Sundarbans

প্রতিযোগী নয়, সহযোগী

ব্রিটিশদের ভারতের প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়েছিল সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও।

Advertisement
অমিতাভ পুরকায়স্থ
শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২২ ০৭:১৬

বাঘের সঙ্গে শাসককে মিলিয়ে দেখার সংস্কৃতি উপমহাদেশে বহু আগে থেকেই প্রচলিত, যার বিশেষ বিস্তার মোগল আমলে। ব্রিটিশরা তাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের বাঘ শিকার হয়ে উঠেছিল ভারতের প্রকৃতির উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ আরোপের চিহ্ন। ব্রিটিশদের ভারতের প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়েছিল সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও। সুন্দরবনের পতিত জমিকে লাভজনক করার উপায় হিসেবে জঙ্গল সাফ করে আবাদি ভূমিতে পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয় উইলিয়াম উইলসন হান্টারের রিপোর্টে। আবাদ শুরু হয়, সেই সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামও। কখনও মানুষ বাঁধ বেঁধে জমি ছিনিয়ে নিয়েছে, কখনও প্রকৃতি বাঁধ ভেঙে সব ভাসিয়ে জাহির করেছে ক্ষমতা। জঙ্গল সাফ করে চাষবাসের জমির চাহিদায় গ্রস্ত হয়েছে বন্যপ্রাণীর আবাসভূমি, ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে চাপ বেড়েছে জঙ্গলের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর— মাছ ধরা, কাঠ কাটা, মধু সংগ্রহে জঙ্গলে ঢোকার ফলে বাঘের কবলে পড়ে প্রাণহানি চলছে আজও।

কিন্তু সময় এসেছে সুন্দরবনের প্রকৃতিকে প্রতিস্পর্ধী না ভেবে সহযোগী মনে করে উন্নয়ন পরিকল্পনার। দরকার স্থানীয় ভূপ্রকৃতি ও জীববৈচিত্রের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে ছোট এলাকার জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা। সুন্দরবনে বনসৃজন বলতেই কমবেশি আমরা ম্যানগ্রোভ লাগানোর কথা ভেবে এসেছি। সেই মতো বিভিন্ন উদ্যোগে কাজও হয়েছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় মাটির লবণাক্ততা-সহ প্রাকৃতিক নানা কারণে সব জায়গায় একই প্রজাতির গাছ লাগালে সে চেষ্টায় সাফল্যের আশা কম। এই বনসৃজনের মূল লক্ষ্য সুন্দরবনের বিস্তৃত কাঁচা বাঁধগুলির সামনে ম্যানগ্রোভের সুরক্ষা পাঁচিল গড়ে তোলা। কিন্তু তা হলেই হল না, নদীর স্রোত, পলি সঞ্চয়ের হার-সহ নানা হিসাব রাখার প্রয়োজন হয়। আবার বনসৃজনের শুরুর উৎসাহে ভাটা পড়ে রক্ষণাবেক্ষণে এসে, ফলে চারা লাগানো থেকে পূর্ণবয়স্ক জঙ্গল গড়ে ওঠার চিত্রটা তাই খুব আশাপ্রদ নয়। তবে এ সব পরীক্ষার ফলে কিছু পরিকাঠামোও গড়ে উঠেছে সুন্দরবনে, তাতে পরবর্তী পর্যায়ের কাজে লাভ হচ্ছে। তেমন একটি উদাহরণ হল ম্যানগ্রোভ চারা তৈরির ছোট ছোট নার্সারিগুলি। ফলে নতুন করে ম্যানগ্রোভ তৈরিতে চারা জোগাড় করার অসুবিধা কমেছে।

Advertisement

আসলে দরকার প্রকৃতিকে উন্নয়ন-পরিকল্পনার সহযোগী করে তোলা, সুন্দরবনকে বুঝে ছোট ছোট পরিবেশ বা অঞ্চলভিত্তিক সমাধান। সুন্দরবনের কিছু এলাকায় জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে তেমন কিছু পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কাঁচা বাঁধ বরাবর নতুন করে ম্যানগ্রোভ লাগানো শুরু হয়েছে। স্থান নির্বাচন, চারা নির্বাচন ও চারা লাগানো, পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা। চারার সুরক্ষায় টেরাকোটার বেড় ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে এই সুরক্ষাকবচগুলির কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ন্যূনতম প্রাকৃতিক অভিঘাত হয়। একটি সারিতে গাছ না লাগিয়ে পর পর বিশেষ বিন্যাসে তিন সারি লাগানো হচ্ছে স্রোতের গতিবিধি হিসাব করে, যাতে চারাগুলির ন্যূনতম ক্ষতি হয়।

সুন্দরবনের পরিবেশগত সমস্যার একটি দিক হল প্রাকৃতিক সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত শোষণ, যার সঙ্গে জড়িয়ে স্থানীয় মানুষের জীবিকার প্রশ্ন। এক দিকে নদীর প্রবাহ রোধ করে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের চাষ সুন্দরবনের জীবমণ্ডলের ক্ষতি করছে, অন্য দিকে মাছের খোঁজে বাঘের ডেরায় ঢুকলে প্রাণের ঝুঁকি। প্রকৃতি সংরক্ষণ আর জীবিকা নির্বাহ, এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষায় একটি প্রকল্পের পরীক্ষামূলক কাজ শুরু হয়েছে। জলের স্রোত রুদ্ধ না করে, নদীর মধ্যে কিছু জায়গা নেট দিয়ে খাঁচা করে তার মধ্যে মাছ চাষ শুরু হয়েছে। নদী থেকে এই ‘ভাসমান পুকুর’-এর মাছগুলি শুধু পুষ্টি আহরণ করে, অন্য কোনও রসদ ব্যবহার করা হয় না। ফলে নদীর সাধারণ বাস্তুতন্ত্র ও খাদ্যশৃঙ্খলও অটুট থাকে। এই পরীক্ষা সফল হলে বনের গভীরে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রয়োজন কমবে। কমবে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে সংঘর্ষও। কয়েকটি জায়গায় শুরু হয়েছে বিজ্ঞানসম্মত মৌমাছি পালন। যাঁরা দুর্গম জঙ্গলে মধু সংগ্রহে যেতেন, সেই মউলিদের আর জীবনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে না। বন্য মৌচাকের তুলনায় চাষের মৌমাছি থেকে আহরিত মধুর পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় সংগ্রাহকেরাও লাভের মুখ দেখছেন। প্রাণের ঝুঁকিহীন এই মধু তাই নীরক্ত— ‘ব্লাডলেস হানি’।

সুন্দরবনের বিকল্প উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করে চলেছে ‘ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’। পরীক্ষামূলক প্রকল্পগুলির রূপায়ণে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ছাড়াও রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, পাশে আছে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা প্রশাসন। মূল লক্ষ্য জঙ্গলের উপর স্থানীয় মানুষের নির্ভরতার চাপ এবং বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষের সম্ভাবনা কমানো। এই সবই প্রকৃতিকে প্রতিযোগী নয়, সহযোগী মনে করে উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল আনার চেষ্টা। ঔপনিবেশিক আমল থেকে প্রকৃতিকে পোষ মানানোর যে মানসিকতায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, তা সরিয়ে রেখে ভিন্ন পথে হাঁটার দিশারি এই প্রকল্পগুলি।

আরও পড়ুন
Advertisement