সুস্থায়ী বিকাশ নিশ্চিত না করা হলে আরও বাড়বে নিমজ্জন
Sustainable Development

ডুবন্ত মহানগরের বার্তা

Advertisement
শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:০৯

তা  হলে, ‘প্রলয়পয়োধিজলে’ এ বার ডুবে যাবে সমুদ্র তটবর্তী নগর সভ্যতা? যেমন ডুবেছিল সিন্ধু উপত্যকার মহেঞ্জোদড়ো, নদীর ক্রমাগত ও অস্বাভাবিক-গভীর তথা ধ্বংসাত্মক বন্যায়? কিংবা, যেমন পৌরাণিক বর্ণনায়, যদুকুলচূড়ামণি শ্রীকৃষ্ণের তিরোধানের পর ডুবেছিল তাঁর সাধের দ্বারাবতী/ দ্বারকা পশ্চিম তটের সিন্ধু/ আরব সাগরে? দ্বারকাই হল পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রথম প্রাচীন নগরী যা সমুদ্রগ্রাসে বিলীন হয়ে গিয়েছে। আরব সাগর ও গোমতীর মোহনায় অবস্থিত বর্তমানের দ্বারকার পার্শ্ববর্তী সাগরে প্রত্নতাত্ত্বিকরা দীর্ঘ দিন ধরে জলের গভীরে খোঁজ করে চলেছেন সেই প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ। কিছু নিদর্শন পাওয়াও গিয়েছে,যদিও তাদের সঠিক ঐতিহাসিক সময় নিয়ে তর্ক আছে। তবুও অনেকেই মনে করেন, এক সময় সে হদিস মিলবে।

Advertisement

আমাদের গর্বের শেষ আশ্রয় কলকাতাও কি কোনও দিন এমন ভাবে নিমজ্জিত হবে? এ নিয়ে এক সময় পুরনো কলকাতায় কথাবার্তা চলত। কিন্তু সাম্প্রতিক ‘আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্যানেল’ বা আইপিসিসি-র একটি প্রতিবেদন (২০২১) অনুযায়ী, মুম্বই, চেন্নাই ও সুরাতের সঙ্গে, নানা কারণে, আমাদের প্রিয়, এক কালের ‘মিছিল নগরী’টির কপালেও নাকি ২১০০ সাল নাগাদ তেমনটাই নাচছে, যদি আগে থেকে সামলে না চলি। যদিও, এমন হিসাবের বহু আগেই, প্রখ্যাত লেখক কেতকী কুশারী ডাইসন সাহিত্যিক-কল্পনার প্রয়োগে তাঁর ভিন্ন গোত্রের নাটক রাতের রোদ-এ জীবনানন্দের অমর পঙ্‌ক্তির— ‘কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে’— বিনির্মাণ ঘটিয়ে (‘কল্লোল’=ঢেউ— এই সূত্র ধরে) দেখাতে চেয়েছেন, জীবনানন্দ-উল্লিখিত প্রাচীন শ্রাবস্তী, বিদিশা— সবই যেমন কালের করালগ্রাসে বিলীন হয়েছে, বা দ্বারকার মতো সলিলসমাধি হয়েছে, কলকাতাও এক দিন ধ্বংস হবে, ‘ডুবে’ যাবে!

সে হয়তো যাবে, দূরের বা অনতি-দূরের কোনও এক দিন। কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্বের একটি দেশের বহু দিনের ‘রাজধানী’ হিসেবে সদ্য ‘পরিত্যক্ত’ হয়ে অন্যত্র রাজধানী স্থানান্তরিত (আসলে দ্বীপান্তরিত) হয়েছে। কেননা, ওই প্রাক্তন-রাজধানী নগরীটি ‘ডুবে যাচ্ছে’! এক দিনে নয়— বহু দিন ধরে একটু-একটু করে, এখন অবস্থা এমন যে ‘আর তো গতি নাহি রে’। তাই ঝুঁকি না নিয়ে গত বছরের অগস্ট মাসের ২৭ তারিখ রাজধানীর স্থান বদল হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপময় ইন্দোনেশিয়াই প্রথম দেশ, যার রাজধানী জাকার্তা (ছবি) থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। প্রধান কারণ, শহরের উত্তরাংশ গত ২৫ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অন্তত ১৬ ফুট বসে গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে উষ্ণায়নের জন্য যেখানে বাকি বিশ্বে বছরে গড়ে ৫-৬ মিলিমিটার সমুদ্রের জলস্তরের উত্থান হচ্ছে, সেখানে জাকার্তায় ফি-বছর ভূমি বসে-যাওয়ার হার হল ১১-১২ সেন্টিমিটার!

ফলে, সমুদ্র ঢুকে পড়েছে শহরের উত্তরের বন্দর এলাকায়। একদা ঔপনিবেশিক ওলন্দাজ প্রভুদের দেওয়া আদরের নাম, ‘বাটাভিয়ান মেরিনা’ বন্দরে ঢুকলেই এই সত্য ‘চাক্ষুষ’ করা যাবে। আমাদের খিদিরপুর বা দেশের কিংবা বিশ্বের অন্য যে কোনও বন্দরে যেমন কাটা খালে ভাসিয়ে জলযানগুলিকে নদী বা সাগরের খাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, এখানেও তেমনটাই হয়। পার্থক্য শুধু, অন্যত্র এই খালগুলির জলস্তর থাকে বন্দরের রাস্তাঘাটের চেয়ে বেশ খানিকটা নীচে, আর উত্তর জাকার্তায় বন্দরের রাস্তা থেকে দু’মানুষ সমান উঁচুতে খালের জল উঠে এসেছে, যেখানে ভাসছে জলযান— রাস্তায় কংক্রিট, বালি-সিমেন্ট ইত্যাদির বস্তা দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে, যাতে খাল দিয়ে ঢুকে পড়া সাগরের জল পথঘাট ভাসিয়ে না দেয়!

রাজধানীর এমত ডুবন্ত ভবিষ্যৎ দেখে ইন্দোনেশিয়ার সরকার গত বছর জাকার্তা থেকে ১৬০০ কিমি দূরত্বের, বোর্নিয়ো দ্বীপের নুসান্তারা-য় নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ বোর্নিয়ো-র উপর দিয়ে বিষুবরেখা দ্বীপটিকে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে বিভক্ত করেছে। ইন্দোনেশিয়া যদিও এই দ্বীপের সবচেয়ে বড় দেশ, কিন্তু প্রাচীন, স্থানীয়-হিন্দু ‘সুন্দা’ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এই অঞ্চলটিতে রয়েছে মালয়েশিয়ার পুবের দু’টি প্রদেশ ও ব্রুনেই-এর ক্ষুদ্র সার্বভৌম সুলতানি রাষ্ট্র। নুসান্তারা-র চার পাশে রয়েছে ঘন বৃষ্টি-অরণ্য, বোর্নিয়ো প্রজাতির ওরাংওটাং-সহ বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রচুর পশুপাখি, কীটপতঙ্গ। এমন ভারসাম্যের বাস্তুতন্ত্রে নতুন রাজধানীর নির্মাণ কি পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাবে না? বিশেষত যখন সরকার প্রায় দু’লক্ষ শ্রমিক-ইঞ্জিনিয়ার-বাস্তুকারদের পাঠিয়েছে আনুমানিক ৩৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার ব্যয়ে নতুন রাজধানী গড়তে! দেশের প্রশাসন অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে— নুসান্তারা-য় কেবল বৈদ্যুতিক যানবাহনই চলবে। এই দশকের শেষে ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পও গড়ে ওঠার কথা। তবুও পরিবেশবিদদের সন্দেহ পুরোপুরি অন্তর্হিত হচ্ছে না।

জাকার্তা থেকে রাজধানী স্থানান্তর করার চিন্তা অবশ্য দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ-র। বহু আগেই (১৯৫৭) জনসংখ্যা ও বন্যা বৃদ্ধির কারণে বোর্নিয়ো-র পালাংকারায়া শহরে দেশের রাজধানী সরাতে চেয়েছিলেন। মাটি ‘বসে যাওয়া’র সমস্যা তখনও এমন মারাত্মক চেহারা ধারণ করেনি। এই সমস্যাটা খালি জাকার্তার নয়, বিশ্বের আরও কিছু বড় শহর— ব্যাঙ্কক, ইয়াকোহামা বা মেক্সিকো সিটির মতো ঘন বসতির শহরেরও। এদের মধ্যে কয়েকটি অন্য উপাদানও আছে, কিন্তু জাকার্তায় এখন যা ঘটছে তা সমুদ্রতটস্থ, বা তার থেকে অনতিদূরের সব মহানগরের জন্যই আগাম বিপদ-ঘণ্টি!

ভূপ্রকৃতির এই পরিবর্তনের পিছনে দায়ী যে অন্যতম উপাদান, তাকে ভূতাত্ত্বিকরা শিল্পবিপ্লবোত্তর কালে বিশ্বের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের উপর মানবপ্রজাতির কার্যকলাপের নেতিবাচক প্রভাব এবং এই কালটিকে ‘অ্যান্থ্রোপোসিন’ বলে চিহ্নিত করেছেন। পূর্ব ভারত-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র-তটবর্তী বহু রাজধানী/ প্রধান শহরই ‘বদ্বীপ’-এর (ডেল্টা) উপর প্রতিষ্ঠিত, যা আসলে জলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। স্বাভাবিক কারণে, এই সব অঞ্চলে ছোট-বড় বেশ কিছু নদীর মোহনাও থাকবে। জাকার্তাতে এমন নদীর সংখ্যা তেরো! এমন ভূপ্রকৃতির পরিসরে যদি জনচাপ ও নগরায়ণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে যথেচ্ছ নিচু জলাজমি/ বেসিন বোজানো, গাছ কাটা এবং গগনচুম্বী বহুতলের সংখ্যা বাড়িয়ে নগর-পরিসরকে কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করা হয় এবং সেখানে জল সরবরাহ করার জন্য গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভস্থ জল তোলা হয়, তবে তা ওই ‘বদ্বীপ’ অঞ্চলটির নীচের জলরাশিকে ‘ফাঁকা’ করে দেবেই। এ ছাড়া, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সাম্প্রতিক উষ্ণায়নের কারণে তার মাত্রা এবং ক্রমটি ‘তাল-ছাড়া’ হয়ে পড়ায় যখন-তখন বন্যার প্রকোপ বাড়ছে, যার যথার্থ নিকাশি ব্যবস্থা নেই!

অথচ, পাহাড়-সাগর মিলে ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের মতো সুন্দর দেশ খুব কমই আছে। বহু শতাব্দীর ভারতীয় সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলি (মন্দির-চৈত্য, প্রথা ও নামে) এখনও মানুষের জীবনে তাদের স্থানীয় স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর। সামাজিক ভাবেও প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ ও বর্তমানের মুসলিম ধর্মের মধ্যে (বালি ছাড়া সর্বত্র মুসলিমরাই গরিষ্ঠসংখ্যক) কোনও সংঘাত তো নয়ই, বরং সমন্বয়ের আন্তরিক চেহারাটাই চোখে পড়ে। যার উল্টো ছবিটাই দক্ষিণ এশিয়াকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আর্থিক দিক থেকেও গত তিন দশকে যখন অধিকাংশ বড় দেশে, অর্থ ও সম্পদের নিরিখে অতি-ধনী ও অতি-দরিদ্রের অসাম্য মারাত্মক বেড়েছে, সেখানে ইন্দোনেশিয়ায় অসাম্য তো বাড়েইনি, বরং কিছুটা হ্রাসমান— এ কথা নোবেল-জয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন। জাকার্তায় অবশ্য এই অসাম্য দেশের অন্য জায়গাগুলির চেয়ে, অতি প্রকট। তবে কি উত্তর-উদারবাদী পুঁজিবাদের লোভও জাকার্তাকে ‘ডুবিয়ে’ দেওয়ার একটি অন্যতম অন্তর্নিহিত কারণ? জাকার্তার পাশাপাশি বালি বা জাভাদ্বীপেরই যোগ্যকর্তায় গেলে এই তফাত প্রতীয়মান হয়। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে (১৯২৭) এই সব অঞ্চল ভ্রমণে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ জাভাযাত্রীর পত্র লেখেন। বালি-তে কিছু দিন কাটিয়ে কবির উপলব্ধি— “ওলন্দাজ গবর্মেন্ট, বাইরে থেকে কারখানাওয়ালাদের এই দ্বীপে আসতে বাধা দিয়েছে… গঙ্গার ধার জুড়ে দ্বাদশ দেউলগুলিকে লজ্জিত করে বাংলাদেশের বুকের উপর জুটমিল যে নিদারুণ অমিল ঘটিয়েছে এ সেরকম নয়।…”

প্রকৃতির সঙ্গে শিল্পবিকাশের এই তাল-মিল, যার পোশাকি নাম ‘সুস্থায়ী বিকাশ’, যদি এই মুহূর্তে সুনিশ্চিত না করা যায়, তবে বিশ্বের নানা স্থানে এমন অনেক নিমজ্জমান ‘জাকার্তা’র সংখ্যা যে বাড়বে, তা কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই বলে দেওয়া যায়।

Advertisement
আরও পড়ুন