Death Penalty

কেন আজও মৃত্যুদণ্ড?

গত ১২ মার্চ সৌদি প্রশাসন একই দিনে একাশি জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করল, যা ওই দেশে এখনও অবধি সর্বোচ্চ।

Advertisement
ওসমান মল্লিক
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৪৮

গত ১২ মার্চ সৌদি প্রশাসন একই দিনে একাশি জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করল, যা ওই দেশে এখনও অবধি সর্বোচ্চ। এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ— এঁরা বিভিন্ন সন্ত্রাসবিরোধী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, এবং সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত। বিস্ময়ের ব্যাপার, এক সঙ্গে এত জন লোকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হল, অথচ আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। অথচ, এখনও পর্যন্ত একশোটিরও বেশি দেশ থেকে মৃত্যুদণ্ড উঠে গিয়েছে। এ ছাড়া আরও সাতাশটি দেশে খাতায়-কলমে মৃত্যুদণ্ড চালু থাকলেও গত ২০ বছরে কোনও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। বৃহৎ দেশগুলির মধ্যে চিন, আমেরিকা ও ভারতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর আছে। কিন্তু ভারত বা আমেরিকায় বিরলের থেকে বিরলতম অপরাধের ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে থাকে। শেষ কুড়ি বছরে ভারতে আট জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশে নিম্ন আদালত ফাঁসির আদেশ শোনালেও, সেই সব মামলা উচ্চতর আদালতে এলে প্রায়ই সেই চরম শাস্তি রদ হয়ে যায়। চিন সরকারের গোপনীয়তার নীতির জন্য সে দেশে সাম্প্রতিক কালে কত মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, সে সম্পর্কে সঠিক কোনও পরিসংখ্যান মেলে না। একটি আন্তর্জাতিক অসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালের হিসাব অনুসারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে ইরান (২৫১), ইরাক (১০০), সৌদি আরব (১৮৪), মিশর (৩২) ও পাকিস্তানের (১৪) মতো দেশগুলির স্থান সবার উপরে। ভিয়েতনাম ও উত্তর কোরিয়া থেকে সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও সেখানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার হার যথেষ্ট বেশি।

সৌদি প্রশাসনের তরফে এর আগেও গণহারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নজির রয়েছে। ২০১৯ সালে ৩৭ জনের এবং ২০১৬ সালে ৪৭ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। আরও উদ্বেগের কারণ এই যে, মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া লোকেদের একটি বড় অংশ শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত, এবং মৃত্যুর পর তাঁদের দেহ তাঁদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। এ বারেও যে একাশি জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে চল্লিশ জন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত।

Advertisement

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই গণহারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে নানা প্রশ্ন তুললেও, পশ্চিমি মিডিয়াতে এ বিষয়ে সে ভাবে প্রতিবাদ, সমালোচনা শোনা যায়নি। নাগরিক সমাজও তেমন ভাবে সরব হয়নি। যদিও রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার হাই কমিশনার এক দিনে একাশি জনের শিরশ্ছেদ করে হত্যার সমালোচনা করে বলেছেন, এঁদের অনেকেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিচার পাননি, এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যে ধরনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড হতে পারে, তেমন জঘন্য অপরাধও তাঁরা করেননি।
শরিয়া আইন সৌদি আরবের জাতীয় আইন হলেও, সৌদি রাজকুমার তথা দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সলমান বিভিন্ন ভাবে দেশে একটি উদারতার বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন। বিশেষ করে নারীদের অধিকারের প্রশ্নে বেশ খানিকটা খোলা হাওয়ার প্রবেশ সেখানে ঘটেছে, যা বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। সলমান নিজেই বিভিন্ন সময়ে আইনি সংস্কারের পক্ষে সওয়াল করেছেন এবং মূলত তারই উদ্যোগে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমে সংস্কার হয়েছে ও ২০২১ সাল থেকে সেখানে জুডিশিয়াল রিফর্মেশন কার্যকর হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সৌদি স্পেশাল ক্রিমিনাল কোর্ট কী ভাবে এক সঙ্গে একাশি জনের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করল, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঁকি মারছে। নতুন করে উঠছে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার প্রসঙ্গও। যদিও সৌদি প্রশাসনের দাবি, আসামিরা সকলেই ন্যায্য বিচারের সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি তার ঠিক বিপরীত— আসামিদের হেফাজতে নিয়ে পুলিশ বলপ্রয়োগ করে, নির্মম ভাবে মারধর করে তাঁদের স্বীকারোক্তি আদায় করেছে। পরবর্তী কালে সেগুলিকেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে তাঁদের সাজা দেওয়া হয়েছে।

সত্য কী, তা আদৌ কখনও প্রকাশ পাবে কি না, বোঝা কঠিন। কিন্তু এই গণহারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সঙ্গে সঙ্গে ফের এক বার মৃত্যুদণ্ডের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। বর্তমানে অপরাধীদের সাজা দেওয়ার থেকেও সংশোধনের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়। সেই জন্যই যা ছিল কারাগার, তা হয়েছে সংশোধনাগার। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে সেই সংশোধনের সুযোগ নেই। প্রাণদণ্ড দেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রের আছে কি না, সে প্রশ্নও বার বার উঠেছে। তা ছাড়াও, কোনও ভাবে যদি বিচারপ্রক্রিয়ায় ত্রুটি থেকে যায়, কিংবা পরে নতুন তথ্যপ্রমাণ আসে যা বিচারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন ঠিক হয়নি, তখন কিন্তু কোনও ভাবেই আর ন্যায়বিচার দেওয়া সম্ভব হবে না। তা ছাড়া এ-ও দেখা গিয়েছে যে, মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে অপরাধ কমে, এমন নয়।

মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে এই যুক্তিগুলি পরিচিত, কিন্তু এই বিতর্কও নতুন নয়। একবিংশ শতকে এই প্রশ্নগুলি ক্রমশ আরও গুরুত্ব পেয়েছে বলেই এতগুলি রাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ড থেকে সরে এসেছে, না হলে বিরলের মধ্যে বিরলতম ক্ষেত্রেই তা প্রয়োগ করেছে। এক সঙ্গে একাশি জনের প্রাণদণ্ড, তা বিশ্বের যে কোনাতেই ঘটুক, সর্বত্রই ন্যায় ও মনুষ্যত্বের ধারণাকে আহত করে।

আরও পড়ুন
Advertisement