ধনী দেশগুলিই দূষণদায়ী
Climate Change

জলবায়ু পরিবর্তনের সাদা-কালো এবং উন্নয়নশীল দেশের বাস্তব

পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে অনেক বারই।

Advertisement
মোহিত রায়
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৩৭

নভেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বের সব দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে রাষ্ট্রপুঞ্জের বার্ষিক সভা বসেছিল। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দেশের প্রায় পঁচিশ হাজার প্রতিনিধি এবং শ’খানেক দেশের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীরা। সভার বাইরে কয়েক হাজার পরিবেশবাদী বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত চিন্তার বিষয়ে এ বার বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল কয়লার ব্যবহার। সম্মেলনে এই কয়লার বিষয় নিয়ে ভারত সমালোচিত হয়েছে। সম্মেলনের প্রতিশ্রুতিতে প্রস্তাব ছিল ‘কয়লার ব্যবহার শেষ করার দিকে পদক্ষেপ করা’, ভারতের (সম্ভবত চিনেরও) চাপে তা পাল্টে হয়েছে কয়লার ব্যবহার কমানোর দিকে পদক্ষেপ করা। কয়লা এখন এক দূষিত শব্দ। ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন পোল্যান্ডকে নতুন কয়লাখনি বন্ধ না করলে ব্যবস্থা করার হুমকি দিয়েছে।

পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে অনেক বারই। অর্ধশতক আগে ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহলমে রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত ‌প্রথম পরিবেশ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, দারিদ্রই প্রধান দূষক, যা তখন বিশেষ আলোচিত হয়েছিল। উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য পরিবেশ রক্ষায় এ ছিল গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। মনে করা যেতে পারে ডিডিটির কাহিনি। ডিডিটি আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৮ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন সুইস বিজ্ঞানী পল মুলার। নোবেল কমিটির ভাষায়, এই একটি রাসায়নিক হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ডিডিটির অতিরঞ্জিত ভয়াবহতার একটি বই নিয়ে হইচই করে পরিবেশবাদীরা পৃথিবী জুড়ে ডিডিটি বন্ধের ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে চিন ও ভারত তা মেনে নেয়নি। ম্যালেরিয়া দূরীকরণে ডিডিটির ব্যবহার এখন স্বীকৃত। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম ডিডিটি প্রস্তুতকারক।

Advertisement

বিশ্ব উষ্ণায়ন হ্রাসে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর কথা প্রথম থেকেই বলা হয়েছে। এতে সবচেয়ে বড় অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত কয়লা। কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ছাড়াও বায়ুদূষণের বড় অভিযোগ কয়লা পোড়ানোর বিরুদ্ধে। ব্রিটেনে ও পশ্চিমি দুনিয়ায় যে শিল্পবিপ্লব সারা পৃথিবীর মানবসভ্যতার ইতিহাসকেই পাল্টে দিল, তাতে মুখ্য ভূমিকা ছিল কয়লার। আগে মানবসভ্যতার মূল শক্তির উৎস ছিল জৈব শক্তি, মানুষ ও পশুর পেশিশক্তি, কাঠ উদ্ভিদের জ্বালানি, জলশক্তি, যা সবই মূলত পুনর্নবীকরণযোগ্য। এই শক্তির বলে মানবসভ্যতার গতি ছিল শ্লথ। কয়লা এসে পাল্টে দিল সেই ছবি— হাজার বছরের পরিবর্তন ঘটতে থাকল এক শতকে। ১৮০০ সাল থেকে ১৯৫০, শিল্পবিপ্লবের পুরোধা ব্রিটেনের শক্তির ৮০ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ জুগিয়েছে একাই কয়লা। বিশ্ব উষ্ণায়নের মাথাব্যথা তখন ছিল না, কিন্তু এই সময়ে ব্রিটেনের শহরাঞ্চলের বায়ুদূষণ ছিল সাধারণের আলোচ্য বিষয়। শিল্পের অন্যান্য দূষণও ছিল। একই সময়ে আবার ব্রিটেনের একটি শিশুর জন্মের সময় তার গড় আয়ু ৪০ বছর থেকে বেড়ে হল প্রায় ৭০ বছর। দূষণ বাড়লেও শিল্প বিপ্লব ও তার সহযোগী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশাল প্রসারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানকে করেছে অনেক উন্নত। উন্নয়ন ও পরিবেশ নিয়ে ভাবার সময় এ সব ভুললে চলবে না।

উন্নয়নের অবস্থান বোঝার একটি সাধারণ সূচক জনপ্রতি শক্তির ব্যবহার। এতে আমরা চিনের থেকে ৪ গুণ আর আমেরিকার থেকে ২০ গুণ পিছিয়ে আছি। উন্নয়ন কাকে বলে এই নিয়ে হাজারো সমাজতাত্ত্বিক-দার্শনিক প্রশ্ন উঠবার আগেই জানাই যে, উন্নয়ন মানে সাধারণ ভাবে বুঝি সবার বাড়িতে চাই তিনটি ঘর, বিদ্যুৎ, এয়ার কন্ডিশনার, মোটরগাড়ি, ওয়াশিং মেশিন, কম্পিউটার ইত্যাদি যা সব সরকারি অফিসার বা পরিবেশবাদী অধ্যাপকদের আছে। সম্ভব হলে কালকেই চাই। আর, সেই জন্যই চাই আরও শক্তি, মানে আরও কয়লা। জীবাশ্ম জ্বালানির স্থান নিতে পুনর্নবীকরণযোগ্য বায়ুশক্তি, সৌরশক্তি ইত্যাদির এখনও অনেক পথ যেতে হবে। সুতরাং কেউ বলতেই পারেন, দেশের স্বার্থে দূষণ ও উষ্ণায়নকে সঙ্গে করেই উন্নয়নশীল দেশগুলিকে এগোতে হবে, যেমন এগিয়েছে চিন।

এটাও সর্বজ্ঞাত যে, জনপ্রতি কার্বন নিঃসরণের তালিকায় উপরের সারিতে আমেরিকা ইউরোপ, মাঝামাঝি চিন, আর একবারে শেষের সারিতে ভারত। যদি ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ নিজেদের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে আনেন, তবে এর কিছুটা সুরাহা হত। ২০০৭-এ বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে কিছু সাধারণ জ্ঞান বিতরণ করে নোবেল শান্তি পুরস্কারের অর্ধেক ছিনিয়ে নিলেন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর। বাকি অর্ধেক পেলেন আইপিসিসি-র আড়াই হাজার বিজ্ঞানী। সেই আল গোর থাকেন ২০টি ঘরের প্রাসাদে— তাঁর কার্বন পদাঙ্ক গড় আমেরিকানের ২০ গুণ বেশি, গড় ভারতীয়ের ৩০০ গুণ। উষ্ণায়নবিরোধী রাষ্ট্রপুঞ্জের বিখ্যাত চিত্রতারকারা ব্যক্তিগত বিমানে ঘোরেন।

ফলে তাঁদের জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে গরিব দেশের কোনও দায়িত্বের কথা বলাটাই অযৌক্তিক। আসলে পশ্চিমি দুনিয়ায় বিশ্ব উষ্ণায়ন বা নাম বদলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে বিরাট রোমহর্ষক প্রচার পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে, সমাজমাধ্যমে চলছে, তা বিজ্ঞান ছাড়িয়ে অনেকটাই নৈতিক প্রচারে দাঁড়িয়েছে। আব্রাহামীয় চিন্তায় মানুষ পাপের সন্তান, আর এই নব্য আব্রাহামীয় চিন্তায় সাম্প্রতিক পাপ হল গত তিনশো বছরের মানবসভ্যতার উন্নয়ন। আর বলা হচ্ছে আব্রাহামীয় চিন্তার শেষের সে দিন বা কেয়ামতের দিনের ভয়ঙ্করের গল্প, পৃথিবী নাকি ধ্বংস হতে চলেছে। মানুষ ভয় পেতে ভালবাসে, পয়সা খরচ করে ভূতের গল্পের বই কেনে। ভূতুড়ে আবহাওয়া তৈরি করতে পারলে শিশুকিশোররা ভয় পায়। অত্যন্ত ধনী দেশ সুইডেনের স্কুল পাশ এক কিশোরী ভূতগ্রস্তের মতো শেষের সে দিনের ভয় পাওয়ানোর গপ্পো বলেই চলেছে, আর এক দল পরিবেশবিলাসী তাকে মাথায় তুলে ভবিষ্যৎদ্রষ্টার আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের চেয়ে এই পরিবেশ-বিলাস কোনও মতেই কম ভয়ঙ্কর ঘটনা নয়।

আগেকার সম্মেলনের মতোই এ বারও বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছে। ১৪০টি দেশ কার্বন-শূন্য হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ১০০টি দেশ বলেছে ২০৩০ সালের মধ্যে তারা অরণ্য ধ্বংস বন্ধ করে দেবে। ৪০টির বেশি দেশ বলেছে, তারা কয়লা ব্যবহার থেকে সরে আসবে। পোল্যান্ডের ৮০ শতাংশ, চিন ও ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ শক্তির জোগান দেয় কয়লা। চিন ও ভারতের উন্নয়নের অগ্রগতি এখন ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের মতো। কয়লা বাদ দিলে মুখ থুবড়ে পড়বে চিন ও ভারতের উন্নয়ন। সে জন্য গ্লাসগোর হইচইয়ের মধ্যেই চিন আরও ৪৩টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা ঘোষণা করেছে। পরিবেশবাদী মহলে একটি চালু স্লোগান ‘থিঙ্ক গ্লোবালি, অ্যাক্ট লোকালি’। মদীয় অনুবাদে, ‘চিন্তায় রাখো বিশ্ব, কাজ করো নিজস্ব’। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বীরভূমে ডেউচা-পাঁচামি কয়লা খনির কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে, যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লাখনি। সুতরাং কাজ করো নিজস্ব, কয়লাকে বাদ দিয়ে নয়। গ্লাসগোর মঞ্চে ভারত অবশ্য জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে আগামী দশ বছরে ৫০% পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে দেখতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন রোখার উৎসাহ ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির সীমিত সামর্থ্য যেন খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামোর বাজেটে বড় কোনও ক্ষতি না করে। সহনশীল উন্নয়ন বা ‘সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট’ যেন শেষ পর্যন্ত সহনশীল দারিদ্র না হয়ে দাঁড়ায়।

আরও পড়ুন
Advertisement