ভারত এখন বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জনবহুল দেশ। দেশে জনসংখ্যার গঠন, বিশেষ করে মহিলাপিছু গড় শিশুর সংখ্যা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন রকম। তদুপরি, জনসংখ্যার কাঠামো, বিন্যাস এবং জনসংখ্যার পরিবর্তনের পর্যায় রাজ্য অনুযায়ী ভিন্ন। রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষিত নীতি অনুসারে যদি সব রকমের বৈচিত্রের কথা মাথায় রেখে সকলের অন্তর্ভুক্তি এবং সমতা নিশ্চিত করতে হয়, তবে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তব্য জনসংখ্যা সম্পর্কিত নতুন নীতি প্রণয়ন করা, যেখানে সর্বস্তরের জনবিন্যাসের সমস্যা ও সমাধানের একটা দিকনির্দেশ পাওয়া যাবে। পাশাপাশি, রাজ্য সরকারগুলিকেও তাদের নিজস্ব অনন্য জনসংখ্যাগত চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।
পশ্চিমবঙ্গের কথা আলাদা করে বলা প্রয়োজন। ২০২০ সালের স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম-এর তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মহিলাপিছু সন্তানের সংখ্যা গড়ে ১.৪-এ নেমে এসেছে— গ্রামে এই গড় ১.৫, এবং শহরে ১.১। এই হার পশ্চিম ইউরোপের বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলির সমতুল্য। যদিও জনবিন্যাস, জনগণের বয়সের কাঠামো, লিঙ্গানুপাত, পরিযাণ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আবর্তিত হয়, তবুও সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে এই ক্রমহাসমান জন্মহারের কারণ জানার প্রচেষ্টা অথবা এর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ফলাফল মোকাবিলার কোনও রূপরেখা তৈরির আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।
পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি জটিল এবং বহুস্তরীয়। এখন যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও হবে, তা মূলত পপুলেশন মোমেন্টাম বা জনমিতি গতিশীলতার কারণে। তথ্যের বিশ্লেষণ বলছে যে, ২০৫০-৬০’এর দশকের পর জনসংখ্যা হ্রাস পাবে; এবং তার ফলে যে সমস্যা হবে, তা হয়তো সে বিষয়ে বর্তমান অনুমানের চেয়ে তীব্রতর হবে। কাজেই, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি এখন আলোচনার প্রধান বিষয় হওয়া উচিত; বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জন্য’— হাটে-বাজারে আকছার শোনা এই কথাটির অভিমুখ বাস্তবের বিপরীত। পশ্চিমবঙ্গের জন্মহার দীর্ঘ দিন ধরে জাতীয় গড়ের চেয়ে কম, এবং রাজ্যের বর্তমান অদৃঢ় আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা এই জনসংখ্যা হ্রাসের নেতিবাচক প্রভাবকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে জন্মহার কম হলেও, তাদের তুলনায় উন্নত অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান এই পরিবর্তনগুলিকে দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে সক্ষম। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের জন্য, এই সমস্যা মোকাবিলা করা আরও কঠিন হবে।
এক কালে ভারতের ধনীতম প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গ ২০২২-২৩ সালের হাউসহোল্ড কনজ়াম্পশন এক্সপেন্ডিচার সার্ভে অনুসারে গ্রামীণ এলাকার মাথাপিছু ব্যয়ের ক্ষেত্রে শেষ থেকে তৃতীয় এবং শহুরে এলাকার মাথাপিছু ব্যয়ের ক্ষেত্রে শেষ থেকে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। রাজ্যের মাথাপিছু আয়ও জাতীয় গড়ের নীচে। রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সিংহভাগ এখনও আসে কৃষি থেকে, প্রায় ৬৮% গ্রামীণ মানুষ কৃষির উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু, ২০১৭-১৮ সালের কৃষি-পরিবার সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে কৃষি-পরিবারের আয় ভারতে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন— মাত্র ৬,৭৬২ টাকা, যা জাতীয় গড় ১০,২১৮ টাকার চেয়ে অনেক কম। ভারতের রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি ২০০৫-১০ সালে ৫.৭% থেকে কমে ২০১২-২০ সালে ৪.২% হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বার্ষিক মাথাপিছু আয় মাত্র ১,৪০০ ডলার, যা জাতীয় গড় ২,৪৮৫ ডলারের চেয়ে অনেক কম। এ ছাড়াও, এনএসএসও-এর ২০১৭-১৮ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী রাজ্যে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি (৩২%), এবং অ-কৃষিক্ষেত্রে নিয়মিত বেতনভুক কর্মীদের ৫৯ শতাংশের কোনও ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা যেমন পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা বা প্রসূতি সুবিধা ইত্যাদি নেই। রাজ্যের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার যথেষ্ট বেশি, বিশেষ করে মাধ্যমিক বা উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৯.১% এবং ১৫-২৯ বছর বয়সি শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে ১২.৪%।
এই সমস্যাগুলোর পাশাপাশি, রাজ্যে কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমছে এবং প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা বাড়ছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে মহিলাপিছু গড় সন্তান সংখ্যা ১.৪— রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০২১-২৫ থেকে ২০৩১-৩৫ সময়কালে ৩.৩ শতাংশ কমবে। রাজ্যে ১৯৭০-এর দশক থেকেই জন্মহার ক্রমহাসমান, বিশেষ করে ২০০০ সালের পরে গ্রামীণ এলাকায় জন্মহার দ্রুত কমার কারণে এই হ্রাস আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। উল্লিখিত প্রক্ষেপণ রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের জন্মহার ২০৩৬ সালেও বর্তমানের মতো থাকবে, যার ফলে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা আরও বাড়বে। বয়স বিন্যাস পরিবর্তনের ফলে, ২০৩৬ সালে রাজ্যের জনসংখ্যার গড় বয়স প্রায় ৩৯ হবে এবং কাজ করার উপযোগী জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬৫.৫% হবে। প্রায় ১৮.৩% মানুষ ৬০ বছরের বেশি বয়সি হবেন। এই পরিস্থিতিতে, প্রতি হাজার জনের জন্য নির্ভরশীল ব্যক্তির অনুপাত বেড়ে ২৭৯ হবে, যা ২০২১ সালের ১৬৬-এর তুলনায় অনেক বেশি। ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হার, ঠিকা শ্রমের উপর অতি নির্ভরশীলতা, বৃহৎ সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক (২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিকের চতুর্থ বৃহত্তম উৎস)— সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ বিষয়ে দুশ্চিন্তার বিস্তর কারণ রয়েছে।
জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া বা জার্মানির মতো দেশ জনসংখ্যার হ্রাসের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করছে, তবে তাদের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বেশ এগিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করতে হলে অর্থনৈতিক বৈচিত্র এবং সামাজিক নীতিতে কৌশলগত বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারের উচ্চ স্তরে এবং গণমাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের জনসংখ্যার বিন্যাস ও কাঠামো নিয়ে গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা এখনই প্রয়োজন।