারে ক্রিয়াশীল সংস্থাগুলির হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিযোগিতার বাজারে সরকারি মালিকানাধীন পরাজিতবর্গের সঙ্গে কী করা যায়, তা একটি সমস্যা হিসেবে থেকেই যাচ্ছে।

যদি কেউ এয়ার ইন্ডিয়া সংক্রান্ত সমাধানকে অনুসরণ করতে চান, তাঁকে তত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, যত দিনে সংস্থাটি দেউলিয়া হয়ে পড়বে এবং বিনামূল্যে কাউকে দিয়ে দেওয়া হবে (যদি কেউ আদৌ নিতে চান)। অথবা সরকারি সংস্থার দেউলিয়া হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে দীর্ঘায়িত করে সেগুলিকে খোলাবাজারে নিলাম ডেকে বিক্রি করে দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ক্রেতা পূর্বোক্ত ‘গোষ্ঠীপতি’-ও হতে পারেন, যিনি অন্যান্য দর-হাঁকিয়েদের ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছেন (মনে রাখা দরকার, ভারত এমন একটি দেশ, যেখানে স্বচ্ছ কোনও প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছে পরিণত করার কাজটি অতি সহজ)।

আরও পড়ুন
Advertisement