Bank Loans

ধার দেওয়ার টাকা থাকবে না?

সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের হাত ধরে ব্যাঙ্কগুলি এত দিন যত সহজে এবং সস্তায় পুঁজি পেয়েছে, তেমনটা আর সম্ভব হবে না বলেই মনে হয়। ব্যাঙ্কে আমানতের পরিমাণ যদি বাড়াতে হয়, তা হলে সেই খাতে বেশি খরচ করতে হতে পারে।

Advertisement
নীলাঞ্জন দে
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৪:৪৫

গত কয়েক বছরে বাজার-মনস্ক লগ্নিকারীর সংখ্যা বেড়েছে, সন্দেহ নেই। ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের আমানত ভাঙিয়ে মিউচুয়াল ফান্ড অথবা সরাসরি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করতেও অনেকেই আর দ্বিধা করেন না। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রকের অধীন ডিপার্টমেন্ট অব ফাইনানশিয়াল সার্ভিসেস সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করল, এবং জানাল যে, গার্হস্থ সঞ্চয় এ ভাবে বাজারমুখী হওয়ায় মধ্যবিত্তের পক্ষে আর্থিক ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। কিন্তু একটা অন্য প্রশ্নও উঠছে— মানুষ যদি ব্যাঙ্কে আর টাকা না রাখে, তা হলে কি ব্যাঙ্কের হাতে নগদের জোগানে টান পড়তে পারে, যার ফলে নতুন ঋণ দিতে অসুবিধা হবে?

Advertisement

সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের হাত ধরে ব্যাঙ্কগুলি এত দিন যত সহজে এবং সস্তায় পুঁজি পেয়েছে, তেমনটা আর সম্ভব হবে না বলেই মনে হয়। ব্যাঙ্কে আমানতের পরিমাণ যদি বাড়াতে হয়, তা হলে সেই খাতে বেশি খরচ করতে হতে পারে। অর্থাৎ সুদের হার যথেষ্ট আকর্ষণীয় করতে হবে আমানতকারীর জন্য— নয়তো তাঁরা শেয়ার বাজারের হাতছানি এড়িয়ে ব্যাঙ্কে টাকা জমাতে আসবেন কেন? এ দিকে, ‘কস্ট অব ফান্ডস’ বাড়লে ব্যাঙ্ক অসুবিধায় পড়বে। সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে অর্থ মন্ত্রক এই বিষয়ে তাদের যে বক্তব্য জানিয়েছে, লিকুইডিটি বা ব্যাঙ্কের হাতে নগদের জোগান অব্যাহত রাখার প্রসঙ্গ সেখানেই উঠেছে।

মন্ত্রকের মতে, অর্থনীতির কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ দ্রুত শেয়ার বাজারের দিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি, ডিজিটালাইজ়েশন-এর পরিপ্রেক্ষিতে, এবং ভোগ্যপণ্যের জন্য ঋণ আরও সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার জন্য ঋণ নেওয়ার সংস্কৃতিও বেশ জাঁকিয়ে বসছে। দুনিয়ার বহু দেশেই আয়ের অনুপাতে গার্হস্থ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এক দিকে যেমন তাতে বাজারে চাহিদা বাড়ে, তেমনই আবার সাধ্যের অতিরিক্ত ঋণগ্রহণের অভ্যাস আর্থিক ঝুঁকির পরিমাণও বাড়ায়। ফলে, এই বিষয়টির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা ভাল।

আরও একটি প্রশ্ন করা প্রয়োজন: গত ১০-১৫ বছরে ভারতে যে ভাবে ব্যক্তিগত সঞ্চয় ক্রমেই শেয়ার বাজার-অভিমুখী হয়েছে, যার ঝুঁকির কথা এখন কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্টেও উঠে আসছে, তা কি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষেরই সিদ্ধান্ত? না কি, মানুষকে এই বাজারের দিকে চালিত করার কথা ভাবা হয়েছে আলাদা ভাবে? হ্যাঁ, আম জনতাকে একমাত্রিক আমানত থেকে বার করার চেষ্টা অবশ্যই করা হয়েছে। সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে, অতি-লোভের শিকার না হয়ে, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লগ্নি বহু মানুষকে সম্পদ গঠন করতে সাহায্য করেছে। যাঁরা শুধুমাত্র ‘ডিপোজ়িটর’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা কয়েক কদম এগিয়ে ‘ইনভেস্টর’ হয়েছেন। সনাতন পন্থা ত্যাগ করে লগ্নির নতুন পদ্ধতি আঁকড়ে, বিশেষ করে হালে-আসা প্রযুক্তি ব্যবহার করে, অনেকেই উপকৃত। এই ব্যাপারে সরকারি নীতি যথেষ্ট স্বচ্ছ। তার কল্যাণে স্টক এক্সচেঞ্জ-সহ বিনিয়োগ তথা পেমেন্ট সংক্রান্ত পরিকাঠামো আজ আমাদের দেশে বেশ উন্নত। ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা থেকে আরম্ভ করে ইউপিআই ভিত্তিক লেনদেনের পরিমাণ, সবেতেই তার ইঙ্গিত। লগ্নি সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিষেবা ভবিষ্যতে আরও পরিচ্ছন্ন এবং সহজলভ্য হবে।

অসুবিধা হবে সাবেক ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে। আজকের এই কড়া প্রতিযোগিতার বাতাবরণে, কী ভাবে নতুন প্রজন্মের মন পেতে হবে, তা নির্ধারণ করতে হবে তাদের। আমানতের উপরে ৭-৮ শতাংশ সুদ পেলে চলবে না, এই কথা গ্রাহকের মাথায় গেঁথে গেছে। মনে রাখতে হবে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ফের সুদের হার কমিয়েছে। মূল্যস্ফীতির গণ্ডি পেরিয়ে অন্তত ডাবল-ডিজিট রিটার্ন চাই, এ কথা মন্ত্রের মতো আমরা অনেকেই জপ করে চলি। এবং অন্তত বছর তিনেক ধরে স্টক মার্কেটে চটজলদি অবাস্তব লাভ পাওয়ার আশা প্রায় অভ্যাসে রূপান্তরিত হয়েছে। এই ছয় মাসের অভিজ্ঞতা তাই বাজারে সদ্য পা-রাখা লগ্নিকারীর জন্য রূঢ় সত্য।

সাধারণ মার্কেট-নির্ভর লগ্নির পক্ষে কোনও ধরনের লাভের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব নয়, এ কথা ভুললে চলবে না। কোনও স্টক বা ফান্ডের প্রকল্প নিয়ে যদি কেউ এমন দাবি করেন, তা হলে অবশ্যই তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত। তবে অতি দ্রুত লাভ পাওয়ার চেষ্টাই হয়তো এক দিন হয়ে দাঁড়াবে ব্যাঙ্কের আমানতের পক্ষে সহায়ক। লড়াইটা জমবে দুই শিবিরের মধ্যে— নিশ্চিত কিন্তু স্বল্প লাভ, এবং অনিশ্চিত কিন্তু সম্ভাব্য বড় লাভ। কে জিতবে আর কে-ই বা হারবে, সে কথা এখনই বলার সময় আসেনি। তবে আমাদের দেশে সস্তা টু-হুইলার যেমন বিক্রি হয়, তেমনই মহার্ঘ বিলাসবহুল গাড়িও বিক্রি হয়, দু’টিরই বাজার আছে। কখনও একটা কম, কখনও অন্যটা বেশি। ক্রেতা বিক্রেতার অভাব মাঝেমধ্যেই বোঝা যায় বটে, তবে বাজার তার নিজস্বতা বুঝিয়ে দেয় পূর্ণমাত্রায়।

Advertisement
আরও পড়ুন