বহরমপুরে জলাভূমি রক্ষার দাবিতে অনশনে বসেছিলেন ১১ জন প্রবীণ বুদ্ধিজীবী। ছিলেন প্রতিবাদী মানুষও। কর্মসূচি শুরুর কিছু ক্ষণের মধ্যেই বিশাল পুলিশবাহিনী তাঁদের তুলে দেয়। ২৬ জনকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। মহকুমাশাসক জানান, রাজ্যে বিপর্যয় মোকাবিলা আইন বলবৎ আছে, তাই অবস্থানে বসতে বারণ করা হয়েছিল, ওঁরা শোনেননি। অতএব পুলিশ ব্যবস্থা করেছে। আন্দোলনকারীরা জানান, কোভিড পরিস্থিতি মাথায় রেখেই অল্প কয়েকজন প্রতিবাদে বসেছিলেন, মাইকও বাজানো হয়নি। পর দিন পুলিশের বিরুদ্ধে শহর জুড়ে মিছিল হয়। প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে সাহস করেনি। ঘটনা দু’টি ২৭ ও ২৮ অক্টোবরের।
কুলতলি থানা এলাকায় ইয়াসে বিপর্যস্ত সুন্দরবনবাসীর পুনর্বাসনের দাবিতে ডেপুটেশনের আয়োজন করে এপিডিআর। তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধেও বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে মামলা দেওয়া হয়। নবান্ন অভিযানের উদ্যোগের জন্য উক্ত আইনে মামলা হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে। জেল খাটতে হয় ডিএসও সমর্থকদের। একই অভিজ্ঞতা আরও বহু ছোট সংগঠনের।
অথচ, রাজ্যে শাসক দল-সহ বড় রাজনৈতিক দলগুলির সভা-সমাবেশ হচ্ছে। নির্বাচনী সমাবেশ, বিজয়া সম্মিলনী, বিজেপি থেকে তৃণমূলে ‘ঘর ওয়াপসি’-র সভা, সিপিএম-নিয়ন্ত্রিত কৃষক সভার সম্মেলন— সব হচ্ছে। আছে উৎসবও— মুখ্যমন্ত্রী নিজে ৫০টিরও বেশি দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করেছেন, মানুষকে মেতে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তা হলে জলাশয় বোজানোর বিরুদ্ধে অবস্থান অথবা দুর্নীতি-অপশাসনের প্রতিবাদে সভা হলে তাতে কেন নিষেধাজ্ঞা? ছোট সংগঠনের কর্মীদের গ্রেফতার করে দিনভর থানায় বসিয়ে রাখা হচ্ছে কেন? কেনই বা তাদের মামলা দিয়ে হেনস্থা করা হচ্ছে?
কৌতুকের বিষয়, তৃণমূল-শাসিত পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দল বা মানবাধিকার সংগঠনগুলি সরকারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলছে, তৃণমূল সেই একই অভিযোগে সরব বিজেপি-শাসিত গোয়া ও ত্রিপুরায়। তাদের অভিযোগ, গোয়া ও ত্রিপুরা সরকার বিপর্যয় মোকাবিলা ও মহামারি আইন ব্যবহার করে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করতে দিচ্ছে না, মামলা দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। ত্রিপুরা সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেও তারা মামলা দায়ের করেছে। তাদের আবেদন— সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার কেড়ে নিচ্ছে ত্রিপুরা সরকার, তাকে বিরত করুক কোর্ট। গোয়ায় দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের অপব্যবহার করছে সে রাজ্যের সরকার।
তাঁর অভিযোগের সত্যতা আছে। সারা দেশেই নাগরিক, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের বিপর্যয় ডেকে এনেছে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের অপব্যবহার। মসজিদ ভাঙচুর এবং মুসলমানদের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে লেখার কারণে সাংবাদিক, আইনজীবী-সহ শতাধিক মানুষের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-তে মামলা দায়ের করেছে ত্রিপুরা সরকার। অন্য রাজ্যও যে এমন করবে না, সেই নিশ্চয়তা নেই।
সাম্প্রতিক কালে শিল্পীদের কাজে নানা ভাবে হস্তক্ষেপ করেছে আরএসএস ও বিজেপি-ঘনিষ্ঠ সংগঠনগুলি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দাপটে স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান মুনাওয়ার ফারুকি-র অনেক অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে। মুম্বইয়ে তারা প্রেক্ষাগৃহ পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ফারুকির দুটো অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য করেছে। অনুষ্ঠানের আগেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার আশঙ্কায় তাঁকে জেলে পোরে গুজরাত পুলিশ। ফ্যাশন ডিজ়াইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের মঙ্গলসূত্রের বিজ্ঞাপন তুলে নিতে হয়েছে মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি নেতার হুমকিতে। বিজ্ঞাপনটি নাকি বিবাহের ‘বিশুদ্ধতা’য় আঘাত করেছিল। একই ভাবে প্রত্যাহৃত হয়েছে জনপ্রিয় পোশাক সংস্থা এবং আয়ুর্বেদ ওষুধ সংস্থার বিজ্ঞাপন। উর্দু ভাষা ব্যবহার, বিজ্ঞাপনে মডেলের কপালে টিপ না-থাকা, মেয়েদের সমকামিতা— এ সবই নাকি হিন্দু ধর্মের উপর আঘাত। আর্থিক ও সামাজিক ভাবে প্রভাবশালী হয়েও বড় ব্র্যান্ডগুলি যে ভাবে নতিস্বীকার করল, তা সমাজে বার্তা দিল বইকি। এমনকি, অধিকার রক্ষায় তারা আদালতেও গেল না। ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করে তারা আত্মরক্ষা করল। হয়তো সেই আত্মরক্ষার তাগিদেই ভারাভারা রাওয়ের কবিতার বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখল বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা। কবির বিরুদ্ধে ইউএপিএ-তে মামলা চলছে। কে জানে, তার নিরিখেই কবিতার গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারিত হচ্ছে কি না!
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সংগঠন করার, সংগঠিত হওয়ার, সভা-সমাবেশ করার এবং মত প্রকাশের যে অধিকার ভারতীয় সংবিধানের ১৯ নং ধারায় দেওয়া আছে, তা আজ সর্বতো ভাবে বিপন্ন। এবং, এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই— যে যেখানে ক্ষমতায় আছে— কমবেশি একই রকম অপরাধের অংশীদার। কেবল ক্ষমতার মাত্রাভেদে প্রয়োগের মাত্রাটি পৃথক। সংগঠিত প্রতিবাদ, স্বাধীন কণ্ঠস্বর, মৌলিক ভাবনাচিন্তার পক্ষে বড় দুঃসময়।